সুপ্রভাত ডেস্ক »
গত ১৮ নভেম্বর থেকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ডাম্পিং ইয়ার্ডে বিদেশ থেকে আমদানি করা প্রায় ৫ লাখ কেজি ফল ও মসলা জাতীয় পণ্য ধ্বংস করছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ২০২৩ সাল থেকে ১১ জন ব্যবসায়ী ২১টি কন্টেইনারে করে এসব পণ্য আমদানি করেন। প্রায় ৪ কোটি টাকা আমদানি শুল্ক ও অন্যান্য খরচসহ এসব পণ্যের মূল্য প্রায় ১২ কোটি টাকা।
আমদানিকারক খালাস না নেওয়ায় পরবর্তীতে কাস্টমসও সময়মতো এসব পণ্যের নিলাম করতে পারেনি। আবার কম দাম পাওয়ার অজুহতে সেগুলো বিক্রিও হয়নি।
এভাবে আমলাতন্ত্রিক জটিলতায় চট্টগ্রাম বন্দরে ক্রমাগত স্তূপ জমছে নিলামযোগ্য পণ্যের। সবশেষ ২০ নভেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর ইয়ার্ডে নিলামযোগ্য কন্টেইনার ছিল ৯,৭৮৬ টিইইউ। এদিন বন্দর ইযার্ডে মোট আমদানি কন্টেইনার রয়েছে ৩০,৮৪১ টিইইউ।
অর্থাৎ, চট্টগ্রাম বন্দর ইয়ার্ডে মোট সংরক্ষিত কন্টেইনারের মধ্যে প্রায় ৩২ শতাংশ কন্টেইনারই নিলামযোগ্য। বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, এসব কন্টেইনার ২০০৪ সালের পরবর্তী সময়ে আমদানি করা।
আমদানিকারক এবং নিলাম ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতি টিইইউ কন্টেইনারে গড়ে ২২ মেট্রিক টন হিসেবে নিলামযোগ্য ৯,৭৮৬ টিইইউ কন্টেইনারে রয়েছে ২ লাখ ১৫ হাজার টনের বেশি পণ্য। প্রতি কন্টেইনারে ৪০ লাখ টাকা পণ্য হিসেবে এসব পণ্যের দাম ৩,৯০০ কোটি টাকার বেশি হতে পারে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ২০ নভেম্বর নিলামযোগ্য কন্টেইনার ছিল ৮,২৭০ টিইইউ। ২০২৪ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে এক বছরে নিলামযোগ্য কন্টেইনার সংখ্যা বেড়েছে ১,৫১৬ টিইইউ।
২০১৮ সালের ২০ নভেম্বর বন্দরে নিলামযোগ্য কন্টেইনার ছিল ৬,৬০০ টিইইউ। প্রতিবছর বাড়ছে এই সংখ্যা। ৬ বছরে বন্দরে নিলামযোগ্য কন্টেইনার বেড়েছে ৩,১৮৬ টিইইউ।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ২০ নভেম্বর ৭,১৩৮ টিইইউ; ২০২০ সালের ২০ নভেম্বর ৮,৯৩২ টিইইউ; ২০২১ সালের ২১ নভেম্বর ৬,৯৪০ টিইইউ; ২০২২ সালের ২০ নভেম্বর ৭,৩৫৯ টিইইউ; ২০২৩ সালের ২০ নভেম্বর ৮,২৭০ টিইইউ এবং ২০২৪ সালের ২০ নভেম্বর ৯,৭৮৬ টিইইউ নিলামযোগ্য কন্টেইনার ছিল বন্দর ইয়ার্ডে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান শফিকুল আলম জুয়েল বলেন, “বছরের পর বছর নিলাম নিষ্পতি না হওয়ায় কন্টেইনারগুলো অহেতুক বন্দরে আটকে আছে। এর ফলে কন্টেইনার গুলোতে আমদানি রপ্তানি পণ্য বোঝাই করা যাচ্ছে না। কন্টেইনারের ভাড়াও পাওয়া যাচ্ছে না। এতে আর্থিক লোকসান গুনতে হচ্ছে শিপিং লাইনগুলোকে।”
তিনি আরো বলেন, “পণ্য ডেলিভারি না নেওয়ার ৩০ দিন পর নিলামে তোলার কথা থাকলেও বছরের পর বছর সেগুলো নিলামে তোলা হয় না। কাস্টমসের এমন ধিরগতির খেসারত দিচ্ছে শিপিং কোম্পানিগুলো।”
বার বার নিলাম দিয়েও হয় না পণ্য বিক্রি
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস একটি পণ্য চালান ২৭ বারের অধিক নিলামে তোলারও নজির রয়েছে। বার বার নিলামে তুলতে গিয়ে একদিকে নিলাম সংক্রান্ত খরচ বাড়ে, অন্যদিকে পণ্য নষ্ট হয়ে দাম পাওয়া যায় না। উল্টো টাকা খরচ করে সেগুলো ডাম্পিং স্টেশনে ধ্বংস করতে হয়।
নিলাম ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, কাস্টমসের নিলাম কমিটির মনগড়া সিন্ধান্তের কারণে পণ্যগুলো বিক্রি হচ্ছেনা। এ কারণে দরদাতারা নিলামে অংশ নিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
২০০৭ সালে আমদানি হওয়া ২০১০ কেজি ওজনের কেমিক্যাল পণ্য ২০২২ সালের ২৩ জানুয়ারিতে ২৭ বারের মতো নিলামে তোলে কাস্টস। পণ্যটি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পরবর্তীতে তা ধ্বংস করা হয়। ৩ লাখ ৩১ হাজার টাকার কেমিক্যাল ১৫ বছর ধরে নিলামে নিষ্পত্তি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যায়।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের নিলাম পরিচালনাকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান কে এম কর্পোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, নিলাম পরিচালনার খরচ এবং কাস্টমস নিলামে পণ্য বিক্রি থেকে ০.১১ শতাংশ হারে টাকা পায় কেএম কর্পোরেশন। প্রতিবার নিলামে অন্তত ৪টি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন, লজিস্টিকস সাপোর্ট, স্টাফ কর্মচারীদের বেতন ও আনুষাঙ্গিক ব্যয় মাসে প্রায় ৩ লাখ টাকার বেশি।
কাস্টমস সূত্র জানায়, নিলামে দরদাতা কাস্টমসের সংরক্ষিত মূল্যের ৬০ ভাগ এর নিচে দাম দিলে পণ্য অনুমোদন না দেওয়ার বিধান রয়েছে। ফলে ৬০ শতাংশ দাম না পাওয়ায় বার বার পণ্য নিলামে তুলেও বিক্রি করতে পারছে না কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম কাস্টমস নিলাম ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইয়াকুব চৌধুরী বলেন, “পণ্যের গুণগত মান অনুযায়ী সংরক্ষিত মূল্য অনেক বেশি থাকে। এ কারণে ক্রেতারা আগ্রহী থাকেন না। কারণ ব্যবসায়ীরা এসব পণ্য ব্যবহারের জন্য কেনন না। তারা বিক্রির জন্য কেনেন।”
“কেউ তো লোকসানের উদ্দেশ্যে কেনেন না। কাস্টমসের নিয়াম-কানুনের কারণে অনেকবার নিলামে তুলেও পণ্য বিক্রি হয় না। এরপর শেডে পড়ে থাকতে থাকতে, গুণগত মান দিন দিন আরও খারাপ হয়,” যোগ করেন তিনি।
২১৮ রাসায়নিক পণ্যবাহী কন্টেইনার বাড়াচ্ছে বন্দরের নিরাপত্তা ঝুঁকি
বন্দরের বিভিন্ন ইয়ার্ডে ২১৮টি কনটেইনারে সালফিউরিক অ্যাসিড এবং সোডিয়াম ও পটাশিয়াম হাইড্রোক্সাইডের মতো বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে। ১৫ থেকে ২০ বছরের পুরনো এসব রাসায়নিক কনটেইনার ভেঙে বাইরে গড়িয়ে পড়ছে। দীর্ঘদিন ধরে ও খালাসকৃত রাসায়নিক পণ্য বন্দরে থাকায় সেখানে তৈরি হয়েছে নিরাপত্তা ঝুঁকি।
