হেলাল উদ্দিন চৌধুরী (তুফান) »
১ জুলাই জননেতা জহুর আহম্মদ চৌধুরীর ৪৮ তম মৃত্যুবাষিকী। ১৯৭৪ সালের ১ জুলাই ঢাকার পিজি হাসপাতালে বর্তমান বঙ্গবন্ধু মেডিকেল হাসপাতালে ৬৯ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।
তিনি মাত্র ১৭ বছর বয়স থেকে সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য রাজনীতি শুরু করেন। তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার কলকাতায় খিদিরপুর ডক শ্রমিক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শ্রম রাজনীতির সাথে জড়িত হন। সারাজীবন শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে গেছেন। অতি সাধারণ জীবন যাপন করে, দীর্ঘ ৪২ বছর আমৃত্যু সক্রিয় রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন।
১৯৬৬ সালে ৬ দফা ঘোষণার জন্য ঢাকায় আওয়ামী লীগের সভা ডাকেন। উক্ত সভায় বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার বিরুদ্ধে শীর্ষ নেতারা বিরোধীতা করলে এম.এ. আজিজ চাচা এবং আমার বাবা ৬ দফার পক্ষ নিয়ে ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে আমার বাবা মরহুম জহুর আহম্মদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা ঘোষণা করেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ১১টা ৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের দামপাড়া বাসায় ৮০৭৮৫ টেলিফোন এ স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠানোর জন্য ফোন করেন। তখন আমার বাবা জহুর আহম্মদ চৌধুরী চট্টেশ্বরী সড়কের মেডিকেল হোস্টেল এর বিপরীতে পাহাড়ের উপর ওয়াপদা রেস্ট হাউজে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীদের সাথে অবস্থান করছিলেন। আমার মা টেলিফোন কলটি গ্রহণ করেন এবং বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র ডিকটেশন দেন এবং আমার মা ডা. নুরুন নাহার জহুর নিজের হাতে লিখে নেন এবং তাৎক্ষণিক বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রেরিত স্বাধীনতার ঘোষণাটি কয়েক কপি লিখে নেন। এক কপি আমার বাবার নিকট প্রেরণ করেন। চট্টগ্রাম শহরে প্রচারের জন্য তিনি আওয়ামী লীগের তৎকালীন নেতা কর্মীদের প্রেরণ করেন।
আমার মরহুম পিতা জহুর আহম্মদ চৌধুরীর সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে পরিচয় কোলকাতায় ১৯৪৩ ইংরেজীতে। বঙ্গবন্ধু তখন কোলকাতা ইসলামী কলেজের ছাত্র। বঙ্গবন্ধু সেই সময় মাত্র ২৩ বছর বয়সের টগবগে যুবক। আমার পিতা ১৯৩৮ইং থেকে মুসলিম লীগ ও খিদিরপুর ডক শ্রমিক লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি থাকার কারণে কোলকাতায় অবস্থান করতেন শহীদ হোসেন সোরওয়ার্দীও ঘনিষ্ঠ অনুসারী আমার পিতা জহুর আহম্মদ চৌধুরী সাথে বঙ্গবন্ধু পরিচয় করিয়েছেন, শহীদ হোসেন সোরওয়ার্দী। বঙ্গবন্ধু আমার পিতার বয়সে ছয় বছরের কনিষ্ঠ। মুসলিম লীগের রাজনীতিতে তখন আমার পিতা এবং জননেতা এম.