প্রথম বই প্রকাশের অনুভূতিটাই আলাদা। অনেকে সেটি প্রথম সন্তানলাভের আনন্দানুভূতির সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। এ সংখ্যা থেকে শিল্পসাহিত্যে ধারাবাহিকভাবে লেখকদের প্রথম বই নিয়ে স্মৃতিচারণা প্রকাশিত হবে।
আবুল মোমেন »
প্রথম প্রকাশিত বই যে কোনটি সেটাই ভুলে গেছি। ভুল বই নিয়ে অনেকখানি লিখে আবিষ্কার করি যে ওটি নয়, প্রথম বই অন্য একটি। একবার ভাবুন। যার মনেই নেই প্রথম বইটির কথা তার আবার এ নিয়ে আবেগ অনুভূতি তো আদিখ্যেতা। তাইতো! কিন্তু মন তা মানে না এবং যুৎসই যুক্তিও খুঁজে বার করা গেছে। কারণ ১৯৮৫-র বইটি নিয়ে লিখতে গিয়ে বারবার মনে হচ্ছিল কিছু যদি উৎসাহ ও আবেগের বিহ্বলতা হয়ে থাকে সে তো ছিল প্রথম প্রকাশিত কবিতার বইটি নিয়ে! শেষে ১৯৭৯ সনে প্রকাশিত সেই চার ভুবনের চারণ বইটিকেই প্রথম বইয়ের স্বীকৃতি দিয়ে নিস্তার পেলাম।
তবে সেখানেও একটা কথা আছে। আগে সেই কথাটা বলে নেই। ১৯৭৮ সালের আগস্টে আমরা সদলবলে ওয়াহিদভাইয়ের Ñ সঙ্গীতজ্ঞ ও সংস্কৃতি সংগঠক ওয়াহিদুল হক Ñ সাথে ডেইলি লাইফের কাজ ছেড়ে দেই। তখন কিন্তু আমি বিবাহিত, যদিও তখনও ছেলেমেয়ে নেই। এই সময়ে সিগনেট প্রেসের সত্ত্বাধিকারী ইউসুফ চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ হয়। তিনি জীবনের শুরুতে পত্রিকার এজেন্ট ছিলেন এবং সেই সুবাদে কখনও একটি পত্রিকা প্রকাশের স্বপ্নও দেখতেন। আমরা নিজেদের জীবিকার দায়ে তাঁর শরণাপন্ন হয়েছিলাম। তাঁর স্বপ্ন আর আমাদের প্রয়োজন মিলে গেল। তাছাড়া তাঁর সাথে বাবার সুবাদে আমাদের পরিচয়ও অনেক দিনের। এই সূত্র ধরে তিনি আমাকে চাকুরিতে নিলেন তাঁর বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রকাশনা সংস্থা দোলনা প্রকাশনীর দায়িত্ব দিয়ে। এই দায়িত্ব নিয়ে প্রথম কাজটি করেছি ২০জন বিশ^মানবের সংক্ষিপ্ত জীবনীভিত্তিক পোস্টকার্ডের প্যাকেট প্রকাশ। এটিই ছিল আমার ব্যক্তিগত প্রথম প্রকাশনা। কিন্তু এটি কি বই? বইয়ের মর্যাদা দেওয়া যাবে কি পোস্টকার্ডের প্যাকেটকে? দ্বিধায় পড়ে আবারও হাত বাড়াই কবিতার বইটির দিকে। তবে বিশ^মানব সিরিজের পোস্টকার্ড প্যাকেটটি আমার তত্ত্বাবধানে ছাপা হয়েছিল এবং সবার পছন্দ হয়েছিল বলে এটি নিয়ে আমার আনন্দও কম ছিল না।
পরের বছর দুটি বইয়ের কাজ শুরু করি। ১৯৭৯ সন ছিল জাতিসঙ্ঘ ঘোষিত বিশ^ শিশুবর্ষ। সেটা মনে রেখে দোলনা থেকে একটি বাংলা প্রাইমার প্রকাশের উদ্যোগ নেই। পরিশ্রম করে লিখেছি আমি আর চমৎকার অলঙ্করণে সাজিয়ে দিয়েছিলেন মামা শিল্পী সবিহ উল আলম। সেই সময়ে সিগনেট ছাড়িয়ে আরেকটু এগিয়ে আমাদের আড্ডার নতুন আস্তানা হয়ে উঠেছিল সদরঘাটের চেম্বার প্রেস। সেখানে শিশির দত্ত এবং স্বপন দত্ত, আবসার হাবীব এবং তাদের আরও বন্ধুদের সাথে আলাপ হয়। ওরা ছিল স্পার্ক জেনারেশন Ñ বিদ্রোহী, প্রতিষ্ঠান বিরোধী, প্রচলিত ব্যবস্থা ভাঙার পক্ষে রাগি যুবাদের দল, আমরা ছিলাম অচিরা গোষ্ঠী। ওদের বিবেচনায় রাবীন্দ্রিক এবং হয়তবা আপসকামী। তখন আমাদের মূল নেতা মোহাম্মদ রফিক নেই, আমিই মাঝে মাঝে অচিরা প্রকাশ করি। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে ব্যবধান তৈরি বা বিরোধ চর্চায় বিশ^াসী নই। শিশির তখন তার সম্পাদক প্রকাশনী থেকে বই প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে। একদিন বলল প্রথম দফায় চারটি কবিতার বই প্রকাশ করবে Ñ নির্মলেন্দু গুণ, আসাদ চৌধুরী এবং আমার ও স্বপন দত্তের বই। গুণের বইটি ছিল তার আগে চাই সমাজতন্ত্র, আসাদ চৌধুরীর বইয়ের নাম প্রশ্ন নেই উত্তর পাহাড়, স্বপন দত্তের বই স্বপ্নের বসতবাটি ও অন্তর্লীন চাষাবাদ। আমার ও স্বপনের জন্যে এ হবে প্রথম বই Ñ প্রথম কবিতার বই অবশ্যই। শিশির তার সাংগঠনিক প্রতিভার পরিচয় দিয়ে দ্রুতই কাজ এগিয়ে নিলো।
আটষট্টি থেকে নিয়মিত কবিতা লিখছি। তাই ততদিনে আমার অনেক কবিতা জমেছে। ফলে আমন্ত্রণ পেয়ে বাছাইয়ের কাজে নেমে পড়লাম। ক’দিন খেটে ৫৬টা কবিতা চার পর্বে সাজিয়ে পাণ্ডুলিপি দাঁড় করালাম। বইয়ের নাম হল চার ভুবনের চারণ। সুন্দর প্রচ্ছদ এঁকেছিল আমার ভাই আবুল মনসুর। বইয়ের প্রকাশকাল দেখছি Ñ বিজয় দিবস ১৯৭৯। বইয়ের চার পর্বের নাম স্বপ্নতন্তুবায়, প্রকৃতির পাঠশালা, মৃগয়া মৌতাত এবং অন্তরীণ প্রতিপক্ষ।
সে বছরই বইগুলো নিয়ে একটা বড়সড় প্রকাশনা উৎসব করেছিল শিশির। গুণ এবং আসাদভাই ছিলেন। পরে কবিতার প্রশংসা করে আসাদভাই একটি চিরকুট লিখেছিলেন আমাকে। আরও অনেকেরই ভালো লেগেছিল কবিতা। সেই প্রথম বইয়ের মাধ্যমে তরুণ কবির মর্যাদা এবং সে আনন্দের স্বাদ দারুণ বৈকি।
তবে দিনে দিনে রাজনৈতিক কলাম রচনা, সাংস্কৃতিক দায় বহন, ফুলকির দায়িত্ব পালন, প্রবন্ধ ও গদ্যের দাবি পূরণ এবং রাজনৈতিক-সামাজিক অস্থিরতার মুখে নানা সাংগঠনিক কাজে জড়িয়ে কবিতায় যে অখণ্ড মনোযোগ দরকার তাতে ছেদ পড়েছে। তবে লেখা কমেছে ঠিক কিন্তু মাঝে মাঝেই ভাবের তাড়নায় রুদ্ধদুয়ার খুলেছেও বটে। এভাবে একে একে আটটি বই প্রকাশিত হয়েছে। দেখতে দেখতে নিজেও তো পড়ন্ত বেলায় পৌঁছে গেলাম। এখন সর্বত্র কবিতার আকাল চলছে, পাঠক কমেছে, কবিতার কদর পড়তির দিকে, কবির মর্যাদাও আগের তুলনায় গণ্ডিবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে প্রথম কবিতার বইটি তৈরি, ছাপা, প্রকাশ এবং প্রকাশনা উৎসবের দিনগুলো রোমন্থনের অনুভূতি মনকে শান্ত আনন্দ দেয়। এখনও কবিতা পড়তে ভালোবাসি, মনোমত একটি লিখতে পারলে এখনও আনন্দের কাঁপুনি টের পাই, হয়ত ভিতরে ভিতরে Ñ এই যা।