শঙ্কর প্রসাদ দে »
ছিয়ানব্বই লক্ষ বর্গ কিলোমিটারের বিশাল ভূ-খ-। পৃথিবীর তৃতীয় বা চতুর্থ বৃহত্তম জনপদের নাম চীন। বিংশ শতকে গোটা পৃথিবীর ভূ-রাজনৈতিক সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা দেশটি, একবিংশ শতকে এসে এক কথায় অগ্রগতির চমক। মনে হচ্ছে আগামী দিনগুলোতে অগ্রগতির কোন শাখাতেই চীনকে বাদ দিয়ে ভাববার অবকাশ থাকবে না।
প্রাচীন এই জনপদের শেষ রাজকীয় ‘কিং’ রাজবংশের সময়কাল ১৬৪৪ থেকে ১৯১১। ১২ মার্চ ১৯১২ সালে সমরকর্তা ইউয়ান সিকাইয়ের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তবর্তীকালীন সরকার। কিন্তু দেশটি নিমজ্জিত হয় বহুমুখী রাজনৈতিক সংকটে। জাপান এই সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজী ছিল না। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট আর জাপানের ঔপনিবেশিক আক্রমণ দেশটিকে নিয়ে গেল দারিদ্র্যের তলানিতে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সিকাই ১৯১৫ সালে নিজেকে স¤্রাট ঘোষণা দিলে শুরু হয় বহুমুখী প্রতিবাদ। সিকাই ক্ষমতাচ্যুত হন ১৯১৬ সালে।
জাপানের কারণে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বিস্তৃত হল ইন্দোচীনের বিস্তীর্ণ এলাকায়। জাপানের পরাজয়ে মিত্রশক্তির লোলুপ দৃষ্টি পড়ল চীনের উপর। এদিকে লেনিন প্রতিবেশী রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করার ফলে চীনের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব ঘুরে গেল ১৮০ ডিগ্রীতে। লেনিন মন্তব্য করেছিলেন, অবমাননাকর ভার্সাইচুক্তি আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ ডেকে আনবে। মিত্রশক্তি জার্মান ও জাপান, চীনের বন্দরগুলো বিনাশুল্কে ব্যবহারের কর্তৃত্ব অর্জন করে। চীনকে ভার্সাই চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করার অপ্রকাশ্য লক্ষ্য ছিল চীনের বিশাল কয়লা ভা-ার। লেনিনের দ্বিতীয় মন্তব্য ছিল চীনের কয়লা খনিকে ঘিরে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ অনিবার্য।
ভার্সাই চুক্তিকে প্রথম চ্যালেঞ্জ জানালো মধ্যপন্থী সান ইয়াৎ সেনের কুওমিন তাং বা নাগরিক দল ও বামপন্থিরা। লেনিনের রাশিয়া চীনা জাতীয়তাবাদীদের পাশে দাঁড়ালো। ১৯২০ সালে সান ইয়াৎ সেন ও বামপন্থিদের রাজনৈতিক মৈত্রী স্থাপিত হয়। সান ইয়াৎ সেনের নেতৃত্বে গৃহযুদ্ধ ও সা¤্রাজ্যবাদী আগ্রাসন থেকে উদ্ধারের চেষ্টা চালানো হয়। লেনিন গ্রিগোরি ভইতিনোস্কিকে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার দায়িত্ব দিয়ে চীনে প্রেরণ করেন। দীর্ঘ ২ বৎসরের রাজনৈতিক প্রস্তুতি শেষে ১লা জুলাই ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়না। ১লা জুলাই ২০২১ স্মরণাতীত কালের জাকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালিত হলো দলটির শতবর্ষপূর্তি।
১৯২৫ সালে সান ইয়াৎ সেনের মৃত্যুতে নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। রিপাবলিকান নেতা চিয়াং কাই সেং এর সাথে কমিউনিস্ট নেতা মাও সে তুং ’র মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির ভিত্তিতে রিপাবলিকানরা ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং ১৯২৮ সালে চীনকে রিপাবলিক বা প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়। ১৯৩১ সালে জাপান চীন আক্রমণ করলে পরিস্থিতি গৃহযুদ্ধকালীন অবস্থা থেকেও শোচনীয় হয়ে উঠে। হিটলারের জার্মানি প্রথম ইউরোপ ও রাশিয়ার দিকে হাত সম্প্রসারণ করে। জাপান প্রথমে চীনে থাবা বসায়। অতঃপর গোটা ইন্দোচীন, কোরিয়া উপদ্বীপ ও বার্মায় আক্রমণ চালিয়ে অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে জাপান বিমান হামলা চালায় আমেরিকান নৌ ঘাটি পার্ল হারবারে।