এ. আজিজ সমান তালে চট্টগ্রামের নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠার বীজ বপন করেন। বঙ্গবন্ধু সাথে আমার পিতার পরিচয়ের থেকে আমার পিতা মরহুম জহুর আহম্মদ চৌধুরী মৃত্যু পর্যন্ত আমারণ রাজনৈতিক, পারিবারিক, সামাজিক ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। বঙ্গবন্ধু আমার পিতাকে খুব ভালোবাসতেন এবং বিশ্বাস করতেন। বঙ্গবন্ধুর দুঃসময়ে এবং প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতে আমার বাবার সাথে সমস্যা সমাধানের জন্য সব সময় আলাপ আলোচনা করতেন। আমার পিতা আমৃত্যু বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা ও বিশ্বাস নিয়ে মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে একদিনের জন্যও দূরে সরে যান নাই। আমার বাবা এবং আমার পরিবারের সাথে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সাথে এখনো সম্পর্ক বিদ্যমান। আমরা এখনো সেই পুরাতন ঐতিহাসিক সম্পর্কের বন্ধন ধরে রেখেছি। ছেলে হিসাবে আমার বাবার মৃত্যুর আগে ও মৃত্যুর পরের বঙ্গবন্ধুর অনেক স্মৃতি মনে আছে।
১৯৭৪ সালের জুন মাসের ১৫ তারিখ আমার পিতা লিভার সিরোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার পিজি হাসপাতালে ভর্তি হন (বর্তমান বঙ্গবন্ধু মেডিকেল, শাহবাগ)। সে সময় বাজেট ঘোষণা অধিবেশন চলছিল। বঙ্গবন্ধু প্রতিদিন সন্ধ্যায় পিজি হাসপাতালে আমার বাবাকে দেখতে চলে আসতেন এবং দুই থেকে তিন ঘন্টা সময় ওখানে অবস্থান করতেন এবং আমার বাবার মৃত্যুর আগের দিন ৩০ জুন ১৯৭৪ সালে সন্ধ্যার পর আমার বাবাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্না করেছেন। তার আগে ডা. নুরুল ইসলাম সাহেব বঙ্গবন্ধু জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, উনার বাঁচার সম্ভবনা ক্ষীণ। সেই রাতে আমার বাবার সাথে বঙ্গবন্ধুর শেষ দেখা ও বিদায়। ১ জুলাই ১৯৭৪ইং সোমবার ভোর ছয়টায় আমার বাবা মৃত্যুবরণ করেন। আমার বাবার মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু আমাদের ৩৪ নম্বর মিন্টু রোড বাসভবনে ছুটে আসেন এবং মন্ত্রি পরিষদ সদস্য, প্রশাসন, প্রতিরক্ষা বাহিনীর সকল স্তরে আমার বাবার শেষ বিদায় ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে নির্দেশসহ নিজ দায়িত্বে নিজের ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে গোসল দেওয়া, কাফন পরানো, খতম কোরআন, এবং ঢাকায় দুইটি জানাযা নামাজ একটি আওয়ামী লীগ অফিসে অন্যটি জাতীয় সংসদ ভবনে (বর্তমানে প্রধান মন্ত্রীর কার্যালয়) জানাযার নামাজের ব্যবস্থা করেন। সর্বস্তরের ফুলের শ্রদ্ধাঞ্জলী এবং প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী সভা ও আওয়ামী লীগের পক্ষে বঙ্গবন্ধু নিজে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পন করেন এবং দুইটি জানাযা সম্পূর্ণ করার পর বঙ্গবন্ধু আমার বিশাল পরিবারের সদস্যসহ, রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী সভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগে কমিটি নিয়ে একটি বিশেষ বিমানের চট্টগ্রাম এ আসার ব্যবস্থা করেন এবং হেলিকাপ্টারে বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রাম আগমন করেন। চট্টগ্রামের প্যারেড গ্রাউন্ডে জানাযার পর বঙ্গবন্ধু নিজে উপস্থিত থেকে দামপাড়া আমাদের পারিবারিক কবর স্থানে রাষ্ট্রপতি, তিন বাহিনীর প্রধান সহ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আমার পিতা মরহুম জহুর আহম্মদ চৌধুরী দাফন কার্য সম্পন্ন করে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমার বাবাকে তিন বাহিনীর গান স্যালুট এর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্মান দিয়ে দাফন কার্য সমপন্ন করে। আমার পিতাকে রাষ্ট্রীয় সর্বচ্ছো সন্মান দিয়ে শেষ বিদায় জানান।
