ছায়াসঙ্গ

প্রণব মজুমদার »

কে ওখানে ? এই কে ওখানে ? জোসনা ভরা রাত। একটি যুবকের ছায়া মনে হলো ! উঁকি দিচ্ছিলো সে ছায়া। বেশ কয়েকবার। যেই ছায়াটি ভালো মতো পরখ করতে যায় স্নিগ্ধা তা মুহূর্তেই যেন মিলিয়ে যায়!
অস্ফুট স্বরে স্নিগ্ধা কে কে বলে ওঠে! দুরু দুরু বক্ষ। ঋজু বুক ওর নিঃশ্বাসে দ্রুত ওঠানামা করে। ভয়ে গাছের নিচে বসা সবুজের হাত চেপে ধরে! চাঁদের ঝকঝকে সাদা জোছনায় ভয়ার্ত স্নিগ্ধার চোখ দুটো লক্ষ্য করে সবুজ। দু’হাতে ওর গালে ধরে স্নিগ্ধার ঘন লম্বা চুলের বেনী শোভিত মাথাটা। তারপর ওর বুকে চেপে ধরে ! নব পরিণীতা স্ত্রীর প্রতি সবুজের জিজ্ঞাসা-
– ভয় পাইছো বেশি ? ছায়া দেইখ্যা ভয় পাইলে চলবো ? একটা জিনিস খেয়াল করলাম ! বেশ কিছুদিন ধইরা দেখি তুমি অন্যমনস্ক ! এর আগেও বাসায় ছায়া দেইখ্যা আতকাইয়া উঠছো ! সবুজের কথার কোন উত্তর দেয় না স্নিগ্ধা। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে মরা ধলেশ^রী নদীর দিকে। শরতের বাউরি বাতাস বইছে। চকচকে হলুদ কালোর কামিজ পড়া ও। গলায় মালার মতো পেঁচানো স্নিগ্ধার ওড়নাটা উড়ে যাচ্ছিলো। সিল্কের তৈরি ওড়নাটা মুহূর্তেই ধরে ফেলে সবুজ। পরিয়ে দেয় স্নিগ্ধাকে। একি ! জীবনসঙ্গী স্নিগ্ধার চোখে পানি। গাল ভিজে গেছে। আশ্চর্যন্বিত সবুজ এর কারণ জানতে চায় স্নিগ্ধার কাছে।
– কী ব্যাপার বলতো ?
ছায়া আতংক এবং কান্না মেলাতে পারে না সবুজ। স্নিগ্ধা ও সবুজের দাম্পত্য জীবনের বয়স সামনের ১৫ নভেম্বরে দু’ বছর পূর্ণ হবে। স্নিগ্ধার জীবনে এ পর্যন্ত এসেছে দুই পুরুষ। একজন সবুজ আরেকজন নিলয়। সবুজ বিয়ের পরে নিলয় আগে। প্রায় দু’ বছরের সংসারে স্বামীরূপে সবুজকে পেয়ে স্নিগ্ধা তৃপ্ত নয়। নিলয়কে না পেয়ে স্নিগ্ধার জীবনে অতৃপ্তি থেকে গেছে। জীবন থেকে মুছে ফেলতে পারছে না তাকে। নিলয়ের ছায়া তাকে সারাক্ষণ ধিরে রাখে। তার অকাল মৃত্যু কোন ভাবেই মেনে নিতে পারে না স্নিগ্ধা। বেদনার জ¦ালা আর অতৃপ্তির হতাশা তাকে কুরে কুরে খায়। নিলয়ের ছায়া সে প্রায়ই দেখতে পায়। যাপিত জীবনে এখন স্নিগ্ধার ছায়াসঙ্গ নিলয়।
নিলয়ের মতো অটবীর বাউরি জোসনা প্রিয় দু’জনেরই। ধলেশ্বরী নদীর পাড়ে গহীন কাঁশবনের এ মুগ্ধতায় ভরপুর সবুজও। স্নিগ্ধারও জায়গাটা বেশ চেনা। তা বাড়ির কাছেই। পায়ে হাটা পথ। নিকট অতীতের দুঃখময় স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই কাঁশবনে। সে কাহিনী তা জানে না শুধু সবুজ ।
ঘন সবুজ পত্রালীর কাঁশবনের পাশেই সিংগাইর বায়রা গ্রাম। স্নিগ্ধার বাপের বাড়ী। শ^শুর বাড়ী মানিকগঞ্জের গড়পাড়া। মানিকগঞ্জ শহরে ছোট্ট বাসায় ওরা থাকে। শহর উপকণ্ঠে বেসরকারি উন্নয়নমূলক একটি প্রতিষ্ঠানে ঋণ কর্মকর্তা সবুজ। ওর মতো দেবেন্দ্র সরকারি কলেজে স্নিগ্ধাও পড়েছে। তবে স্নাতক পাশ আর সম্ভব হয়নি নিলয় দুর্ঘটনার পর। একই গ্রামের গরিব ছেলে নিলয়। বয়সে স্নিগ্ধার চেয়ে ৪ বছরের বড়। অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালে সম্পর্ক। তখন উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী নিলয়। ভালো বাঁশি বাজাতো। গ্রামে থাকলে কাশবনের এ জায়গাটাতে দু’জন এসে বসতো। স্নিগ্ধা নিলয়ের কাছে এখানেও বাঁশির সুরে লালন ও পল্লী গীতি শুনেছে। ভাবীকে নিয়ে জোসনা রাতে কাশবনে স্নিগ্ধা নিলয়ের দেখা করতে এসেছিলো একাধিকবার। ভাবী রাজী থাকলেও পরিবারের একমাত্র শিক্ষিত বেকার ছেলে নিলয়ের কাছে জোতদার পিতা নসু মিয়া স্নিগ্ধাকে বিয়ে দেননি। কঠিন যক্কৃত রোগে শয্যাশায়ী মা আমেনার প্রতিশ্রুত কথা রাখতে গিয়ে সবুজের সঙ্গে বিয়েতে মত দেয় স্নিগ্ধা। স্নিগ্ধার বিয়ের সংবাদ যেদিন নিলয় জানতে পারে সেদিন ছিলো শরতকালের রাত। ছিলো নিলয়ের জীবনের শেষ জোসনা। পরদিন ভোরে বাড়ীর অদূরে কাশবনের একটি আম গাছের ডালে নিলয়ের নির্জীব দেহ ঝুলতে দেখা যায়। অনাকাংখিত অপমৃত্যুর খবরে স্নিগ্ধা তিনদিন স¦াভাবিক ছিলো না। নিলয়ে থাকার স্বাদ অপূর্ণ থেকে যায় স্নিগ্ধার। বাইশ বছরের আয়েশা আখতার স্নিগ্ধা মেনে নিতে পারেনি মাহফুজুর রহমান নিলয়ের স্বেচ্ছাবসান।
কাশবনে এ সময় অনেকেই শরত রাত্রির জোসনা দেখতে আসে। ডানে বামে বাঁক নেয়া ধলেশে^রীর নদীর এ অংশটি খুব শান্ত । নদীর দু’ প্রান্তে নানা ঘন সবুজ গাছের সজীব প্রকৃতি। সবুজ ছুটিতে শ^শ^রবাড়ি বেড়াতে এসেছে। বিছানায় শয্যাশায়ী অসুস্থ মাকে দেখতে স্নিগ্ধা অনেকদিন ধরে বাপের বাড়ীতে।
যে জারুল গাছের নিচে ওরা বসে আছে তার কাছেই নিলয় প্রাণসংহারী সেই আম গাছ। স্নিগ্ধা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সেই স্মৃতিময় গাছের ডালটা। মনে হলো নিলয় ডাল থেকে স্নিগ্ধাকে ডাকছে। নেমে আসছে নিলয়। হাতে বাঁশী। বাতাসে জারুল গাছের ডালপালা আবার দোলে ওঠে। মাটিতে বিছানো জোছনায় এর ছায়া আবার দেখতে পায় সে! স্নিগ্ধার মনে হলো এ যেন নিছক ছায়া নয়। হেঁটে আসছে নিলয়। ওর ছায়া পড়েছে বালুতে। চিৎকার করে ওঠে স্নিগ্ধা। চোখ বুজে সবুজকে জাপটে ধরে বলে –
– ওই দেখো যুবকটা আবার আসছে। আমাদের নিয়ে যাবে আকাশে। চাঁদের কাছে।