শৈবাল চৌধূরী »
আমার লেখালিখির শুরু নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে। তখন স্কুলের দেয়াল পত্রিকায় কবিতা বা ছড়া লিখতাম। পড়তাম কাজেম আলী হাই স্কুলে। সহপাঠী মুস্তাফিজের সম্পাদনায় বেশ কিছুদিন দেয়াল পত্রিকাটা বের হয়েছিল। পড়ে আর সেটি বের করা যাচ্ছিল না নানা কারণে। মূল কারণ লেখার স্বল্পতা। মন খারাপ হয়েছিল খুব আমাদের সবার।
এরপর লেখা শুরু হয় উচ্চ মাধ্যমিক পড়াকালীন। সচিত্র বাংলাদেশ পত্রিকায় কবিতা পাঠাতাম। তিনবার পাঠালে একবার ছাপা হতো। মন খারাপ হতো। তাছাড়া তখন দেখতাম, বন্ধুদের সবাই শুধু কবিতা লেখে। ভাবতাম আমি বরং গদ্য লিখতে শুরু করি। গল্প লিখলাম দুয়েকটা। লিটল ম্যাগাজিনে ছাপা হলো কাঁচা গল্পগুলো। সে কাঁচা গল্পগুলো পাকা করারও সুযোগ নেই আর। হারিয়ে গেছে সে সব কাগজপত্র।
সে সময় চলচ্চিত্র সংসদ চর্চার সঙ্গে যুক্ত হই ইমেজ নামের এক ফিল্ম সোসাইটির সদস্য হয়ে। এমনিতে ছোটবেলা থেকে আমি সিনেমার পোকা ছিলাম। স্কুল পালিয়ে প্রতি সপ্তাহে সিনেমা দেখতাম। ডাবল মার খেতাম। প্রথমে বাসায়, পরে স্কুলে। কীভাবে যেন আমার মা বুঝে যেতেন, আমি আজ স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। বাবাকে জানাতেন উনি অফিস থেকে ফিরলে। একচোট চলতো। পরের চোট চলতো পরের দিন স্কুলে। যাহোক ফিল্ম সোসাইটির সদস্য হয়ে নতুন ধরনের সিনেমার সন্ধান পেলাম। এরপর সদস্য হলাম রেইনবো ফিল্ম সোসাইটির। এখানে এসে ভাবলাম, সিনেমা নিয়েই লিখবো। কবিতাকে ছুটি। অবশ্য এরপরও যে কবিতা লিখিনি তা নয়। ছাপা হতো বলাকা পত্রিকায়। বাঙালিকে তো কবিতা লিখতেই হয়। তাছাড়া আমার মনে হয়, এতে করে মনের চাষাবাদ হয়।
সিনেমা নিয়ে লিখে পাঠাতাম দৈনিক সংবাদ, সাপ্তাহিক বিচিত্রা, সন্ধানী আর রোববারে। লেখাগুলি ছাপা হতো।
পরবর্তী সময়ে ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদ পুনর্গঠিত হলে সেখানে কেবল সদস্য নয়, সক্রিয় কর্মী হয়ে উঠি। আনোয়ার হোসেন পিন্টুর সম্পাদনায় সেখানে নিয়মিত প্রকাশিত হতো, উন্নত মানের চলচ্চিত্র পত্রিকা লুক থ্রু। আমাদেরও লেখার একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। প্রতি সংখ্যায় লিখতাম।
এরপর দৈনিক পূর্বকোণ প্রকাশিত হতে থাকে ১৯৮৬ সাল থেকে। শিল্প-সংস্কৃতি পাতায় নিয়মিত লেখার সুযোগ পেলাম। তখন পাতাটির সম্পাদক ছিলেন আবসার হাবীব। ওনার পরে এই পাতা সম্পাদনা করতেন বন্ধুবর আনোয়ার হোসেন পিন্টু।
একদিন এক অনুষ্ঠানে প্রয়াত কবি ও সাংবাদিক শ্রদ্ধেয় অরুণ দাশগুপ্ত ডেকে বললেন, ‘এখন থেকে তুমি আজাদীতেও নিয়মিত লিখবে। আগামী শুক্রবার সকাল ১১টায় তুমি আজাদী অফিসে দেখা করবে আমার সঙ্গে।’ যথারীতি যাবার পর তিনি শ্রী প্রদীপ দেওয়ানজীর কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘এখন থেকে সে এখানেও লিখবে।’
