সকালবেলা এক কাপ চায়ের সাথে সংবাদপত্রে চোখ বুলানো বাঙালির নিত্য অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অফিস-আদালত কিংবা গণমাধ্যমের কর্মীদের ক্লান্তি-অবসাদ ঘুচাতে চায়ের জুড়ি নেই। রাজনীতি আলোচনা, শিল্প-সংস্কৃতির বৈঠক, আড্ডা-আপ্যায়ন সকল ক্ষেত্রেই চায়ের কদর। তবে এটাও সত্য, বাঙালিকে একদা চা-পানে অভ্যস্ত করাতে বিদেশি কোম্পানিদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিলো। বিনে পয়সায় চা খাওয়াতে গ্রামে-গঞ্জের হাট-বাজারে প্রচার প্রচারণাও ছিল আকর্ষণীয়।
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো জাতীয় চা-দিবস উদযাপনের প্রাক্কালে চা শিল্পের সুদিন ফিরে আসা নিয়ে উপরের ভূমিকা । গত ৪ জুন জাতীয়ভাবে চা দিবস উদযাপনে স্লোগান নির্ধারিত হয়েছে ‘মুজিব বর্ষের অঙ্গীকার, চা শিল্পের প্রসার’। ১৯৫৭ সনের ৪ জুন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চা-বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার দিনটি স্মরণে ঐদিনটিকে ‘জাতীয় চা দিবস’ ঘোষণা করা হয়েছে।
চা বোর্ডের তথ্যানুযায়ী ১৮৪০ সালে চট্টগ্রামে চা-চাষের গোড়াপত্তন হয় তবে ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনিছড়ায় প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ শুরু হয়। বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল, বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে ছোট পাহাড় বা টিলার পাদদেশে চায়ের চাষ হয়। এখন দেশের সমতল এলাকায় যেমন ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, লালমনির হাট, নীলফামারি জেলায়ও চাষ হচ্ছে চায়ের।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বিদেশিদের অনেকেই চায়ের ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ায় এই শিল্পের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। কিন্তু বর্তমানে সে পরিস্থিতি আর নেই, সরকার ও দেশীয় উদ্যোক্তাদের আগ্রহ ও প্রচেষ্টায় এই শিল্পে সংস্কার ও নবায়ন হওয়ায় চায়ের সুদিন ফিরে এসেছে। এখন অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে ১৯টি দেশে চা রপ্তানি হচ্ছে। রপ্তানি আয় ৩৫ কোটি টাকা। দেশে চায়ের ব্যবহারও বাড়ছে প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে। প্রতিদিন ১০ কোটি মানুষ চায়ের কাপে মুখ রাখে। পত্রিকান্তরে প্রকাশ গত ৫০ বছরে উৎপাদন বেড়েছে ৩ গুণ। ২০১৯ সালে সর্বোচ্চ ৯৬ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। দক্ষ কর্মী তৈরিতে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে, এই শিল্পে বিপুল সংখ্যক নারী শ্রমিক রয়েছেন। বর্তমান সরকার ২০১৭ সালে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী এই ৩ ধাপে পরিকল্পনা নিয়েছে। এই শিল্পের উন্নয়নে করোনাকালে উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। চা-শ্রমিকদের জন্যও আর্থিক প্রণোদনা ছিল। গুণে ও মানে বাংলাদেশের চা সেরা হিসেবে বিবেচিত। এখন অর্গানিক চা, গ্রিন টি খাচ্ছে মানুষ, তবে দুধ-চা এখনো মানুষের মাঝে জনপ্রিয়। বেশি চা পানকারী শীর্ষ ১২ দেশের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। দেশে নিবন্ধিত চা বাগান ১৬৭টি। এর মধ্যে বৃহত্তর সিলেটে ১৩৫টি, চট্টগ্রামে ২২টি, পঞ্চগড়ে ৭টি, রাঙামাটিতে ২টি ও ঠাকুরগাঁওয়ে ১টি বাগান রয়েছে।
দেশের চা-বাগানগুলির সংস্কার, আধুনিকায়ন, টেকসই ব্যবস্থাপনা, শ্রমিকদের দক্ষতা ও জীবনমান উন্নত করা গেলে এবং চা-চাষে নতুন ক্ষেত্র নিয়ে গবেষণা করা গেলে চা-শিল্প অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। উৎপাদন বাড়ানো গেলে বিদেশেও চায়ের বাজার সম্প্রসারিত হবে।
মতামত সম্পাদকীয়