মো. নুরুল আলম, চন্দনাইশ »
স্বজনদের বুকফাটা কান্না আর আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে চন্দনাইশের জোয়ারার মোহাম্মদপুর গ্রাম। এক দুর্ঘটনায় সাত স্বজনের মৃত্যু মানতে পারছেন না কেউ। প্রতিবেশী ও গ্রামের লোকজন নিহতদের মরদেহ এক নজর দেখার জন্য বাড়িতে এসে ভিড় জমাচ্ছেন। বাড়ির উঠোনেই বিলাপ করতে করতে মূর্ছা যাচ্ছেন তারা।
একই পরিবারের সাতজনের মৃত্যুতে বুধবার দুপুরে এমন শোকের পরিবেশ তৈরি হয়েছে এই গ্রামে। গ্রামবাসী বলছেন, এমন দুঃসহ মর্মান্তিক ঘটনা স্মরণকালেও দেখেননি তারা।
মঙ্গলবার সকালে সাড়ে ১১টার দিকে হাটহাজারীর চারিয়া এলাকায় চট্টগ্রাম খাগড়াছড়ি মহাসড়কে বাস ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে প্রাণ হারান এই গ্রামের প্রবাসী নারায়ণ নাথের স্ত্রী-সন্তান, বোন, ভাতিজা।
সড়কের পাশে রাখা লাশের পাশে কাঁদতে কাঁদতে নারায়ণ বলছিলেন, আমার সুখের সংসার শেষ। আমি এখন কী নিয়ে বাঁচবো? তারই পাশে বসা বড় ভাই জমজ দুই ভাতিজার জন্য মুর্ছা যাচ্ছিলেন। বলছিলেন, যমজ দুটা ভাইপো, তাদের ছেড়ে কিভাবে বাঁচবো জানি না। বড় ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় বাবুল ও নারায়ণের মেঝ ভাই শম্ভু দাশ। পক্ষাঘাতগ্রস্ত শম্ভু ভালো করে উঠতে বসতেও পারছেন না।
মরদেহ যখন শ্মশানে নেওয়ার প্রস্তুতি চলছিলো বাড়ির দরজায় বসে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিলেন নারায়ণ। চোখে পানি নিয়ে শেষবারের মতো দুই জমজ ছেলের মুখগুলো দেখে আবার ঘরে ফেরেন। বুধবার সকাল ১১টার দিকে বাড়ি পৌঁছেন তিনি। স্ত্রী সন্তানের নিথর শরীরের কাছে পৌঁছে ভেঙ্গে পড়েন কান্নায়। এরপর তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন।
নিহতের বড় ভাই বাবুল দাশ বলেন, রীতা ও তার মেয়ে বাক প্রতিবন্ধী শ্রাবন্তী ও ভাতিজা বিপ্লবকে শ্মশানে দাহ করা হয়েছে। বর্ষা এবং যমজ দুই ছেলে অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তাদের মাটিতে সমাহিত করা হয়েছে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তাদের শ্মশানে তোলা হয়। বিকেল ৪টার দিকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ হয়। তাদের সঙ্গে মারা যাওয়া চিনুকে চন্দনাইশের সাতবাড়িয়ায় তাদরে পারিবারিক শ্মশানে দাহ করা হয়েছে।
মঙ্গলবার বাপের বাড়িতে মিষ্টি ও কাপড়-চোপড় নিয়ে ঠাকুরমার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যাওয়ার পথে বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান নারায়ণের স্ত্রী রিতা দাশ প্রকাশ মায়া (৩৫), মেয়ে শ্রাবন্তী দাশ (১৭) , বর্ষা দাশ (১০) এবং জমজ দুই ছেলে দ্বীপ দাশ (৪) এবং দিগন্ত দাশ (৪), ভাতিজা সম্ভু দাশের ছেলে বিল্পব দাশ (২৭) এবং জেঠাত বোন চিনু বালা দাশ (৪০)।
আহত হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন চিনু বালা দাশের ছেলে বাপ্পা দাশ (৩০) ও অটোরিকশা চালক বিপ্লব মজুমদার (২৮)।
০ফতেনগর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, নিহত বাক প্রতিবন্ধী শ্রাবন্তী দাশ ২০২৪ সালের মানবিক এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলো। টেস্ট পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছে। ছাত্রীটি নিহত হওয়ায় বিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও ম্যানেজিং কমিটি সদস্যরা গভীর শোকাহত।
সবকিছুর ঊর্ধ্বে মানবতা
নিজ উপজেলার সাতজনের মৃত্যুতে ব্যথিত পুরো চন্দনাইশের মানুষ। উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে নিহতদের দেখতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জড়ো হয়েছেন জোয়ারায়। মঙ্গলবার সকাল থেকে লাশ আনা থেকে শুরু করে দাহ পর্যন্ত ছিলেন স্থানীয় চেয়ারম্যান আমিন আহমেদ চৌধুরী রোকন। নিহতের পরিবারের সদস্যের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শ্মশান পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছেন মরদেহ। ছিলেন অন্তোষ্টিক্রিয়াতেও। শুধু স্থানীয় এই জনপ্রতিনিধি নন, স্থানীয় লোকজনও ছিলেন তাদের পাশে।
স্থানীয় সাংসদ বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব নজরুল ইসলাম চৌধুরী, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল জব্বার চৌধুরী, ইউএনও মাহমুদা বেগম, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদ সদস্য আবু আহমেদ চৌধুরী জুনু, ভাইস চেয়ারম্যান মওলানা সোলাইমান ফারুকী, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান এডভোকেট কামেলা খানম রূপা, জোয়ারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমিন আহমেদ চৌধুরীসহ অনেক জনপ্রতিনিধি ও বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী ছুটে আসেন তাদের বাড়িতে ও শ্মশানে।
জোয়ারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমিন আহমেদ চৌধুরী রোকন বলেন, ‘এমন শোকাবহ ঘটনা আমাদের ইউনিয়নে আর ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। একটি দুর্ঘটনা একই পরিবারের সাতটা মানুষের প্রাণ কেড়ে নিল। এমন দুর্ঘটনা মেনে নেয়া যায় না। আমরা বাসচালকের শাস্তি দাবি করছি।’