ড. মো. মোরশেদুল আলম »
গত ২৮ অক্টোবরের সহিংস ঘটনাবলির পর বিএনপি ও তার সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো লাগাতার অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে। এসব কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে যানবাহনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। একইসঙ্গে ট্রেনে অগ্নিসংযোগ ও রেলপথেও নাশকতা করছে। প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন ঘটনা। দায়িত্ব পালনরত একজন পুলিশ সদস্যকে হত্যাকাণ্ডের যে বীভৎস দৃশ্য দেশবাসী দেখেছে, তা তাদের আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আবার হাসপাতালে সংঘর্ষকারীদের হামলা সংঘর্ষের মাত্রাকে ভিন্ন খাতে নিয়েছে। এসব ঘটনাই কিন্তু আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। গাড়িতে অগ্নি সংযোগের সময় পেট্রোলবোমাসসহ ধরা পড়ছে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এরই ধারাবাহিকতায় বিএনপি ও দলটির সঙ্গে যুক্ত আন্দোলনে থাকা দলগুলোর ডাকা ৪৮ ঘণ্টার হরতালের আগের রাতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট ঠেকাতে ও অস্থিরতা সৃষ্টি করতে রাজধানীর গোপীভাগে ৫ জানুয়ারি রাতে বেনাপোল এক্সপেস ট্রেনে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এই ঘটনায় দুই শিশুসহ চারজন নিহত এবং ৩০ জনেরও অধিক আহত ও দগ্ধ হয়েছে।
বিএনপির আন্দোলন চলাকালে এর আগে গত ১৯ ডিসেম্বর ভোরে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে চলন্ত অবস্থায় আগুনে মা-সন্তানসহ চারজন নিহত হয়। এর আগে ১৩ ডিসেম্বর গাজীপুরের শ্রীপুরে কাটা রেললাইনে লাইনচ্যুত হয়ে একজন নিহত হয়। কক্সবাজারের রামুতে অবস্থিত ইউ চিট সান (রাখাইন) বৌদ্ধ মন্দিরের মূল অংশে ৬ জানুয়ারি রাতে দুর্বৃত্তরা আগুন দেওয়ায় পুড়ে গেছে মন্দিরের কাঠের সিঁড়ি। এই ঘটনাগুলো বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সহিংস রাজনীতির কদর্য রূপ আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। নির্বাচনকে ভণ্ডুল করতে হরতাল-অবরোধের নামে যাত্রীবাহী বাস-ট্রাকে অগ্নিসংযোগ, বাস হেলপারদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা, রেললাইন উপড়ে ফেলা এবং ট্রেনের বগিতে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপের মতো নাশকতা সৃষ্টিকারী ঘটনা ঘটেছে।
সিআরআই এর হিসেব অনুযায়ী, এসব নাশকতায় দৈনিক ক্ষতির পরিমাণ ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি। ২০১৩-১৫ সালেও একইভাবে ব্যাপক নাশকতা হয় বিএনপি-জামায়াতের কর্মসূচির মধ্যে। তাদের অগ্নি সন্ত্রাসের কারণে পুড়ে মারা যায় শত শত মানুষ। চলমান আন্দোলনের প্রক্রিয়ায়ও একইভাবে পূর্বের মতো জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করার পাশাপাশি জনদুর্ভোগও বাড়িয়েছে। এতে সাধারণ জনগণের মনে ভীতি জন্মেছে। মানুষকে আতঙ্কিত করে কোনো রাজনৈতিক দলেরই এমন কোনো কর্মসূচি দেওয়া উচিত নয়। যারা হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচির মাধ্যমে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করছেন তাদের কৌশলের অভাব রয়েছে। কোনো রাজনৈতিক দলের আহ্বানে যখন জনগণ সাড়া দেয় না তখন বুঝতে হবে ওই রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিকে জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নাশকতা ও সহিংসার আশ্রয় নিলে রাজনৈতিক অঙ্গনে দেউলিয়াপনার পরিচয় মেলে। দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণের জন্য রাজনীতির নামে অপরাজনীতির পথ রুদ্ধ করে দিতে হবে। কোনো আন্দোলন কর্মসূচিই যাতে জনগণের অধিকার ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি না হয়ে দাঁড়ায় এর দায়িত্ব আন্দোলনকারী রাজনেতিক দলের নীতিনির্ধারকদেরই নিতে হবে। সহিংসতা কিংবা নাশকতা নয়, বরং অহিংসাই হোক রাজনীতিকদের মূল চেতনা। তাই দেশ ও জাতির কথা ভেবে সহিংস রাজনৈতিক পথ পরিহার করতে হবে। জনগণের বা রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনষ্ট করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের মতো কদর্যতা আধুনিক কল্যাণকামী রাষ্ট্রে কোনাভাবেই কাম্য হতে পারে না। অন্যের কাঁধে ভর দিয়ে চলার চিন্তা বাদ দিতে হবে। দেশের জনগণের ওপর ভরসা রেখে, তাদের আস্থা অর্জন করে রাজনীতি করতে হবে। ক্ষমতায় যেতে হলে এ দেশের জনগণের কাছে যেতে হবে। দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে কর্মসূচি দিতে হবে। নাশকতা ও সহিংসতার রাজনীতি পরিহার করে দেশের জনগণের বৃহত্তর কল্যাণ সাধনে রাজনীতি করা উচিত। রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে আড়ালে পরিকল্পনা করে সংঘাতের পথ বেছে নিলে দলটি সাধারণ জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্যতা হারায়। তাই নাশকতা ও সহিংসতার পথ পরিহার করে দেশ ও জনগণের কল্যাণে মনোনিবেশ করে রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করলে দেশ ও জাতি এগিয়ে যাবে এবং দেশের উন্নয়ন ও জাতির সমৃদ্ধির পথ সম্প্রসারিত হবে।
