চাটগাঁভাষা বাঁচানোর বই

ড. শ্যামল কান্তি দত্ত »

চাটগাঁ ভাষা নতুন প্রজন্মকে শেখানের লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছে ভাষাবিজ্ঞানী ড. মাহবুবুল হকের চাটগাইয়া সঅজ পন্না (২০২৩) বা চট্টগ্রামি সহজ পাঠ নামক ভাষা-শিক্ষা সহায়ক গ্রন্থ।
ভাষাবিজ্ঞানী ড. মো: আবুল কাসেম প্রণীত ভাষা বিষিয়ক বিবিধ বিবেচনা (২০২৪) প্রবন্ধগ্রন্থ থেকে জানা যায় ২০০৬ খ্রি. সিল-এর দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার ভাষাউন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ও পরামর্শক লেডি সুজান ম্যালোন চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনকে কিছু প্রশ্নমালা দিয়ে প্রমাণ দেখান যে, ‘চট্টগ্রামী বাংলা অবক্ষয়ের প্রক্রিয়ায় নিপতিত এবং কোন না কোন সময়ে এটি অবলুপ্ত হয়ে যাবে’। তাঁর এই বক্তব্যের সূত্র ধরে চাটগাঁ ভাষা পরিষদের জন্ম (২০০৬)। ড. মাহবুবুল হকের ভাষ্যমতে, চাটগাঁ ভাষা পরিষদ ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে সহজ ভাষায় চট্টগ্রামের ভাষা-শিক্ষার একটি বই রচনার পরিকল্পনা করে। এ কে খান ফাউন্ডেশন এ কাজের জন্য তহবিল যোগান দেয়। ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি সেক্রেটারি সালাউদ্দিন কাসেম খান যথার্থই বলেন, বাংলা ভাষার সঙ্গে চাটগাঁইয়া ভাষার শাব্দিক সম্পর্কগত বেশ কিছু মিলের প্রেক্ষাপটে একে আঞ্চলিক বাংলা বলে গণ্য করা হয়। তবে কেউ কেউ একে স্বতন্ত্র ভাষার মর্যাদা দিতে উৎসাহী। যদিও মৌখিক এ ভাষার নিজস্ব লিপি নেই; তবে বাংলা, রোমান ও আরবি হরফে এর প্রতিবর্ণীকরণের চল দেখা যায়। প্রবন্ধিক শাকিল আহমদ কানাডা ভিত্তিক একটি ওয়েবসাইট ‘ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্ট’-এর প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে লেখেন,‘ বিশ্বজুড়ে ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ চাটগাঁইয়া ভাষায় কথা বলে। ভাষাভাষী জনসংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বের ১০০ ভাষার মধ্যে চাটগাঁইয়া ভাষার অবস্থান ৮৮তম। অপরদিকে ১ কোটি ১৮ লাখ ভাষাভাষী দিয়ে সিলেটি ভাষা রয়েছে ৯৭তম স্থানে’। বিলাতে অভিবাসী সিলেটিরাও সিলেটি বাংলাকে পৃথক ভাষা প্রমাণে মরিয়া। সিলেটের কৃতি সন্তান মোস্তফা সেলিম সিলেটি নাগরি লিপিতে বই প্রকাশ করে সিলেটি ভাষার পৃথক লিপি পুনঃপ্রচলনে অনেক দূর এগিয়েছেন। সাম্প্রতিক অনেক তরুণ গবেষকই সরওয়ার কামালের মতো মনে করেন যে, সুনীতিকুমার থেকে পরেশচন্দ্র পর্যন্ত সবাই গ্রিয়ার্সনকে ভক্তিযোগে অনুসরণ করেছেন। ফলে তাঁরা চাটগাাঁইয়া ও সিলেটি ভাষাকে স্বতন্ত্র ভাষা হওয়ার যোগ্য বিবেচনা করা সত্ত্বেও ভৌগোলিক-নৈকট্য ও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ঐক্যের লক্ষ্যে এগুলোকে বাংলার উপভাষা গণ্য করে গিয়েছেন। অথচ, অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে, দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় এমন মাত্র দুইশো ভাষা আছে দুনিয়ায়। এসব বিকাশমান ভাষার মধ্যে নেই আলোচ্য উপভাষা দুটির কোনোটি। ভাষাবিজ্ঞানী ড. মাহবুবুল হক সে-বিতর্কে পা বাড়াননি। ‘ভাষা হচ্ছে সামরিক শক্তিতে সমৃদ্ধ একটি উপভাষা’Ñ সমাজভাষাবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওইয়েনরিচ-এর এই উক্তি মেনে মাহবুবুল হক চট্টগ্রামি ভাষাটাকে বাঁচাতে ব্যস্ত হয়ে বইটি লিখেছেন, একজন ভাষাবিজ্ঞানীর দায়িত্ব পালন করেছেন।
চট্টগ্রামী সহজ পাঠ রচনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে ভূমিকায় তাই তিনি লিখেছেন: ‘অ-চাটগাঁইয়া যাঁরা এই ভাষা শিখতে চান আর চাটগাঁবাসীর সন্তান যাঁরা চাটগাঁইয়া ভুলে গেছেন তাঁদের চাটগাঁইয়া শেখায় সহায়তা করা। সেই সাথে সামগ্রিকভাবে চাটগাঁইয়া উপভাষার চর্চাকে অব্যহত রাখা’। প্রাবন্ধিক শাকিল আহমদ চাটগাঁইয়া সঅজ পন্না: বইটির রিভিউ লিখতে গিয়ে একে ‘চট্টগ্রামি ভাষা শেখার আকর গ্রন্থ’ বলে অভিহিত করেছেন। শব্দার্থ, অনুবাদ ও কথোপকথন পদ্ধতিতে রচিত হলেও এটি নিছক ভাষা-শিক্ষার বই নয়। এখানে চাটগাঁ ভাষা নিয়ে গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত প্রণয়ন এবং ভাষানীতি বিষয়ক ভাবনাও প্রকাশিত হয়েছে। যেকোনো ভাষার মতোই চাটগাঁ ভাষার স্থানিক বৈচিত্র্য বিদ্যমান। এ অবস্থায় চাটগাঁ ভাষার মানরূপ এবং উচ্চারণের অভিন্ন লিপিরূপ প্রণয়নের লক্ষ্যে পাণ্ডুলিপি প্রস্তুতের পর পণ্ডিত এ অধ্যাপকের তত্ত্ববধানে একটি কর্মশালারও আয়োজন করা হয়। এ কে খানের বাসভবনে ১২ই জুন ২০২৩ তারিখে অনুষ্ঠিত কর্মশালায় যোগ দেন এ কে খান গ্রুপের সাবেক চেয়ারম্যান মো. শামসুদ্দীন খান, এ কে খান ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি সেক্রেটারি সালাউদ্দিন কাসেম খান, চাটগাঁ ভাষা পরিষদের সভাপতি ভাষাবিজ্ঞানী ড. আবুল কাসেম, সিনিয়র সহসভাপতি ডা. মঈনুল ইসলাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ইব্রাহিম হোসেন ও বর্তমান পরিচালক ড. ফারজানা ইয়াসমিন, ইংরেজি ভাষা-বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মাইনুল হাসান চৌধুরী, ভাষা-গবেষক অধ্যাপক ড. শ্যামল কান্তি দত্ত, এ কে খান ফাউন্ডেশনের সমন্বয়কারী আবুল বাশার, চাটগাঁইয়া ছড়াকার তালুকদার হালিম, গবেষক শামসুল আরেফিন, শিক্ষক ও গবেষক হাসান মেহেদী, শিক্ষক আ ফ ম রবিউল হোসাইন, চাটগাঁ ভাষা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইমাম হোসেন চৌধুরী ও সহ-অর্থ সম্পাদক সরোজ কান্তি দাস প্রমুখ। কর্মশালায় উপস্থিত সাহিত্যিক, শিক্ষক, গবেষক, পণ্ডিত, অধ্যাপক ও সাংবাদিক সবার মতামতে সমন্বয়ে প্রণীত হবার কারণে চাটগাঁ ভাষার একটি মানরূপ নির্ধারণে বইটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হকের পিএইচডি গবেষণার বিষয় আধুনিক বাংলা কবিতা হলেও বিশ শতকেই দুই বাংলায় তিনি খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে যান বাংলা বানানের নিয়ম (১৯৯১) বই প্রকাশ করে। প্রমাণিত হয় তাঁর আগ্রহের ক্ষেত্র প্রায়োগিক ভাষাবিজ্ঞান। ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ক তাঁর উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে: অন্বেষার আলোয় চট্টগ্রাম (২০১২)। বইটিতে ১৪টি প্রবন্ধের প্রথম প্রবন্ধ ‘চট্টগ্রামের উপভাষা’। একই বছরে তিনি শিমুল বড়ুয়াকে সাথে নিয়ে সম্পাদনা করেন চাটগাঁ ভাষার রূপ পরিচয় (২০১২)। দুবছর পরে দুই বাংলার সেরা ভাষাবিজ্ঞানী ড. রফিকুল ইসলাম ও ড. পবিত্র সরকারের সাথে তিনি সম্পাদনা করেন প্রমিত বাংলা ব্যবহারিক ব্যাকরণ (২০১৪)। ভাষা-সংস্কৃতি ও ব্যাকরণের এতসব অর্জন-অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের পর তিনি হাত দেন চাটগাঁইয়া সহজ পন্না বা চট্টগ্রামি সহজ পাঠ (ঊধংু ঈযরঃঃধমড়হরধহ) রচনায়। বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির পাশাপাশি চট্টগ্রামের ভাষা-সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্যক অবগত হয়েই তিনি গ্রন্থটি প্রণয়নের প্রয়াস চালান। বইটি চারটি খণ্ডে বিন্যস্ত। প্রথম খণ্ড: ২৯ থেকে ৪৪ পৃষ্ঠা ব্যাপ্ত। এখানে চট্টগ্রামি ভাষার সাতটি স্বরধ্বনি, সাতটি অনুনাসিক স্বরধ্বনি ও একত্রিশটি ব্যঞ্জনধ্বনি আইপিএ প্রতীকসহ উপস্থাপন করেছেন। এখানে জ/য এবং ঙ/ং এই দুটি বিকল্প বর্ণ বাদ দেওয়া যেত বলে আমাদের মনে হয়। এর পর তিনি সর্বনাম শব্দশ্রেণি, সাধারণ প্রশ্নবাক্য ও বর্ণনাবাক্য দিয়ে মোট এগারোটি পাঠ সাজিয়েছেন। দ্বিতীয় খণ্ড: ৪৫ থেকে ১২০ পৃষ্ঠা পর্যন্ত সংলাপ ও অনুশীলন দিয়ে সাজানো। সংলাপে মুসলিম রীতি ও হিন্দু রীতির পরেই অসাম্প্রদায়িক কুশল বিনিময়ের