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। এবার মাও সে তুং সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহের সিদ্ধান্ত নিয়ে কৌশল সাজালেন। নাগরিক দল তথা কুওমিনতাং এর সরকারি বাহিনী বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করে। গেরিলারা দূর গ্রামাঞ্চলের প্রত্যন্ত বনভূমিতে প্রতিরক্ষাব্যূহ ও কেন্দ্রীয় অবস্থান নিয়ে শুরু করে অগ্রাভিযান। ততোদিনে কৃষকরা বুঝে গেছেন ভূ-স্বামীদের কাছ থেকে অস্ত্রের জোরেই জমি কেড়ে নিতে হবে। একের পর এক গ্রাম বিপ্লবী কৃষকদের হাতে পতন হচ্ছিল আর বিপ্লবীরা এগিয়ে চলছিল পিকিং অভিমুখে। এই সশস্ত্র অভিযানের শেষ পরিণতি হলো, কমরেড মাও সে তুং’র পিকিং দখল ১৯৪৯ সালের ১লা অক্টোবর। চীনকে পিপলস্ রিপাবলিক ঘোষণা করা হল। এটিই ইতিহাসখ্যাত চীনা কৃষক বিপ্লব। পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে এখনো চীনপন্থি বিপ্লবীরা সক্রিয় আছেন এবং তারা মনে করেন বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস। সশস্ত্র বিপ্লব ছাড়া সমাজতন্ত্র কায়েম সম্ভব নয়। যদিও আজকের চীনা নেতৃত্ব ঐ কৌশল পরিত্যাগ করেছেন মর্মে গণ্য করা হয়।
চীন বিপ্লবে প্রতিবেশী এবং বিশ্বশক্তি স্ট্যালিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন দাঁড়িয়ে গেল অতন্দ্র প্রহরীর মতো। কুওমিনতাং মূল ভূ-খ- থেকে বিতাড়িত হয়ে তাইওয়ানে আশ্রয় নিয়ে মার্কিন সমর্থনপুষ্ট জাতীয়তাবাদী তথা রিপাবলিকান সরকার চালিয়ে যেতে থাকল। ১৯৭১ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্যপদ লাভ করে। অন্যদিকে ৩৫৮০৮ বর্গকিলোমিটারের ২ কোটি ৩০ লক্ষ জনসংখ্যা অধ্যুষিত তিনটি দ্বীপ নিয়ে গঠিত তাইওয়ান একটি পুঁজিবাদী শক্তিশালী অর্থনীতিসমৃদ্ধ রাষ্ট্র।
১৯৬০ সালে পৃথিবীব্যাপী সমাজ বিপ্লবের কৌশল নিয়ে বামপন্থিরা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব তথা নিয়মতান্ত্রিক পথে সমাজবিপ্লবের তত্ত্ব হাজির করেন ক্রুশ্চেভ। তাঁর উত্তরসুরীরা ১৯৯০ সালে পতন পর্যন্ত এই পথেই অগ্রসরমান ছিলেন। ক্রুশ্চেভের বক্তব্যের বিরোধিতা করে মাও সে তুং সনাতনী পথেই অগ্রসর হলেন। এর একধাপ পরবর্তী পদক্ষেপ হলো চীনের ইতিহাসখ্যাত সাংস্কৃতিক বিপ্লব। শেষ জীবনে মাও’র এই সিদ্ধান্তটি চীনে মানবিক বিপর্যয় ডেকে এনেছিল। ক্ষুধা, অপুষ্টি ও সরকারি নির্যাতনে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু আজো দু:সহ স্মৃতি।
১৯৭৬ সালে মাও সে তুং এর মৃত্যু গোটা চীন সমাজব্যবস্থাকেই গোড়া থেকে নাড়া দিয়েছে প্রচ- ঝাঁকুনিতে। সামনে আসলেন দেং জিয়াও পিং। তিনি মার্কসীয় মূলনীতি পরিবর্তনের তত্ত্ব হাজির করে বললেন, ব্যক্তি উদ্যোগকে উস্কে দিতে হবে। রাষ্ট্রের সম্পত্তির প্রতি মানুষের উৎসাহ খুব বেশি থাকে না। কমিউন অর্থাৎ সমবায় থেকে জমিগুলো ফেরৎ দেয়া হল কৃষকের নিকট। যে কোন ব্যক্তি উদ্যোগকে স্বাগত জানানো হল। ব্যক্তি সঞ্চয়কে উৎসাহ দেয়া হল। ছোট এবং মাঝারি শিল্প করতে চাইলেই নামমাত্র সুদে দেদারসে ঋণ দেয়া শুরু হল। পৃথিবীর এমন কোন দেশ নেই যেখানে চীনা পুতুল, বৈদ্যুতিক সামগ্রী, স্বল্পমূল্যের ইলেকট্রনিক্স পণ্যের চাহিদা নেই। ১৯৭৮ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত দেং জিয়াও পিং ছিলেন চীনের অঘোষিত নেতা। রাষ্ট্র বা দলে তিনি কর্তৃত্বমূলক কোন পদে না থেকেও চীনকে ধাবিত করেছেন চীনা পদ্ধতির সমাজতন্ত্রের দিকে।