রাজনীতি হতে হবে কল্যাণমুখী ও জনবান্ধব। জ¦ালাও-পোড়াও এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষ কখনোই ভালো চোখে দেখে না। সরকারের ভালো কাজের সমর্থনের মানসিকতা রাজনীতিবিদদের মধ্যে থাকতে হবে। রাজপথ বন্ধ করে নয়, বরং রাজপথ উন্মুক্ত রেখেই রাজনীতিবিদদের গঠনমূলক রাজনীতি করতে হবে। রাজনীতিকদের সর্বোচ্চ সহনশীলতার পরিচয় দিতে হবে। জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে সর্বগ্রহণযোগ্য কর্মসূচি দিতে হবে। সাধারণ জনগণ এখন স্থিতিশীল রাজনীতিতে বিশ^াসী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুদক্ষ নেতৃত্বে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে স্বপ্ন আমরা দেখছি, তখনই তা বাস্তবে রূপ নেবে, যখন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা একটি স্থিতিশীল কাঠামোর ওপর দাঁড়াতে পারবে। রাজপথে অস্থিরতা সৃষ্টি করে শিক্ষা, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ রাষ্ট্রের জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করার অপকৌশলে সাধারণ জনগণ বিশ^াসী নয়। একের পর এক সহিংস পরিস্থিতির জন্য ক্রমেই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে দলটি। আন্দালনের নামে মানুষ হত্যাকে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোও ভালো চোখে দেখছে না। যারা এই নাশকতা করেছে তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। এমন ঘটনা অমানবিক ও নৃশংস। নাশকতা ও সহিংসতায় আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারা কখনোই আন্দোলনের ভাষা হতে পারে না।
বিএনপি ও সমমনাদের এই আন্দোলনে সহিংসতা ছাড়া নতুন কিছু না থাকায় জনপ্রিয়তাও শূন্যের কোঠায় গিয়ে ঠেকেছে। রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করা হলেও কোনো নেতাকর্মী কিন্তু মাঠে নামছেন না। প্রতিবার নির্বাচনের আগে বিএনপির জ¦ালাও-পোড়াও বন্ধে তরুণদের প্রথম ভোট মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি নৌকা প্রতীককে বেছে নিতে আমরা প্রত্যক্ষ করি। এবারের নির্বাচনেও আমরা প্রত্যক্ষ করি, বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর ভোট বন্ধের বহুবিধ ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে সকল শ্রেণি, পেশা, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট প্রদানের মধ্য দিয়ে যোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচিত করেছে। জনগণ তাদের ভোটের মাধ্যমে রায় দিয়ে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক নৌকা প্রতীককে বিজয়ী করে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের ম্যান্ডেট দিয়েছে। এই ভোট প্রদানের মাধ্যমে সাধারণ জনগণ নাশকতা ও সহিংসতার বিরুদ্ধে লাল কার্ড দেখিয়েছে।
উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে সরকারের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য বিরোধী দলগুলো ছায়া সরকার গঠন করে। সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে তারা প্রংশসা করে এবং সরকার কোনো কাজে ভুল সিদ্ধান্ত নিলে সেটি কীভাবে করা গেলে ভালো হতো সেই পথের সুপারিশ করে। কিন্তু আমাদের দেশে ঘটে ঠিক উল্টোটি। সরকার যতই ভালো কাজ করুক না কেন, সেগুলোকে কতটা ছোট করে দেখানো যায় তার একটি প্রতিযোগিতা আমরা লক্ষ করি। এর সঙ্গে গুজব, অপপ্রচার ও মিথ্যাচারের মতো নেতিবাচক বিষয়গুলোতো থাকেই। যারা এই ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে তাদের শিগগিরই খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে হবে। এমন ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেজন্য যথোপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
লেখক: শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়