রীতিও উঠে এসেছে। যেমন: ওবা, শুভ সআল/ বিয়ান (ওহে, শুভ সকাল)। এটা লেখকের সাম্যবাদী চিন্তার চিহ্ন। তৃতীয় খণ্ড: ১২১ থেকে ১৫০ পৃষ্ঠা পর্যন্ত নয়টি পাঠে উঠে এসেছে চট্টগ্রামী ভাষার সাহিত্য নিদর্শন। প্রবাদ, উৎপল কান্তি বড়ুয়ার ছড়া, লোকছড়া, মলয় ঘোষ দস্তিদারের গান, সুকুমার বড়ুয়ার কবিতা, আবদুল গফুর হালীর স্বাধীনতার গান এবং ড. মুহম্মদ এনামুল হক সংকলিত ‘এক বোকা জামাইয়ের গল্প’ দিয়ে সাজানো হয়েছে বইটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় সাহিত্যপাঠ অংশ। এই অংশটি সাহিত্যিকদের চট্টগ্রামি ভাষায় সাহিত্য রচনায় অনুপ্রাণিত করবে। চতুর্থ খণ্ড: ১৫১ থেকে ১৮৭ পৃষ্ঠা পর্যন্ত বিষয়ভিত্তিক শব্দসংগ্রহ। এখানে বিষয় হিসেবে এসেছে :রং, সপ্তাহের দিন, বাংলা-ইংরেজি মাসের নাম, ঋতুর নাম, আবহাওয়া, সময়, প্রাণী, পাখি, ফুল, ফল, সবজি, খাদ্য, শরীরের অঙ্গ, রোগ, পারিবারিক সম্পর্ক, মানুষ, পেশা শহর, পরিবহন, বাড়ি, কেনাকাটা, অফিস, অভিবাদন, প্রশ্নশব্দ, ক্রিয়া, সর্বনাম, সংখ্যা শব্দ ইত্যাদি। শব্দগুলোর ইংরেজি প্রথমে দিয়ে এর উপর ভিত্তি করে বর্ণানুক্রমিকভাবে সাকানো হয়েছে। এতেকরে বিষয়ভিত্তিক যেকোনো ইংরেজি শব্দ খুঁজে এর প্রমিত বাংলা এবং চট্টগ্রামি ভাষায় এর প্রতিশব্দ খুঁজে পাওয়া সহজ হবে। আবার ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষার্থী যারা বাংলা পড়তে পারে না তারাও ইংরেজি শব্দ দেখে রোমান হরফে লেখা পড়ে চট্টগ্রামি ভাষা জানতে পারবে সহজেই। একারণেই হয়তো বইটির ইংরেজি নাম ইজি চিটাগনিয়ান। রচনাপঞ্জিতে চট্টগ্রামি ভাষার অভিধান, প্রবন্ধ, গবেষণা-গ্রন্থ এবং সাহিত্যকর্মের নাম এই গ্রন্থের গুরুত্ব বাড়িয়েছে।
চট্টগ্রামী ভাষাপ্রেমি সকলকে উৎসর্গ করা বইটির প্রতিটি কথা তিনটি ভাষায় এবং তিনটি লিপিতে উপস্থাপিত হয়েছে। প্রথমে বঙ্গলিপিতে চাটগাঁইয়া ভাষা, প্রমিত বাংলা ভাষা, রোমান হরফে চাটগাঁইয়া ভাষা এবং ইংরেজি লিপিতে ইংরেজি ভাষা। এতেকরে চট্টগ্রামি ভাষা জানা মানুষের পাশাপাশি যেকোনো বাঙালি কিংবা ইংরেজি জানেন এমন যেকোনো বিদেশি ব্যক্তিও অনায়াসে এই বই পড়ে চট্টগ্রামী ভাষা বুঝতে পারবেন, উপভোগ করতে পারবেন চট্টগ্রামি সংস্কৃতির সৌন্দর্য্য। বইটি চট্টগ্রামী ভাষা-সংস্কৃতির গ্রহণযোগ্যতা বহুমুখী করতে অবদান রাখবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

চাটগাঁইয়া সঅজ পন্না
ড. মাহবুবুল হক
প্রকাশক : আগামী প্রকাশনী
প্রচ্ছদ : রাজীব দত্ত
প্রকাশকাল : সেপ্টেম্বর ২০২৩
১৮৮ পৃষ্ঠা
দাম : ৫০০ টাকা