তবে এই ২১৮ কন্টেইনারের বাইরে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি ১৫ বছরের পুরোনো অতিদাহ্য সোডিয়াম নাইট্রোক্লোরাইড পরিবাহী ৪টি ট্যাংক কন্টেইনার গত ২৭ অক্টোবর নিলামের মাধ্যমে ডেলিভারি দেয়। বিপদজনক পণ্য পরিবাহিত ৯টি কন্টেইনার শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দরের মাধ্যমে ধ্বংস করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান নিলামযোগ্য পণ্যের বিষয়ে মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “২০০৪ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে পড়ে থাকা পুরোনো নয় হাজার কন্টেইনার ধ্বংস/নিষ্পত্তির কাজ শুরু করা হয়েছে। নিলামযোগ্য অখালাসকৃত গাড়ি, কার্গো ও কন্টেইনারসমূহ জরুরি ভিত্তিতে নিলাম নিস্পত্তির শুল্ক কর্তৃপক্ষের সাথে কয়েক দফা পত্র যোগাযোগ হয়েছে।”
বিষয়টি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের নজরে আনা হয়েছে বলে জানান তিনি। খবর টিবিএসছবি: সংগৃহীত।
খালাস না হওয়া ১২১টি গাড়ি কেটে স্ক্র্যাপ করেছে কাস্টমস
এদিকে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি হওয়া প্রায় ১২১টি গাড়ি কেটে স্ক্র্যাপ করেছে কাস্টমস। নানান জটিলতায় খালাস না নেওয়া এসব গাড়ি ৪০ বছর ধরে পড়ে থাকায় নষ্ট হয়ে যায়। এসব গাড়ির মধ্যে চল্লিশ বছর আগের আমদানি করা গাড়িও রয়েছে।
এসব গাড়ির মধ্যে একটি মার্সিডিজ বেঞ্জ ব্রান্ডের কারও রয়েছে। মাইক্রো বাস, প্রাইভেট কার, ডাম্পার ট্রাক, মিনি পিকআপ, টয় কার, ড্রাম ট্রাক, ডাবল কেবিন পিকআপ, সুইপার লরি, আইপি গ্যাস ভাউচার, এসি বাস, মিনি কাভার্ড ভ্যান, জিপ গাড়িগুলো কেটে স্ক্র্যাপ করে কাস্টমসের নিলাম শাখায় স্তূপ করে রাখা হয়েছে। সেগুলো এখন কেজি দরে বিক্রি করবে কাস্টমস।
নিলামে পণ্য বিক্রি না হওয়ার বিষয়ে যা বলছে কাস্টমস
কাস্টমস জানিয়েছে, নিয়মানুযায়ী প্রথম দরপত্রে যদি কোনো পণ্যের দাম ৬০ শতাংশ না ওঠে, তবে তা অনুমোদন হবে না। দ্বিতীয় নিলামে যদি প্রথম দরপত্রের চেয়ে বেশি দাম পাওয়া যায়, তবে বিক্রির সুযোগ রয়েছে। এরপর তৃতীয়, চতুর্থ বা পর্যায়ক্রমে পরের দরপত্রে দাম কমানোর সুযোগ রয়েছে।
এদিকে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সৃষ্টি করে নিলামে পণ্য বিক্রিতে অহেতুক জটিলতা তৈরি করেন কাস্টম কর্মকর্তারা। পণ্য বিক্রির বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা মূল্য নির্ধারণ করার এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে নিলাম কমিটিকে। এই বিধানকে ব্যবহার করে তারা পণ্যের দাম কমান না। তাই পণ্যগুলো বারবার নিলামে তুলেও ক্রেতা পাওয়া যায় না।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের ডেপুটি কমিশনার সাইদুল ইসলাম জানান, চট্টগ্রাম কাস্টমস নিলামযোগ্য পণ্যজট কমাতে নিয়মিত নিলাম, অনলাইন নিলামের পাশাপাশি পঁচনশীল পণ্যের স্পট নিলামের আয়োজন করছে।
তিনি বলেন, “অনেক সময় মামলা সংক্রান্ত জটিলতায় পণ্য খালাস সম্ভব হয় না। আবার কাস্টম নিলামে পণ্য বিক্রির সিন্ধান্ত দিলেও পণ্যের মান নষ্ট হয়ে যাওয়ায় প্ল্যান্ট কোয়ারেন্টাইন স্টেশন পণ্য ছাড়ের অনুমোদন দেয় না।”