মো. রেজাউল করিম আজাদ »
“চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল” চট্টগ্রাম শহরের আগ্রাবাদ এলাকায় অবস্থিত সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত একটি স্বেচ্ছাসেবী, জনহিতকর ও স্বাস্থ্য সেবামূলক হাসপাতাল। ১৯৭৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক শিশু বর্ষ উপলক্ষে চট্টগ্রামের কিছু মহৎ প্রাণ সমাজহিতৈষী ব্যক্তিবর্গের উদ্যোগে এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
চট্টগ্রামে একটি শিশু হাসপাতালের স্বúœ দেখেছিলেন মরহুম ডা. এ এফ এম ইউসুফ। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রধান কা-ারী ছিলেন দেশের খ্যাতনামা চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও সার্জন প্রফেসর ডা. এ এস এম ফজলুল করিম, যিনি বর্তমানে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের কার্যনির্বাহী কমিটির প্রেসিডেন্ট এর দায়িত্ব পালন করছেন। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে যিনি অক্লান্ত পরিশ্রম ও মেধা ব্যয় করেছিলেন তিনি হলেন সাবেক মন্ত্রী মরহুম ইঞ্জিনিয়ার এল. কে.সিদ্দিকী। তাঁর অবদান মা ও শিশু হাসপাতাল পরিবার কোন দিন ভুলবে না। তাঁর প্রচেষ্টায় ১০ শয্যা বিশিষ্ট অন্তঃবিভাগ শুরু হয়। এরপর ৩০ শয্যা এবং পরবর্তীতে ১০০ শয্যা বিশিষ্ট অন্তঃবিভাগ শুরু করা হয়। সাথে ছিলেন এক ঝাক নিবেদিত প্রাণ সমাজকর্মী। তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় আজকের এই চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল। ইতোমধ্যে এই হাসপাতাল সফলতার সাথে তার প্রতিষ্ঠার ৪১ বছর পার করেছে। বর্তমানে এটি সকল বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবা সহ ৬৫০ শয্যার একটি পূর্ণাঙ্গ জেনারেল হাসপাতাল হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে। হাসপাতালের অন্তঃ ও বহির্বিভাগে বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবা সহ সকল প্রকার চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হচ্ছে। প্রতিদিন সকাল ৮.০০ টা থেকে রাত ৮.০০ টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এছাড়া ২৪ ঘণ্টা ইমার্জেন্সি সার্ভিস, ব্লাড ব্যাংক, সাধারণ এ্যাম্বুলেন্স ও আইসিইউ এ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস ও ল্যাবরেটরী সার্ভিস সহ জরুরি সেবাসমূহ চালু রয়েছে। বর্তমানে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের অধীনে নি¤œবর্ণিত প্রকল্পসমূহ অত্যন্ত সফলতার সাথে পরিচালিত হচ্ছে।
চট্টগ্রাম মা-শিশু ও জেনারেল হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মা-ও-শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ , চট্টগ্রাম মা-ও-শিশু হাসপাতাল ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ, চট্টগ্রাম মা-ও-শিশু নার্সিং ইনস্টিটিউট, ঈগঙঝঐ শামসুন নাহার খান নার্সিং কলেজ, ঈগঙঝঐ অটিজম এন্ড চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার, ঈগঙঝঐ ক্যান্সার হাসপাতাল এন্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট ।
বৈশি^ক মহামারি করোনা চিকিৎসা সেবা ও চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল
করোনার সময় চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবায় এগিয়ে আসে। হাসপাতালের কার্যনির্বাহী কমিটির ৪৫৩ তম সভায় চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা প্রদানে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে নতুন হাসপাতাল ভবনের ৩য় তলায় সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন স্থাপন করা হয় এবং ৩য় তলায় ১ম পর্যায়ে ৩৪টি শয্যা করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবার জন্য প্রস্তুত করা হয়। গত ০৬/০৬/২০২০ ইং তারিখ আনুষ্ঠানিক ভাবে নতুন হাসপাতাল ভবনে করোনা ইউনিট চালু করা হয় এবং করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা শুরু করা হয়। করোনা রোগী বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে হাসপাতালের করোনা ইউনিটের শয্যা সংখ্যা ১০০ তে উন্নীত করা হয়। করোনা ইউনিটের জন্য আলাদা ভাবে ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য জনবল নিয়োগ দেয়া হয়। চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে ডাক্তার, নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন যা সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে সর্বমহলে ব্যাপক ভাবে প্রশংনিত হয়েছে।
