জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ কোনো না কোনো মানসিক রোগে ভুগছেন। আর শিশু-কিশোরদের মধ্যে এ হার ১২ দশমিক ৬ শতাংশ। আক্রান্তের এ পরিসংখ্যানের বিপরীতে দেশে সাইকিয়াট্রিস্ট বা মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সংখ্যা মাত্র ৩৫০ জন। অর্থাৎ দেশে প্রায় প্রতি ছয় লাখ মানুষের জন্য একজন বিশেষজ্ঞ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশে মানসিক রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষত তরুণ-তরুণীদের বেশি আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনে সংকট, মাদকাসক্তি, সামাজিক সম্পর্কের অবনতি, উদ্বেগ, আতঙ্ক, মস্তিষ্কের বিকাশে বাধা, ডিজিটাল ডিভাইসে আসক্তিসহ বিভিন্ন কারণে নানা বয়সের মানুষ মানসিক রোগের ঝুঁকিতে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের প্রকাশ করা ‘মানসিক স্বাস্থ্য: বাংলাদেশের তথ্যচিত্র-২০২৫’-এ বলা হয়েছে, দেশের মানসিক রোগে আক্রান্ত প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে বিষণ্নতায় ভোগেন ৬ দশমিক ৭ শতাংশ, উদ্বেগজনিত রোগে আক্রান্ত ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। এছাড়া সোমাটিক সিম্পটম ডিজঅর্ডারে (ব্যথা, দুর্বলতা, ক্লান্তি) ২ দশমিক ৩ শতাংশ, অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডারে (ওসিডি) শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ, বাইপোলার ডিজঅর্ডারে (মুড বা মনের অবস্থা ওঠানামা করা) শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ, সিজোফ্রেনিয়া ও অন্যান্য সাইকোটিক ডিজঅর্ডারে ১ শতাংশ ও মাদকাসক্তি রোগে আক্রান্ত শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ।
শিশু-কিশোররাও আক্রান্ত হচ্ছে মানসিক সমস্যায়। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের তথ্যমতে, দেশের শিশু-কিশোরদের মানসিক সমস্যার মধ্যে শীর্ষে আছে নিউরোডেভেলপমেন্ট ডিজঅর্ডার। এ রোগে আক্রান্তের হার ৫ দশমিক ১ শতাংশ। এটি এক ধরনের মানসিক ও স্নায়বিক সমস্যা, যা সাধারণত শিশু বয়সেই শুরু হয় এবং মস্তিষ্কের বিকাশ ও কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করে। এরপর যথাক্রমে রয়েছে উদ্বেগজনিত রোগ (অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার), আক্রান্তের হার ৪ দশমিক ৭ শতাংশ এবং কন্ডাক্ট ডিজঅর্ডার, ১ দশমিক ৭ শতাংশ।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। কর্মসংস্থান, শিক্ষাব্যবস্থাসহ আরো কিছু খাতে অনিশ্চয়তা কেটে গিয়ে নিরাপত্তা, সম্মানবোধ জাগ্রত হলে অনেক কিছু সুস্থ হয়ে উঠবে। এরই মধ্যে যারা সমস্যার মধ্যে আছেন, তাদের জন্য সমন্বিতভাবে একটা সেবা চালু করা দরকার। সেটা সরকারি-বেসরকারি উভয়ভাবেই হতে পারে। দেশব্যাপী সাধারণ যে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা রয়েছে, সেখানে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টা যোগ করা যেতে পারে। যোগ্য পেশাজীবীরা থাকলেও তাদেরকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে না। যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক তারা যেন দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যসেবার দিকেও নজর দেন।’
পশ্চিমা বিশ্বে শারীরিক অসুস্থতার পাশাপাশি মানসিক অসুস্থতার চিকিৎসার সুযোগ অবারিত। কিন্তু আমাদের দেশের পরিস্থিতি খুবই শোচনীয়। সরকারকে মনোযোগ দেওয়া দরকার।
করোনার অভিঘাত কাটিয়ে উঠতে না উঠতে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাবে মানুষকে দিশেহারা অবস্থায় থাকতে হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। এরমধ্যে গত বছর রাজনৈতিক আন্দোলন, সরকার পরিবর্তন এবং তারপর সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা খুব করুণ। কিন্তু দুঃখজনক হলো দেশে মানসিক রোগের চিকিৎসার সুযোগ অত্যন্ত সীমিত ও অপ্রতুল।