চীনা পদ্ধতির সমাজতন্ত্র কিছু মৌলিক বিষয় সামনে এনেছে। দেং জিয়াও পিং যে অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু করেছিলেন তার ঢেউ সোভিয়েত ইউনিয়নেও লেগেছিল। গর্বাচেভের পেরেস্ত্রাইকার আভিধানিক অর্থ হলো অথনৈতিক উদারনীতি। ১৯৮৭ সালে এ নীতি দ্রুত সোভিয়েত ইউনিয়নকে পতনের দিকে ধাবিত করে। প্রশ্ন হলো দেং জিয়াও পিং ১৯৭৮ সালে চীনে যা চালু করেছিলেন তা চীনকে আরো সংহত করল অথচ ১৯৮৭ সালে একই সংস্কার গর্বাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নে চালু করার পর ০৪ (চার) বছরের ব্যবধানে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থারই পতন হলো কেন? হ্যাঁ, উত্তরের ক্ষেত্র গভীর হলেও কঠিন নয়।
অর্থনীতির ভাবনায় দেং এবং গর্বাচেভ দু’জনই ব্যক্তি উদ্যোগ, ব্যক্তি সঞ্চয়, ব্যক্তি বিনিয়োগের পক্ষে ছিলেন। গর্বাচেভ বাড়তি যোগ করেছিলেন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ, রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ থেকে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব প্রত্যাহার। গর্বাচেভের গ্লাসনস্ত ছিল সা¤্রাজ্যবাদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার চূড়ান্ত মঞ্চায়ন।
চীন অর্থনীতিতে ব্যক্তির উপস্থিতি গ্রহণ করেছে কিন্তু রাষ্ট্রের ভূমিকাকে অস্বীকার করেনি। আজো রেল, বিমান, চিকিৎসা, মহাকাশ ও অবকাঠামোতে বিনিয়োগ সহ বহু ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বিনিয়োগ করে দেশ বিদেশে।
শি জিন পিং যোগ্য পিতার যোগ্য সন্তান। তার পিতা শি জোং সুনও ছিলেন নামকরা কমিউনিস্ট এবং কমরেড মাও সে তুং এর ঘনিষ্ঠ সহচর। দুই পুরুষ ধরে সমাজতন্ত্রকে জেনারেল সেক্রেটারি শি কাছ থেকে দেখেছেন। প্রেসিডেন্ট শি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো পরিচালনার পদ্ধতি দেখেছেন ষাটের দশকের শৈশবাস্থা থেকে। সামরিক বাহিনীর প্রধান হিসেবে শি যে দক্ষতা দেখাচ্ছেন, তা কল্পনাতীত।
বিংশ শতকে দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধ সংগঠনে চীনের কোন উদ্যোগ ছিল না। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর থেকে চীন আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে কোন দেশ আক্রমণ করেনি। কোরিয়া ও ভিয়েতনাম সংকটে চীন এগিয়ে না গেলে উত্তর কোরিয়া, ভিয়েতনাম, কম্পুচিয়া নামক কোন প্রগতিশীল দেশের অস্তিত্ব থাকতো না। চীন সমাজতন্ত্রের মূল কথা কমিউনিস্ট পার্টির কঠোর শাসন। এটা কতটুকু ভাল হচ্ছে তা ইতিহাস বিচার করবে। চীন রাষ্ট্রের ওপর কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়া হয়নি। গর্বাচেভ দিয়েছিলেন সমাজতন্ত্রকে ব্যর্থ করার জন্য। প্রেসিডেন্ট শি রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কঠোর, নিষ্ঠুর এবং আপোষহীন। এতো কঠোরতা কতটুকু বাস্তবসম্মত হচ্ছে তা এক বিরাট প্রশ্ন। একইভাবে পরপর দু’বার প্রেসিডেন্ট থাকার পর আবার তৃতীয় মেয়াদে প্রার্থী হবার সুযোগ এতো দিন ছিল না। সম্প্রতি কংগ্রেসে ২৯৬৪ ভোটে (বিপক্ষে ২ জন, বিরত ৩ জন) বিধানটি বাতিল করা হয়। শি’র মৃত্যু অবধি প্রেসিডেন্ট থাকার পথ সুগম হলো। এ রকম চূড়ান্ত ক্ষমতা গ্রহণ পৃথিবীর অভিজ্ঞতার আলোকে মোটেই সুখকর নয়। এখন দেখার বিষয়,একবিংশ শতকে পরাশক্তি চীন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের এই কৌশলকে কতটুকু হজম করতে পারে।
লেখক : আইনজীবী, হাইকোর্ট
ংঢ়ফবু২০১১@মসধরষ.পড়স