আমরা কার্যনির্বাহী কমিটির পক্ষ থেকে করোনা ম্যানেজমেন্ট সেল, করোনা ট্রিটমেন্ট কমিটি, হাসপাতালের সর্বস্তরের ডাক্তার, নার্স, কর্মকর্তা কর্মচারীবৃন্দ, হাসপাতালের পরিচালক (প্রশাসন) তার টিম সহ প্রশাসনের সকল কর্মকর্তা কর্মচারীবৃন্দ, কার্যনির্বাহী কমিটির সম্মানিত সদস্যবৃন্দ সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। চট্টগ্রামের সর্বস্তরের জনগণ হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা কার্যক্রমে বিশেষ করে করোনা সেবা সহায়তায় ব্যাপক ভাবে এগিয়ে এসেছেন। প্রত্যেকে যার যার অবস্থান থেকে সর্বাত্মক ভাবে সহযোগিতার চেষ্টা করেছেন। বিশেষ করে হাসপাতালে প্রায় ৯০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে পিসিআর ল্যাব স্থাপনে একজন মহানুভব ব্যক্তি এগিয়ে এসেছেন। বর্তমানে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের আরটি পিসিআর ল্যাব অত্যন্ত সফল ভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এ যাবৎ পিসিআর ল্যাবে ২০৩৮ জন রোগীর করোনা পরীক্ষা করা হয়েছে। চট্টগ্রাম সহ দেশের বিভিন্ন ব্যক্তি/দাতার সহায়তায় করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবার জন্য ৫০টির অধিক হাই ফ্লো ন্যাজল ক্যানুলা আমরা অনুদান হিসেবে পেয়েছি, যা করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবায় অসাধারণ অবদান রেখেছে। বিভিন্ন শিল্প গ্রুপ, বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান যার যার অবস্থান থেকে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। করোনা মহামারিতে হাসপাতালের শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. সৈয়দ জাফর হোসাইন রুমি ও অবস অ্যান্ড গাইনি বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা. সুলতানা লতিফা জামান (আইরীন) সহ সারা দেশে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে করোনার ২য় ঢেউ শুরু হয়ে গেছে। করোনার ২য় ঢেউ মোকাবেলায় চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের নতুন ভবনের ৪র্থ তলায় ১৫টি অত্যাধুনিক কেবিন সহ আরো ৪০টি শয্যা প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রয়োজনে এই শয্যা সংখ্যা ১০০ এ উন্নীত করা যাবে। করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সহ প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বর্তমানে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল চট্টগ্রামে করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবায় একমাত্র আশা ও ভরসাস্থল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ঈগঙঝঐ ক্যান্সার হাসপাতাল এন্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট চট্টগ্রামে ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসা সেবার জন্য আমরা চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের অধীনে অন্যতম একটি প্রকল্প হিসেবে একটি অত্যাধুনিক ক্যান্সার হাসপাতাল ও রিসার্চ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এই ক্যান্সার হাসপাতালের জন্য হাসপাতাল ক্যাম্পাসে প্রয়োজনীয় জমি বরাদ্দ পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে ক্যান্সার হাসপাতাল নির্মাণের জন্য আর্কিটেক্চারাল ডিজাইন, স্ট্রাকচারাল ডিজাইন এর কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। আণবিক শক্তি কমিশন সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহের অনুমোদন পাওয়া গেছে।
চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের অধীনে এই ক্যান্সার হাসপাতাল নির্মিত হলে তা বৃহত্তর চট্টগ্রাম সহ এতদ অঞ্চলের ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসা সেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। এখানে বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য যে, চট্টগ্রামের বহুল প্রচারিত দৈনিক আজাদী পত্রিকার সম্পাদক জনাব এম এ মালেক উক্ত ক্যান্সার হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটির আহবায়ক ও হাসপাতালের ট্রেজারার জনাব মো. রেজাউল করিম আজাদ সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
৮৫০ শয্যা বিশিষ্ট নতুন হাসপাতাল ভবনের নির্মাণ কাজ আমাদের স্বপ্নের মেগা প্রকল্প ৮৫০ শয্যা বিশিষ্ট নতুন হাসপাতাল ভবনের ১৩ তলা পর্যন্ত স্ট্রাকচার নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ৬ষ্ঠ তলা পর্যন্ত ফিনিশিং কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। করোনা মহামারির কারণে নির্মাণ কাজে কিছুটা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হলেও বর্তমানে আবারো পুরোদমে নির্মাণ কাজ চলছে। বর্তমানে নতুন ভবনের ৩টি ফ্লোরে পিসিআর ল্যাব সহ করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম চলমান আছে। আমরা বিভিন্ন দানশীল ব্যক্তিবর্গ ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানসমূহের কাছে একেকটি ফ্লোর অথবা একেকটি ডিপার্টমেন্ট স্পন্সর করার জন্য সবিনয় অনুরোধ জানাচ্ছি।
আগামী ৩১ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের ৪১ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে হাসপাতালের সকল আজীবন সদস্য, পৃষ্ঠপোষক, ডোনার, ডাক্তার, নার্স, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি রইল প্রাণঢালা অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল তার স্বপ্নের অগ্রযাত্রায় বহুদূর এগিয়ে যাবে এই প্রত্যাশা করছি।
লেখক : ট্রেজারার, কার্যনির্বাহী কমিটি
ও মেম্বার সেক্রেটারী, ক্যান্সার হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটি