সফিক চৌধুরী »
জনসেবা, লড়াই-সংগ্রাম, ভালোবাসা আর সব ছাপিয়ে চাটগাঁ প্রেমের নাম মহিউদ্দিন চৌধুরী। যিনি আমৃত্যু চট্টগ্রামবাসির যে কোন যৌক্তিক দাবি আদায়ে লড়াই করেছেন আর পাশে থেকে সাহস যুগিয়েছেন নিরন্তর। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের আলোকে গণমানুষের জন্য নিজেকে গড়ে সঁপে দিয়েছিলেন। যে কারণে আমরা দেখি, সাধারণ নাগরিক নির্বিশেষে বিশেষ করে সমাজের অবহেলিত ও নিপীড়িত শ্রেণি মহিউদ্দিন চৌধুরী অন্তপ্রাণ।
১৫ ডিসেম্বর, চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার গহিরা গ্রামে ১ ডিসেম্বর ১৯৪৪ সালে জন্মগ্রহণকারী গণমানুষের জননেতা মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুবার্ষিকী।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শে অনুপ্রাণিত মহিউদ্দিন চৌধুরী কখনো তাঁর নীতি থেকে সরে আসেননি, সাধারণ মানুষের অধিকার আদায় করতে গিয়ে জেল-জুলুম হয়েছিল তাঁর নিত্য সঙ্গী, কিন্তু তা সত্ত্বেও কখনো আপোষ করেননি।
দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা হলো, আমাদের সমাজ ও রাজনীতিতে মহিউদ্দিন চৌধুরীর মতো মানুষ ও দেশ নিয়ে ভাবনার লোকের সংখ্যা ক্রমাগত কমছে। আর আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় দলের কোন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে গণমানুষের পক্ষে কথা বলার লোকতো প্রায় নেই বললেই চলে। মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন সেই হাতেগোনা ব্যতিক্রমীদের একজন। যেখানেই চট্টগ্রমাবাসীর দাবি উপেক্ষিত হয়েছে, সেখানেই ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন তিনি, সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে গিয়ে নিজ দলীয় সরকারের বিরুদ্ধেও আন্দোলনে পিছপা হননি তিনি। ’৯১ এর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী যখন বন্দরটিলা আর পতেঙ্গায় বাতাসে লাশের উৎকট পচা গন্ধে উদ্ধার তৎপরতা থেমে যাচ্ছিল, তখন রাজনৈতিক পরিচয় ছাপিয়ে মানবিক মহিউদ্দিন চৌধুরী কোমর বেঁধে নেমে পড়েছিলেন লাশ দাফন আর সৎকারে। চট্টগ্রাম বিমানবন্দরকে ইজারা দেওয়ার সর্বনাশী সিদ্ধান্ত, হোল্ডিং ট্যাক্স, ফিশারিঘাটের মৎস্যজীবীদের সমস্যা, সমুদ্রবন্দর নিয়ে যে কোন সর্বনাশী উদ্যোগের বিরোধিতা তা একমাত্র তাঁর দ্বারাই সম্ভব ছিল।
১৯৬৮-’৬৯ সালে আইয়ূববিরোধী গণআন্দোলনে চট্টগ্রামের রাজপথ উত্তাল করেছিলেন নগর ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি মৌলভী সৈয়দ ও সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন চৌধুরী।
এরপর ১৯৭১ সালের ২ মার্চ সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে লালদীঘির মাঠে অনুষ্ঠিত জনসভায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয় রাজনৈতিক বীর মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে। একাত্তরের ৭ মার্চ মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বেই চট্টগ্রামের ছাত্র-কর্মীরা যোগ দিয়েছিলেন তৎকালীন রেসকোর্সের জনসভায়। বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ কর্মী মহিউদ্দিন চৌধুরী পঁচাত্তরের পনের আগস্টের লোমহর্ষক ও মর্মান্তিক বিয়োগান্তিক ঘটনা মেনে নিতে পারেননি, তাই অন্য অনেকের মতো চুপ করে না থেকে প্রতিবাদী হয়েছেন আর তা করতে গিয়ে আটকও হয়েছিলেন।
