এ টি এম মোসলেহ উদ্দিন জাবেদ »
সম্প্রতি প্রথমবারের মতো চীনের উদ্যোগে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অষ্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আসিয়ান ভুক্ত ১০টি দেশকে অন্তর্ভুক্ত করে ‘রিজিওনাল কমপ্রিহেন্সিভ ইকোনোমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি) নামক একটি বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করা হয়েছে। এসব দেশে বিশে^র প্রায় ৩০% জনসংখ্যার বসবাস। যাদের সম্মিলিত জিডিপির পরিমান প্রায় ২৬ ট্রিলিয়ন ইউএস ডলার। মোট বিশ^বাণিজ্যের প্রায় ২৮ ভাগ এ অঞ্চলে সম্পাদিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ’ (টিপিপি) চুক্তি ছাড়ার পরে এই চুক্তি চীনকে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে নেতৃত্ব দেওয়ার নতুন সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। নিঃসন্দেহে এই সময়ে এই চুক্তি চীনের এই অঞ্চলে এবং বিশ^ব্যাপী বাণিজ্য ও বিনিয়োগের অংশীদারিত্বকে আরো শক্তিশালী করে তুলবে। যে কেউ সহজেই যুক্তি দিতে পারে যে, চীন এই অঞ্চলের উদীয়মান নেতৃত্বদানকারী দেশ এবং বাণিজ্য ও নিয়ম তৈরিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রাখে। তবে আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে এটি বিশ^ পরাশক্তি হওয়ার অন্যতম একটি পদক্ষেপ।
আরসিইপি এমন সময়ে করা হলো, যখন যুক্তরাষ্ট্র তাদের চীন বিরোধী নীতির অংশ হিসেবে জাপান, অষ্ট্রেলিয়া ও ভারতকে নিয়ে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলগত জোট গঠনের উদ্যোগ নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই জোটের অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দুই সদস্য দেশ জাপান ও অষ্ট্রেলিয়া আরসিইপি তে যুক্ত হয়েছে। বৈশি^ক করোনা মহামারি মোকাবেলায়ও তারা অনেকটা সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। যুক্তরাজ্যের সাবেক অর্থমন্ত্রী জিম ও’নিল সম্প্রতি তার এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, চীনের সঙ্গে বিরোধের নীতি হবে আত্মঘাতী। গত অক্টোবরে ভালদাই ডিসকাশন ক্লাবের একটি বৈঠকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন বলেছেন, এখন চীন ও জার্মানি পরাশক্তি হওয়ার পথে এগুচ্ছে। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনে ক্ষমতার পালাবদল নিশ্চিত হয়ে গেছে। সবকিছু মিলে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলগত জোটের ভবিষৎ কোন দিকে গড়াবে? সময়ই তা বলে দেবে।
চীন অনন্য সংস্কৃতি এবং ইতিহাস সমৃদ্ধ একটি দেশ, যার ঐতিহ্য পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি। আমরা অনেকেই জানি যে চীন একটি দুর্দান্ত আবিষ্কারক দেশ যেমন- কাগজ, প্রিন্টিং, প্রেস, গান পাউডার, কম্পাস, সিল্ক, যানবাহন এবং আরও অনেক কিছু। আধুনিক সভ্যতার আগে চীনারা বিশ^াস করত যে চীন বিশে^র কেন্দ্রে অবস্থিত এবং সতেরো শতকের গোড়ার দিকে বিশ^ব্যাপী আধিপত্য হারাবার আগে বহু শতাব্দী ধরে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো। চীন যে কেবল অতিরিক্ত- সাধারণ অর্থনৈতিক সক্ষমতা দেখিয়েছে তা নয়, গত দুই দশকে বিশ^জুড়ে তার রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রভাব ব্যাপক প্রসারিত করেছে।
