জুয়েল আশরাফ »
নূরুলপুর হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবদুস সালাম সাহেব দেখলেন স্কুলের বাগানে গরু ঢুকে তার প্রিয় গাছগুলোকে নষ্ট করে যাচ্ছে। তিনি সব সময় চশমা পরে থাকেন, খালি চোখে দূরের কিছুই দেখতে পান না। প্রধান শিক্ষকের কামরায় নিজের চেয়ারে বসে আছেন তিনি। তার বসার জায়গা থেকে বাগানের দূরত্ব প্রায় সত্তর গজ। কমলকে ডাকবেন কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ করলেন হঠাৎ করেই খালি চোখে দেখতে পাচ্ছেন। শুধু তাই না, দূরের সবকিছু স্পষ্ট দেখছেন। অবিশ্বাস্য ব্যাপারগুলো যখন নিজের মধ্যে ঘটে খুশিতে আত্মহারা হয়ে অনেকেই ছেলেমানুষী কা- করে বসে। তাঁর বয়স ৫৬ বছর তিন মাস। এই বয়সে ছেলেমানুষী আচরণ বেমানান। উপরন্তু স্কুলের প্রধান শিক্ষক তিনি। চিৎকার-চেঁচামেচি হই-হুল্লোড় করে আনন্দ প্রকাশ করলে ভাবগাম্ভীর্য নষ্ট হয়। নিজের ভাবমূর্তি বজায় রাখতে সব সময়ই সচেতন তিনি। কিন্তু লক্ষ করলেন উত্তেজনায় তাঁর হাত-পা কাঁপছে। বোঝা যাচ্ছে বেশি সময় আনন্দ ধরে রাখতে পারবেন না। এই আনন্দ কারোর সঙ্গে শেয়ার না করা পর্যন্ত দম আটকে মারা পড়তে পারেন। বিপতœীক তিনি। স্ত্রী গত হয়েছেন চার বছর আগে। স্ত্রী বেঁচে থাকলে এ রকম অপার্থিব ঘটনা এখনই ফোনে জানিয়ে আরাম পেতেন। তাঁর স্ত্রী অলৌকিক কোনো ব্যাপারেই বিশ্বাসী ছিলেন না। শোনা মাত্রই বলতেন, বুড়ো বয়সে তোমাকে ভীমরতিতে ধরেছে। চশমা ছাড়া নিজের হাতের লেখাটাই পড়তে পারো না, অফিস ঘরে বসে বাগানে গরু দেখছো? আজ বাড়ি আসো চোখের কেমন অলৌকিক জ্যোতি দেখতে চাই।
ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বিষয়টা শেয়ার করা যায়। তাঁর তিন ছেলে দুই মেয়ে। ছেলে তিনজনই বউ নিয়ে কানাডায় সেটেল্ড। মেয়ে দুজনের একজন স্বামীর সঙ্গে নিউজার্সিতে, অন্যজন ক্যালিফোর্নিয়ায়। তাদের কাউকে ফোন করার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ফোন করা যাচ্ছে না। এখানে দুপুর হলে সেখানে এখন রাত গভীর। সময় মিলছে না। এত রাতে ছেলেমেয়েদের ফোন করা উচিত হবে না।
তিনি বেল চাপলেন। দশ মিনিট পর কমল এসে হাজির হলো। কমল স্কুলের দপ্তরি। তার কাজ হচ্ছে সময় মতো ক্লাসের বেল বাজানো। এছাড়া তার আরও একটি বিশেষ কাজ- স্কুলের প্রধান গেটের দিকে লক্ষ রাখা। গরু-ছাগল, ভেড়া গেটের ভেতর ঢুকে বাগানের গাছপালার ক্ষতি না করে সেদিকে খেয়াল করা। একটু আগে একটা গরু ঢুকে যখন বাগানের অধিকাংশ গাছ নষ্ট করে যাচ্ছিল, সেই সময়ে সে ছিল কাঁচাবাজারে। তার স্ত্রী বারবার ফোন করে ধনিয়াপাতার কথা বলছিল। সে ভাবল, টিফিন পিরিয়ডের শেষ বেল বাজিয়েই চটজলদি ধনিয়াপাতা কিনে পরিচিত কোনো মুখ খুঁজে পেলেই বাড়ি পাঠিয়ে দেবে। ধনিয়াপাতা কেনা হয়েছে। কিন্তু তার বাড়ি চেনে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া