পরবর্তীতে মুক্তি পেয়ে ইতিহাসের জঘন্যতম এই হত্যাকা-ের প্রতিশোধ নিতে ‘মুক্তি বাহিনী’ গঠন করেছিলেন, যার জেরে তদানিন্তন শাসকগোষ্ঠীর মামলা-হামলার মুখে কলকাতায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হোন। এ সব কিছুই ব্যক্তি মহিউদ্দিন চৌধুরীর পক্ষেই করা সম্ভব হয়েছিল, কারণ তিনি কখনো নীতি- আদর্শের সাথে আপোষ করতে শেখেননি।
তবে চাটগাঁর মানুষ তাঁদের প্রিয় নেতাকে তাঁর শেষ বিদায়ে ভালোবাসা জানাতে কার্পণ্য করেনি, তিনি যে সত্যিকার অর্থেই গণমানুষের নেতা ছিলেন তা টের পাওয়া গিয়েছিল তাঁর শেষ বিদায়ের ক্ষণে। মনে পড়ে, সেদিনের ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানের চেহারা ছিল পুরোই বিষণœ। দুপুর গড়াতেই সকলের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে গণমানুষের নেতা চট্টগ্রামবাসীর অতি আপনজন মহিউদ্দিন চৌধুরী যখন জনতার মাঝে এলেন, তখন চারিদিকে ছিল শুধুই মানুষের গ্রোত। সেই জনসমুদ্রে ছিলনা কোন স্লোগান, ছিলনা প্রিয় নেতার স্নেহপূর্ণ শাষন, ছিলনা নেতার বলিষ্ঠ কণ্ঠে জোরালো প্রতিবাদী ভাষণ, ছিল শুধু প্রিয় নেতা ও অভিভাবক হারিয়ে দল-মত ছাপিয়ে সকলের চোখ ভাসিয়ে জল, কেউ গুমরে কেঁদেছেন, কেউবা হাউমাউ করে কেঁদেছেন, কেঁদেছে বুঝি ময়দানও!
মানুষের প্রতি তাঁর অসীম মমত্ববোধ, ভালোবাসা আর সর্বোপরি চট্টগ্রামের প্রতি তাঁর সীমাহীন ভালোবাসা তাঁকে চট্টগ্রামবাসীর কাছে মহান করে তুলেছে। মহিউদ্দিন চৌধুরী জড়িয়ে আছেন এবং থাকবেন চাটগাঁর গণমানুষের হৃদয়জুড়ে। এমন একজন মহা নায়কের কথা লিখতে গিয়ে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় আবেগ জড়িয়ে ধরে বারবার। মহিউদ্দিন চৌধুরীর স্বপ্ন ছিল চট্টগ্রামের সামগ্রিক উন্নয়ন। এটা কেবল নিছক চাওয়া ছিলনা। তাঁর জন্য তিনি তাঁর পুরো জীবন নিঃশেষ করেছেন। আজকে যদি আমরা তাঁর মৃত্যু পরবর্তীতে সত্যিকারের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা জানাতে চাই, তবে আমাদের অবশ্যই তাঁর ভালোবাসা, আদর্শ আর ত্যাগকে জেনে আর তা হৃদয়ে ধারণ করে সে অনুযায়ী নিজেকে উজ্জীবিত করতে হবে। আজকে আমাদের ভাবনার সময় এসেছে, আমরা কি আদৌ মহিউদ্দিন চৌধুরী’র এই দেশের প্রতি ও চট্টগ্রামের জনগণের প্রতি তাঁর ভালোবাসাকে আমাদের নিজেদের মাঝে স্থান দিতে পেরেছি?
মহিউদ্দিন চৌধুরীর অকাল মৃত্যু আমাদের বেদনা ভারাক্রান্ত করে, মন মানতে চায় না। মনে হয়, তাঁর মতো এমন রাজনৈতিক আদর্শবান মানুষের এ মুহূর্তে ভীষণ প্রয়োজন। বাংলাদেশের স্বার্থে। চট্টগ্রামের জনগণের স্বার্থে। সর্বোপরি একটি আদর্শিক ও ন্যায়নিষ্ঠ সমাজ গঠনের স্বার্থে। তবে বঙ্গবন্ধুর যে আদর্শ তিনি ধারণ করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তা লালন করেছেন, তাকে আরও উঁচুতে তুলে ধরে আমরা যেন তাঁকে যুগ যুগ বাঁচিয়ে রাখি। পরপারে ভালো থাকুন আপনি, আপনার জন্য আমাদের শ্রদ্ধা আর উজাড় করা ভালোবাসা।
লেখক : বিতার্কিক
নড়ষড়ংযধভরয়ঁব@মসধরষ.পড়স
























