স্বাধীনতা-উত্তর সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর সদস্য বাংলাদেশ পূর্নগঠনে বেশ কিছু উল্লেখ্যযোগ্য পদক্ষেপ নেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ শিশু ও নারী মানবেতন জীবন যাপন করছিল। যুদ্ধে পিতৃমাতৃহারা লক্ষ লক্ষ এতিম ছেলেমেয়েদের এতিমখানায় থাকা-খাওয়া, লেখাপড়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, উনি চট্টগ্রাম লালখান বাজার এর ইস্পাহানি বিল্ডিং, নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটিতে তিনটি বাড়ি, মুরাদপুরে বিশাল কয়েকটি এতিমখানা প্রতষ্ঠা করেন এবং উনি সশরীরে এতিমখানা গুলো পরিদর্শন করতেন। সমাজকল্যান দপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগের পরিচালক, চট্টগ্রামের মেয়ে জওশন আরা রহমান এর প্রজেক্ট গুলো পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত এবং পিতা, স্বামীহারা বিধবা, এতিম, নির্যাতিত নারীদের পুনর্গঠনের জন্য নারী পুনর্বাসন বোর্ড গঠন করেন। এই প্রকল্পের আওতায় সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় নারী পুনর্বাসন প্রকল্প প্রতিষ্ঠা করেন। মহিলাদের সেলাই শিক্ষা, কুটিরশিল্প তৈরির শিক্ষা এবং পুনর্বাসন কেন্দ্র কর্তৃক উৎপাদিত পণ্য বিপণের ব্যবস্থা নেন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় উনি বাংলাদেশে বৃহৎ দুইটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকার বর্তমান বঙ্গবন্ধু মেডিকেল হাসপাতালটি ছিল তৎকালীন পাকিস্তানিদের শাহবাগ হোটেল। এই শাহবাগ হোটেলের সামনের রাস্তা দিয়ে উনি বাসা থেকে যাওয়ার সময় নিয়মিত আসা-যাওয়া করতেন। শাহবাগ হোটেলকে হাসপাতাল হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার চিন্তা ও স্বপ্ন দেখেন। চট্টগ্রামের প্রখ্যাত চিকিৎসক জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম সাহেবকে দায়িত্ব দিয়ে তৎকালীন পিজি হাসপাতাল (চড়ংঃ এৎধফঁধঃব ঐড়ংঢ়রঃধষ) প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুমোদন নিয়ে হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করার সে সময় বাংলাদেশের বড় ব্যবসায়ী এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি উক্ত শাহবাগ হোটেলটি সরকার থেকে লিজ নিয়ে হোটেল ব্যবসা চালুর চেষ্টা করেন কিন্তু আমার পিতা মরহুম জহুর আহমদ চৌধৃুরী কঠোরভাবে অবস্থান নিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সহায়তায় হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করেন,যা বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল নামে পরিচিত।
চট্টগ্রামে ফয়’স লেকস্থ চক্ষু হাসপাতাল তাঁরই অবদান। জার্মান সরকার হতে একটি চক্ষু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব আসলে তিনি ফয়’স লেকে রেলওয়ে থেকে জমি বরাদ্দ নিয়ে জার্মান সরকারের সহায়তায় বর্তমান চক্ষু হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতিও প্রতিষ্ঠা করেন।
শ্রমমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব নিয়ে তিনি সর্বপ্রথম বাংলাদেশে শ্রম আইন সংস্কারের কাজ শুরু করেন, জাতীয় সংসদে শ্রম আইনের সংস্কারে প্রথম বিল উত্থাপন করেন। এতে দেশের শিল্প উন্নয়নের জন্য মালিক শ্রমিক একসাথে কাজ করার জন্য যাবতীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়। এদেশের শ্রমিক সমাজের স্বার্থ এবং বাংলাদেশের শিল্পে দ্রুত অগ্রগতির লক্ষ্যে উনি আমৃত্যু কাজ করে গেছেন।