গেল না। স্কুলে এসে সে দেখল, একটা আবাল-গরু বাগানের অর্ধেক গাছ নষ্ট করে রেখেছে। গেট লাগানোই থাকে। মাঝে-মাঝে আশেপাশের দোকানদার স্কুলের পানি নেওয়ার জন্য ভেতরে আসে। সেই সুযোগে ফাঁক পেয়ে গেটের ভেতর গরু ঢুকেছে। হেডমাস্টার স্যারের প্রিয় গাছগুলো নষ্ট করেছে। তার কপালে আজ কী আছে আল্লাহ মাবুদ জানেন! সে ভয়ে বুকের কাঁপুনি নিয়ে হেডমাস্টার স্যারের কামরায় হাজির।
হেডমাস্টার স্যার পরম আনন্দ গলায় বললেন, কমল, আমার জন্য জায়নামাজ নিয়ে আসো। অতি আনন্দ পেলে আমার নফল নামাজ পড়তে ইচ্ছা করে। এখন আমি অতি আনন্দিত।
যা ভেবে এসেছিল কমল বুঝল ব্যাপার সেরকম না। সে দেখল হেডমাস্টার স্যারের চোখে চশমা নেই, এজন্য তার কেনা দামি গাছগুলো যে আবাল-গরুটা নষ্ট করে গেল এখনো দেখেন নি। কিন্তু অল্প পরেই তিনি চশমা পরে বাগানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাবেন! ভাবতেই কমলের হার্টবিট বাড়তে থাকে।
কমল জায়নামাজ আনার জন্য পাশের কামরায় যাচ্ছিল। হেডমাস্টার স্যার তাকে ডেকে আগের চেয়ে আরও আনন্দিত গলায় বললেন, কমল, জানতে চাইলে না আমি কী জন্য আনন্দিত?
হেডমাস্টার স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে কমলের ভয় আরও বেড়ে গেল। মনে পড়ল হাস্যময় উজ্জ্বল মুখের আড়ালে রাগী পাজি, গম্ভীর চেহারার মানুষটিকে। সাত বছর তাঁর সঙ্গে কাজ করছে। দীর্ঘদিনের গম্ভীর মানুষটার এমন হাসিখুশি মুখ সত্যিই সে কখনও দেখেনি। স্যারের সারামুখে হাসি। কমল জিজ্ঞেস করবে সাহস পেল না। কিন্তু প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিয়ে সে তাকিয়ে আছে হেডমাস্টার স্যারের দিকে।
হেডমাস্টার স্যার বললেন, কমল, শুনলে তুমি অবাক হবে। আমি চশমা ছাড়া সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাই। পনেরো মিনিট আগে ঘটেছে ব্যাপারটা, চশমা ছাড়া স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। জানি, আমার কথা বিশ্বাস করতে তোমার অসুবিধে হচ্ছে। আমি নিজেই অবাক! তুমি তো অবাক হবেই। খালি চোখেই ক্যালেন্ডারের পাতায় তারিখগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এখন। ওই দেখো আজ মার্চ মাসের বিশ তারিখ। অল্পদিন পরেই স্বাধীনতা দিবস। বিশ-এর পাশে ছোট্ট একটা সংখ্যা সাত। লালরঙের সাত নম্বর সংখ্যাটা হলো বাংলা মাসের তারিখ। আজ চৈত্র মাসের সাত তারিখ। কী বুঝলে? এখন বিশ্বাস হচ্ছে আমার কথা? তুমি চোখ বড় করে তাকিয়ে আছো কেন? আচ্ছা শোনো, কিছুক্ষণ আগে একটা গরু এসে আমার বাগানের গাছগুলো নষ্ট করে গেল। আমার কিন্তু এখানে বসে বাগান দেখতে পাবার কথা নয়। আমি তো চশমা পরেও অতদূর ভালো দেখতে পাই না। অথচ দেখ কী আশ্চর্য, খালি চোখেই গরুটাকে দেখতে পেলাম! গরুর রঙ ছিল শাদা। পশ্চিমা গরু। এখন বিশ্বাস হচ্ছে আমার কথা?
কমল বিশ্বাস-অবিশ্বাস নিয়ে চিন্তিত নয়। তার চেহারা রক্তশূন্য। হেডমাস্টার স্যার যে কোনো মুহূর্তে গাছ নষ্টের কৈফিয়ত চাইবেন তার কাছে। সে আছে মহা দুশ্চিন্তায়।
দাঁড়িয়ে থেকো না, যাও। জায়নামাজ নিয়ে এসো। আর শোনো, আমার অফিসঘরে পনেরো মিনিটে কাউকে ঢুকতে দেবে না।
দশ মিনিটের ভেতরেই আবদুস সালাম সাহেব অজু করে নামাজ শেষ করলেন। আরও পনেরো মিনিট পার করলেন চেয়ারে বসে থেকে। তখনও অফিসঘরে কেউ আসেনি। তিনি চাচ্ছিলেন কেউ একজন আসুক। খালি চোখে দেখতে পারার অলৌকিক ব্যাপার নিয়ে আলাপ-আলোচনায় যেতে ইচ্ছা হচ্ছে। সহকারী প্রধান শিক্ষক সাহেব এই মুহূর্তে তার ঘরে এলে সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন। তার সঙ্গে বন্ধুসুলভ সম্পর্ক। মাওলানা মানুষ তিনি। অলৌকিক ব্যাপার নিয়ে মোটামুটি একটা পরকাল সম্পর্কীয় জ্ঞান দিতে পারতেন। আধঘণ্টাকেটে যাওয়ার পরও নিজ থেকে কেউ এলো না। তিনিও কাউকে ডাকলেন না। হেডমাস্টার হয়ে সামান্য অলৌকিকতার পেছনে পড়ে আলাপে গেলে তার ভাবমূর্তি হালকা হয়ে যাবে। নিজের আনন্দ নিজেই উপভোগ করছেন সেই-ই ভালো।
বাইরে মাইকের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই জ্বালাময়ী ভাষণ : ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
যুদ্ধের সময় নিজের সঠিক বয়স মনে করতে পারেন না আবদুস সালাম সাহেব। ছয় সাত কিংবা কম বেশি হবে। সার্টিফিকেটে তার বয়স দুবছর কমিয়ে দেওয়া আছে। মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ কোনো স্মৃতি মনে নেই। স্বাধীনতার ডাক এলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে দেশের সব শ্রেণির মানুষ একত্র হয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে নিজের দেশকে বাঁচাবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল। সেই দলে তাঁর বাবাও ছিলেন। বাবা তাদের তিন ভাইবোনকে ডেকে সবার কপালে চুমু-আদর খেলেন। মা পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন। বাবা মায়ের মাথায় হাত রাখলেন। জীবনে সেদিনই শেষবার বাবাকে মায়ের পাশে দেখেছেন। এরপর আর কোনোদিন মায়ের মাথায় বাবার হাত দেখেননি। বাবাকে দেখেননি। বাবা আর কোনোদিন তাদের কাছে ফিরে আসেননি।
আবদুস সালাম সাহেবের মনে আছে তারা সেসময় খিলগাঁও যেই বাসাতে ছিলেন, সেই বাসার ওপর তলায় চশমাপরা একটা মেয়েও থাকত। মেয়েটার নাম ছিল সেতারা। কিন্তু বাড়িতে সবাই ডাকত সেতু। তিনিও ডাকতেন সেতু। বয়সে অনেক বড়। থাপ্পড়ের ভঙ্গিতে মেয়েটি বলতেন, ‘আপা বল। বল সেতারা আপা।’ তারপরও তিনি ডাকতেন, ‘সেতারা’। সেতারা নামে ডেকে যেই ছন্দ তিনি পেতেন, ‘আপু’ ডেকে সেই ছন্দের পতন তিনি চাইতেন না। সম্বোধন জরুরি নয়, সেই অল্প বয়সেই সেতারা ডাকনাম তার বুকের আরাম হয়ে উঠল। নিজের থেকে দশ বছরের বড় মেয়েটিকে তিনি ‘সেতারা’ ‘সেতারা’ ডেকে প্রাণে আরাম নিতেন। চশমাপরা মেয়েটি সারাক্ষণ অস্থির পাখির মতো নিজের শাড়ির আঁচল আর কুচি টেনেটুনে ঠিক রাখতে ব্যস্ত থাকত। একদিন নিজের ঘরে ডেকে নিলেন তাকে। সেদিন সেতারা ভারি সাজে সাজছিল। চশমা খুলে গ্লাস পরিষ্কার করে তাকে পরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘দেখ তো ছোটু, চশমার ভেতর দিয়ে এই সাজে আমাকে চশমা ছাড়া কেমন দেখাচ্ছে?’ একটা হাই পাওয়ারের চশমা চোখে দিয়ে ঘোলাটে জিনিস ছাড়া আবদুস সালাম সাহেব কিছুই দেখতে পেলেন না। তারপরও তিনি বললেন, ‘সুন্দর।’ নিজের রূপের প্রশংসা বাচ্চাবয়সী ছেলের কাছ থেকে শুনতে সব মেয়েরাই তৃপ্তি পায়। সেতারাও পরিতৃপ্তির হাসি হেসে বলল, আজ সেজেছি কেন জানিস?
কী জন্যে?
কী জন্য না, বল কার জন্য।
কার জন্য?
আজ আমাকে দেখতে আসবে রে ছোটু। আমার বিয়ে হলে তোদের ছেড়ে চলে যাব। আমার বর এসে আমাকে নিয়ে যাবে।
সেতারা চলে গিয়েছিল। আর কোনোদিন আসেনি। তাকে নিতে যারা এসেছিল তারা বরযাত্রীর ছিল না কেউ, মিলিটারি ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গেল সেতারা আপুকে। এরপর যখনই তিনি খালি বাসাটায় যেতেন, দেখতেন ধুলায় জমে পড়ে আছে টেবিলের ওপর সেই রূপবতী তরুণী সেতারার চশমাটা। যার নাম ধরে ডাকলে মারের ভয় দেখিয়ে নিজেই মজা পেয়ে হাসতেন। যার শাড়ির আঁচল আর কুচি টেনেটুনে ঠিকঠাক রাখতে হতো সারাক্ষণ।
দেশ স্বাধীনের পর থেকে সেতারার সেই কালোফ্রেমের চশমা আবদুস সালাম সাহেব নিজের কাছে যতœ করে রেখেছেন এতকাল। প্রায় পঞ্চাশ বছর সময় ধরে তিনি সেতারার চশমাকে আগলে আছেন। সেতারাকে আগলে আছেন। কালরাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আলমারি খুলে পুরানো জিনিস নাড়াচাড়ার সময়ে সেতারার চশমা নজরে আসে। এরপর কী মনে করে চোখে পরে নিলেন। এবং ঘুমানোর সময়েও পরে ঘুমাতে গেলেন। যেন ছেলেবেলাকার সেদিনের দৃশ্য ভেসে বেড়াচ্ছে- দেশে যুদ্ধ চলছে। অল্পবয়সী একটি বালক মোটা গ্লাসের চশমা পরে এক তরুণীর সামনে দাঁড়ানো। তরুণী তাকে বলছে, ‘ছোটু তোকে তো চশমাতে ভালো মানায় না রে। কাল থেকে চশমা পরে আর স্কুলে যাস না।
কিন্তু চশমা ছাড়া তো আমি কিছুই দেখতে পাই না।
তুই চশমা ছাড়াই কাল থেকে ভালো দেখতে পাবি। এখন দেশে যুদ্ধ চলছে। চশমা পরতে দেখলে মিলিটারিরা আমার মতো তোকেও ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যাবে।
এরপর ঘুম ভেঙে গেল। তিনি জেগে উঠলেন। সারারাত ঘুম আর স্বপ্নের ভেতরেও সিতারার চশমা তাঁর চোখেই ছিল। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল সকালে, নিজের চশমা পরে স্কুলে আসার পর থেকে। যা কিছু দেখেন, যেদিকে তাকান সব ঘোলাটে। সারাদিন ঘোলাটে চশমা পরেই তিনি টিফিন পিরিয়ড পার করলেন। চশমারই দোষ কিনা, পাল্টাতে হবে। গ্লাস পরিষ্কার করবেন ভেবে যখনই চশমা খুলেছেন চশমা ছাড়াই ভালো দেখতে পেলেন, যেরকম চশমাপরা চোখে দেখতে পেতেন। বরং আরও বেশি পরিষ্কার, আরও স্বচ্ছ দেখা যাচ্ছে।