প্রদীপদাকে আগে থেকে চিনতাম। শুরু হলো তাঁর সম্পাদিত পাতা ‘সমাজ ও সংস্কৃতি’-তে লেখা। এ পাতায় অনেকগুলো কলাম লিখেছি। তবে প্রথম কলাম লিখি প্রদীপদা সম্পাদিত ‘আগামীদের আসরে’। এ পাতায় শিশু-কিশোর উপযোগী করে ‘চলচ্চিত্রের কথা’ নামে একটি কলাম লিখেছিলাম ১৯৮৮ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত। ১৯৯৬ সালে আজাদী ‘আজমিশালী’ নামে শিল্প-সংস্কৃতি বিষয়ক একটি সাপ্তাহিকী চালু করে। অত্যন্ত পাঠকপ্রিয় সাপ্তাহিকীটা সম্পাদনা করতেন সানজিদা মালেক। এই সাপ্তাহিকীতে কয়েকটি সংখ্যা ছাড়া সবক‘টি সংখ্যায় ‘স্ক্রীন’ নামে কলাম লিখে গেছি ২০১৪ সাল পর্যন্ত। এটি ২০১৪ সালে ‘খোলা হাওয়া’ নামে পরিবর্তিত আকারে প্রকাশিত হতে শুরু করে এখনও অব্যাহত রয়েছে। এ সাময়িকীতে ২০১৪ সাল থেকে ‘সিনেলগ’ নামে একটি কলাম লিখে চলেছি। তবে এখন আর প্রতি সপ্তাহে লিখি না। নবীন অনেকেই এখন লিখছেন। তাদের জন্যেও সুযোগ করে দেয়া আমাদের দায়িত্ব।২০১৬ সাল থেকে ‘খোলা হাওয়া’ সম্পাদনা করছেন কবি আসমা বীথি।
আমার লেখালিখি মূলত চলচ্চিত্র নিয়ে। মাঝে মধ্যে সংগীত নিয়েও লিখেছি কিছু।
প্রদীপদা অনেক দিন ধরে একটি বই প্রকাশের জন্য তাগাদা দিতেন। সাহস করে উঠতে পারিনি। তাছাড়া সে সময় (১৯৯০ – এর দশকের শুরুর দিকে) এত প্রকাশনা সংস্থাও চট্টগ্রামে ছিল না। শেষ পর্যন্ত আমার বন্ধু আবু ইউসুফের জোরাজুরিতে নিজের টাকায় চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্রের ব্যানারে আমার প্রথম বই ‘চলচ্চিত্রের পটভূমিকায়’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৬ সালের ৭ মে। বইটি এক হাজার কপি ছাপানো হয়েছিল। ছেপেছিলেন প্রিয়ভাজন রোমান গোমেজ তাঁর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান রোজ প্রসেস থেকে। প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জা করেছিলেন দেবাশীষ রায়। বইটি পাঠক নন্দিত হয়েছিল। বইটি উৎসর্গ করেছিলাম আমার বাবা ও মা‘কে।
বাংলা চলচ্চিত্রের শতবর্ষ উপলক্ষে কোলকাতার ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকা ২০১৯ সালে বাংলা ভাষায় রচিত একশোটি সেরা গ্রন্থের একটি তালিকা প্রকাশ করেন। সে তালিকায় আমার প্রথম বইটি ৪৭ নম্বরে ঠাঁই পেয়েছে।
আমার লেখালিখির তুলনায় প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা কম। এ পর্যন্ত মোট নয়টি বই প্রকাশিত হয়েছে। দুটি যন্ত্রস্থ।
শেষ করছি কৌতুককর একটা ঘটনার কথা বলে। আমার প্রথম বইটি প্রকাশ হওয়ার পর ইউসুফ নিজের হাতে বেশ কয়েকটি বই নিয়ে আমার বাসায় আসে। আমি শুরুতেই প্রথম কপিটা আমার বাবার হাতে তুলে দিই। পরের কপিটা আমার বুক শেল্ফে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক এবং মৃণাল সেনের লেখা তিনটি বইয়ের পাশে রেখে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থেকে বেশ অহংকার বোধ করতে থাকি এই ভেবে যে, তোমাদের মতো সিনেমা তৈরি করতে পারিনি বটে, একখান বই আমি লিখে ফেলেছি তোমাদের মতো! হাস্যকর ব্যাপারটি এখনও ভাবলে হাসি এবং লজ্জা দুটোই পাই।