বিদেশি অপারেটরের হাতে চট্টগ্রাম বন্দর তুলে দেয়ার বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলনের তাগিদ দিয়েছেন চট্টগ্রামের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিশিষ্টজনেরা। তারা বলেছেন, বন্দর বিদেশি অপারেটরের হাতে দেয়া হলে দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হবে।
শুক্রবার বিকেলে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সুলতান আহমদ হলে প্রগতিশীল সামাজিক সংগঠন ‘প্রগতির যাত্রী’র আয়োজনে এক গোলটেবিল আলোচনায় তারা এসব কথা বলেন। ‘বেসরকারি পরিচালনায় চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল হস্তান্তরের প্রক্রিয়া : সম্ভাবনা ও ঝুঁকি’ শীর্ষক এ গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করা হয়।
আলোচনায় অংশ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন আছে। কিন্তু সেই প্রয়োজন কতটুকু জনকল্যাণ করবে সেই প্রশ্ন সবার আগে আসতে হবে। সর্বোপরি দেশের নিরাপত্তা ও স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে কোনো বিদেশি বিনিয়োগ কিংবা ব্যবসা করা যাবে না। চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশি অপারেটর আনার বিষয়ে যেসব আলোচনা হচ্ছে, তাতে দেশের স্বার্থকে খুব বেশি প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল আলম বলেন, বাংলাদেশের অবস্থা এমন হয়ে গেছে যে, অবিলম্বে আন্দোলনের মহাপরিকল্পনা করতে হবে। না হলে দেশকে বাঁচানো যাবে না। জ্বালানির কথাই যদি বলি, প্রতি টন এলপিজি কিনতে আমাদের লাগে ১২০ ডলার আর ভারতে লাগে শুধু ২০ ডলার। পায়রা, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র চলছে না। কারণ কয়লা কেনার টাকা নেই। অথচ আদানির বিদ্যুৎ কিনতে দ্বিগুণ টাকা খরচ করতে হচ্ছে, কিনছিও। এগুলো আমাদের ভাবতে হবে।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের সহকারী সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, আমরা ইচ্ছে করে ঘরের চাবি পরের হাতে তুলে দিচ্ছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলাম, জ্বালানি অপরাধীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হবে, বন্দরে যারা ডেকে বিদেশি অপারেটর নিয়ে আসছে তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হবে।
রতন আরও বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর শুধু একটি বন্দর নয়। এর সঙ্গে আমাদের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব জড়িত। এমন একটি স্থাপনা যারা বিদেশিদের হাতে তুলে দিতে চান, তারা আর যা-ই হোক দেশপ্রেমিক নয়। একসময় আমরা দেশপ্রেমিক বিদেশি ডাকাতের খপ্পড়ে পড়েছিলাম। তারা বাংলা থেকে ধনসম্পদ লুট করে নিজের দেশে নিয়ে যেত। আর এখন আমরা বিদেশপ্রেমিক দেশিয় ডাকাতদের খপ্পড়ে পড়েছি। চট্টগ্রাম বন্দরের একটি কিংবা দু’টি টার্মিনাল বিদেশি অপারেটরের হাতে দেয়ার কথা এখন বলছে। আস্তে আস্তে পুরো বন্দর তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। তখন বিদেশ থেকে আর স্যাংশন দিতে হবে না, এই বিদেশি অপারেটররাই স্যাংশন দিয়ে দেবে। তেলের জাহাজ তারা একমাস অপারেট করল না। ভোগ্যপণ্যের জাহাজ সাগরে ভাসিয়ে রাখল। দেশের পরিস্থিতি কী হবে একবার ভাবুন।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, বন্দরটা নির্দিষ্ট একটি শ্রেণির হাতে জিম্মি হয়ে গেছে ওয়ান ইলেভেনের সময় থেকে। এখানে টার্মিনাল ও বার্থ নির্দিষ্ট অপারেটর দিয়ে বছরের পর বছর অপারেট করা হচ্ছে। নতুন কেউ যদি কাজ করতে চায়, এমনভাবে অভিজ্ঞতার শর্ত জুড়ে দিচ্ছে, যাতে তারা অংশ নিতে না পারে। নতুন কাউকে সুযোগ দেয়া হচ্ছে না, তাহলে অভিজ্ঞতা আসবে কোত্থেকে? এভাবে বন্দরকে জিম্মি করে ফেলা হয়েছে। কারণ এখানে প্রতিযোগিতার সুযোগ নেই। বলছি না, বাইরের কেউ আসুক। বলছি দক্ষতা বাড়াতে হবে। কিন্তু প্রতিযোগিতার সুযোগ না থাকলে দক্ষতা বাড়বে কিভাবে? দেশিয় অপারেটরদের সুযোগ দেয়া হচ্ছে না, বাইরের অপারেটর নিয়ে আসার তোড়জোড় হচ্ছে। বন্দর নিজেরা করছে না কেন? তারা বড় বড় অফডক কেন করছে না? এত বড় বড় মেগাপ্রজেক্ট হচ্ছে, বন্দরের সব গেইটে স্ক্যানার কেন বসানো হচ্ছে না?
ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, চট্টগ্রামের সভাপতি তপন দত্ত বলেন, এখানে শ্রমিক স্বার্থের ব্যাপার আছে। ওয়ান ইলেভেনে বন্দরে শ্রমিকদের এক ইউনিয়ন করে শ্রমিকদের আন্দোলনকে সুকৌশলে দমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন আর বন্দরে কোনো শ্রমিক সংগঠন নেই। তাই কোনো আন্দোলন হয় না। শ্রমিকদের মধ্যে পরস্পর সহমর্মিতা নেই। বন্দরকে রক্ষা করতে বন্দরের শ্রমিকদের সংগঠিত করতে হবে।
সিপিবি চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, বন্দর যে কারণে হ্যান্ডলিংয়ের জন্য বিদেশি অপারেটরের হাতে দিতে চাচ্ছে, সে সক্ষমতা নিজেদের বৃদ্ধি করে না কেন?
দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান বলেন, আমেরিকার এস এস এ কোম্পানিকে যখন বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো, তখন আমরা আন্দোলন করেছিলাম। রক্ষা করেছিলাম সেদিন বন্দর। চট্টগ্রাম বন্দর নিয়েই বাংলাদেশের অর্থনীতি। রাজনৈতিক কারণে, অর্থনৈতিক ফায়দার জন্য বন্দরকে নিয়ে ব্যবসা করা হলে সেটা সুখকর হবে না। চট্টগ্রামের নাগরিক হিসেবে বন্দরকে দেখভাল করার দায়িত্ব আমাদের সবার।
ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, ‘বে টার্মিনাল করার যখন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে তখন বলা হয়েছিলো এটা সরকার চালাবে। এটা বেসরকারিভাবে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মাতারবাড়িও দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
গোলটেবিল আলোচনায় মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন প্রকৌশলী প্রকাশ ঘোষ। প্রগতির যাত্রীর সংগঠক নুপুর ধরের সঞ্চালনায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সিনিয়র সাংবাদিক জসিম উদ্দিন চৌধুরী সবুজ, অধ্যাপক হোসাইন কবির, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস এর সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট নাজিম উদ্দিন শ্যামল, দৈনিক আজাদীর সিনিয়র সাংবাদিক হাসান আকবর, সিএন্ডএফ মালিক সমিতির ইপিজেড শাখার সভাপতি লুৎফুল আজিম, ডা. আরিফ বাচ্চু, প্রাইম মুভার শ্রমিক ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাসান মাহমুদ প্রমুখ। বিজ্ঞপ্তি