চীনকে এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে পশ্চিমা সুপার পাওয়ারদের দ্বারা ন্যূনোত্বির শিকার হতে হয়েছিল এবং এর জিডিপি ১৮৪০ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত বিশে^র মোট এক তৃতীয়াংশ থেকে বিংশতম হয়ে পড়েছিল। গণপ্রজাতন্ত্রী চীন ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং প্রভাবশালী নেতা মাও সেতুংয়ের অধীনে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিসিপি) গ্রহণ করেছিলো অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ। দেশটি এই সময়কালে প্রচুর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি লাভ করেছিল। তবে কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক অদক্ষতা অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসরমান একটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের উত্থানের প্রকৃত সম্ভাবনার পথে কিছুটা অন্তরায় ছিল মাও সেতুং এবং চৌ এনলাইয়ের মৃত্যুর পরে স্বল্পস্থায়ী এক শক্তি সংগ্রামের ফলস্বরূপ ১৯৭৮ সালে দেঙ জিয়াওপিংয়ের ক্ষমতায় আরোহণের সুযোগ হয়েছিল।
বর্তমানে আমরা যে চীন নিয়ে আলোচনা করছি তাহলো দেঙ জিয়াওপিংয়ের ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ এর চূড়ান্ত স্বপ্ন। ১৯৭৯ সালে ‘ওপেন ডোর’ নীতি হিসাবে পরিচিত অর্থনৈতিক সংস্কারের পর থেকে দেশে আমূল অর্থনৈতিক রূপান্তর হয়েছে এবং ধীরে ধীরে ‘ম্যানুফেকচারার অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড’ হয়েছে। এখন চীন শি জিনপিংয়ের ‘তৃতীয় বিপ্লব’ এর যুগে প্রবেশ করেছে যা পূর্বের বিপ্লব থেকে পৃথক, যার উদ্দেশ্য হিসাবে রয়েছে- তার ব্যক্তিগত নেতৃত্বে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের নাটকীয় কেন্দ্রীকরণ, রাষ্ট্র দ্বারা সমাজে তীব্র অনুপ্রবেশ, প্রবিধান এবং বিধিনিষেধের ভার্চুয়াল প্রাচীর তৈরির মাধ্যমে ভিন্নমতাদর্শের অনুপ্রবেশ না ঘটানো এবং সংস্কৃতি ও পুঁজিবাদের ব্যাপ্তিেেক আরও বেশি দৃঢ়ভাবে দেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে প্রচার ও প্রসার করা এবং চীনা শক্তির উল্লেখযোগ্য প্রক্ষেপণ।
ঘুমন্ত পান্ডা আবারও জেগে উঠেছে বিশ^কে কাঁপানোর জন্য। সিআইএ ফ্যাক্ট বুকের তথ্য অনুযায়ী চীন ইতিমধ্যে জিডিপি ক্রয় ক্ষমতা প্যারিটির দিক থেকে বৃহত্তম অর্থনীতি। ১.৩ বিলিয়ন জনসংখ্যার দেশটি আগামী ৩০ বছরের মধ্যে বিশ^ ব্যবস্থা পরিবর্তন করার অপেক্ষায় রয়েছে, যখন ২০৪৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ১০০তম বার্ষিকী উদযাপন করবে। চীন বিশেষজ্ঞ মাইকেল পিলসবারির মতে, পশ্চিমাদের থেকে বিশ^মোড়লিপনা দখল করতে চীন ১৯৪৯ সালে একশ বছরের এক দীর্ঘ ম্যারাথন জার্নি শুরু করেছিলো। চীন কেবল অর্থনৈতিক সুপার পাওয়ার হিসাবেই নয়, বিশ^ব্যাপী রাজনৈতিক চেঞ্জ মেকারের ভূমিকায় অবর্তীর্ণ হওয়ার পথে রয়েছে।
চীন সাম্প্রতিক অতীতে এক বিশাল অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সেই উদ্যোগগুলির মধ্যে একটি হলো পুরনো সিল্ক রুটকে পুনরুদ্ধার করা, একসময়কার পশ্চিমের সাথে পূর্বের সাথে সংযোগ স্থাপনকারী একটি প্রধান বাণিজ্যিক রুট। চীন তার অর্থনৈতিক ভূ-রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের জন্য এবং পশ্চিমা আধিপত্যের বিপরীতে ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ (সাধারণত বিআরআই নামে পরিচিত) উদ্যোগ গড়ে তুলেছে। চীন এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ইউটিলিটি, টেলিযোগাযোগ, বন্দর নির্মাণ ও পরিবহনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ব্যাপক বিনিয়োগ করে আসছে। এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে চীন বিশ^ ব্যাংকের বিকল্প হিসাবে ইতিমধ্যে ‘এশিয়ান অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করেছে। ব্যাংকের বর্তমানে বিশ^জুড়ে সদস্য সংখ্যা ৭৪, সদস্যের পাশাপাশি সম্ভাব্য সদস্য রয়েছে ২৬। পূর্বে অন্তর্ভুক্ত চারটি মুদ্রা- মার্কিন ডলার, ইউরো, জাপানি ইয়েন এবং ব্রিটিশ পাউন্ডের পাশাপাশি ঝঢ়বপরধষ উৎধরিহম জরমযঃং (এসডিআর) এর ঝুড়িতে যখন চীনা আরএমবি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল তখনই বিশ^ব্যাপী অর্থনৈতিক শক্তি হিসাবে চীনের পুনরুত্থান নিশ্চিত হয়।
চীন মহাদেশ জুড়ে তার সামরিক শক্তি প্রয়োগ থেকে খুব বেশি দূরে নয়। চীন তার সক্ষমতায় আলপিন থেকে প্নেন, উপগ্রহ এবং সকল প্রকার পণ্যের বৈশি^ক উৎপাদনের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। চীন ইতিমধ্যে জিবুতিতে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে, পাশাপাশি আফগানিস্তান, কম্বোডিয়া এবং তাজিকিস্তানে অঘোষিত সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে। মহাদেশজুড়ে এই ক্রমবর্ধমান সামরিক উপস্থিতি কেবল সামরিক শক্তি দেখানোর জন্যই নয়, এইসব অঞ্চলে থাকা বিশাল চীনা বিনিয়োগকে রক্ষা করার জন্যও বটে।
ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চীন সাম্প্রতিক অতীতে উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়েছে। দেশটি রাশিয়া, পাকিস্তান, ইরান এবং অনেক আফ্রিকান ও এশীয় দেশের সাথে দৃঢ় ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। চীন দক্ষিণ-চীন সমুদ্র বিরোধ নিস্পত্তিতে আঞ্চলিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। ইউরেশিয়ান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সুরক্ষা জোট তথা সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (এসসিও) বা ‘সাংহাই চুক্তি’ তে রাশিয়া ও চীন নেতৃত্ব দিয়েছিলো। আমরা হয়তো অদূর ভবিষ্যতে পর্যায়ক্রমিকভাবে ‘ওয়াশিংটন ঐকমত্য’ থেকে ‘বেইজিং ঐকমত্য’ রূপান্তর দেখতে চলেছি। ‘বেইজিং ঐকমত্য’- আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চীনা দৃষ্টিভঙ্গি, অন্যদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ নয়, সামরিক হস্তক্ষেপ মুক্ত, বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার ফলে উন্নয়নশীল বিশ^কে অন্যান্য দেশের সাথে সম্পর্ক বাড়ানোর বাস্তব বিকল্প সরবরাহ করে।
ঐতিহ্যগতভাবে চীনাদের শক্তিশালী ‘এশিয়ান মূল্যবোধ’ নিয়ে রক্ষণশীল এবং দীর্ঘ সংস্কৃতি ও ঐতিহাসিক ধারা রয়েছে। পূর্ব ও বর্তমান বৈশি^ক পরাশক্তি তথা ব্রিটিশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো চীনও কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে বিশ^জুড়ে তাদের ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র ছড়িয়ে দিতে শুরু করেছে। তবে সংস্থাটি যে দেশগুলিতে কাজ করে সেখানে চীনা প্রভাব বাড়ানোর কারণে তীব্রভাবে সমালোচিত হয়েছিলো।
চায়না বিজনেস কর্পোরেশন, চায়না মোবাইল, টেনসেন্ট হোল্ডিংস, আ্যান্ট গ্রুপ, আলিবাবা, বাইডু ইনকর্পোরেটেড, হুয়াওয়ে, লেনোভো এবং আইসিবিসি (ইন্ডাষ্ট্রিয়াল এন্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অফ চায়না) বিশ^ব্যাপী ব্যবসার অন্যতম ল্যান্ডস্কেপ হয়ে উঠছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে নিজ দেশে এবং বিশ^জুড়ে চীনা নির্মাতাদের ক্রমবর্ধমান আধিপত্য উপলব্ধি করছে। এটা স্পষ্ট যে, চীন ধীরে ধীরে উন্মুক্ত হচ্ছে এবং পশ্চিমাদের পাশাপশি সমানতালে বিশ^ব্যাপী অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শন করতে শুরু করেছে। আরসিইপি হলো নিকট ভবিষ্যতে চীনের বিশ^ পরাশক্তি হওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম একটি পদক্ষেপ।
লেখক : কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক