নিজস্ব প্রতিবেদক »
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের দ্বিতীয় দিনে ৮টি আসনে ১৪ জন প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে। এরমধ্যে ৫ জন প্রার্থী বিভিন্ন দলের এবং ৯ জন প্রার্থী স্বতন্ত্র। দুদিনে মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই শেষে চট্টগ্রামের ১৬ আসনে মোট ১১৬ জনের প্রার্থিতা বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।
প্রার্থীদের জমা দেওয়া ১ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর, আয়কর ও ঋণের তথ্য ত্রুটিপূর্ণ থাকায় তাদের মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে। তবে বাতিল হওয়া প্রার্থীরা ৫ থেকে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত তাদের মনোনয়ন বৈধতার জন্য আপিল করতে পারবেন বলে জানান রিটার্নিং কর্মকর্তা।
গতকাল সোমবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে এ মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই করা হয়।
জানা যায়, চট্টগ্রামের মোট ১৬টি আসনে মোট মনোনয়নপত্র জমা পড়েছিল ১৪৮টি। এর মধ্যে বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে দুদিনে চট্টগ্রামের ৬টি আসনের মোট ৬০টি মনোনয়নপত্র বাছাই করে ৪৪টি বৈধ এবং ১৬টি বাতিল করা হয়। আর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে চট্টগ্রামের ১০টি আসনের ৮৮টি মনোনয়নপত্র বাছাই করে ৭২টি বৈধ ও ১৬টি বাতিল করা হয়।
প্রথম দিনে মনোনয়ন অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে মিরসরাই সংসদীয় আসনে ১ জন, ফটিকছড়িতে ৩ জন, সন্দ্বীপে ২ জন, সীতাকু-ে ৪ জন, হাটহাজারীতে ২ জন, রাউজানে ১ জন, বোয়ালখালী-চান্দগাঁওয়ে ৫ জন। এরমধ্যে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের প্রার্থী মৌলভী রশিদুল হকের মনোনয়নপত্রে আয়কর সংক্রান্ত সমস্যা থাকলেও পরে তিনি রিটার্নিং অফিসারের দেওয়া সময়ের মধ্যে ঠিক করে নেন।
দ্বিতীয় দিনে বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালী-বাকলিয়া) আসনে সব প্রার্থীর মনোনয়ন বৈধ হলেও চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং) আসনে ৪ জনের ও চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর) আসনে ১ জনের মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনিয়া) ও চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ) আসনে সব প্রার্থীর মনোনয়ন বৈধ পাওয়া যায়। তবে চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনে ৩ জন, চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া- লোহাগাড়া) আসনে ৩ জন ও চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনে ৩ জনের মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে।
যেসব আসনে সবার মনোনয়ন গৃহীত
চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনিয়া), চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালী-বাকলিয়া) ও চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ) আসনে মনোনয়ন জমা দেওয়া ২১ জন প্রার্থীর মনোনয়ন বৈধতা পেয়েছে। এরমধ্যে বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয় থেকে বৈধ হয়েছে চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালী-বাকলিয়া) আসনের ৭ জন প্রার্থীও মনোনয়ন। তারা হলেন- ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল (আওয়ামী লীগ), মুহাম্মদ ওয়াহেদ মুরাদ (ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ), মিটুল দাশগুপ্ত (ন্যাপ), সৈয়দ আবু আজম (ইসলামী ফ্রন্ট), মুহাম্মদ নুরুল হুসাইন (বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি), সুজিত সরকার (তৃণমূল বিএনপি) ও সানজীদ রশীদ চৌধুরী (জাতীয় পার্টি)।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে থেকে চট্টগ্রাম-৭ ও ১৪ আসনে যথাক্রমে ৬ জন ও ৮ জন প্রার্থীর মনোনয়ন বৈধতা পেয়েছে।
চট্টগ্রাম-৭ আসনে- ড. হাছান মাহমুদ (আওয়ামী লীগ), মো. মোরশেদ আলম (বিএসপি), আহমেদ রেজা (ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ), খোরশেদ আলম (তৃণমূল বিএনপি), মুছা আহমেদ রানা (জাতীয় পার্টি) ও মুহাম্মদ ইকবাল হাছান (বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট)।
চট্টগ্রাম-১৪ আসনে- মো. নজরুল ইসলাম চৌধুরী (আওয়ামী লীগ), মো. আবদুল জব্বার চৌধুরী (স্বতন্ত্র), মোহাম্মদ আবুল হোছাইন (ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ), সেহাব উদ্দিন মুহাম্মদ আবদুস সামাদ (বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট), মো. গোলাম ইসহাক খান (বিএনএফ), মোহাম্মদ আয়ুব (বিএসপি), আবু জাফর মোহাম্মদ ওয়ালী উল্লাহ (জাতীয় পার্টি) এবং মোহাম্মদ আলী ফারুকী (বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন)।
চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং)
এ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও নগর যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ফরিদ মাহমুদ, স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. ওসমান গনি ও ফয়সাল আমীন মনোনয়নপত্রের সঙ্গে ত্রুটিপূর্ণ এক শতাংশ ভোটারের নাম ও স্বাক্ষর জমা দেওয়ায় এবং বিএনএফের মঞ্জুরুল ইসলামের সমর্থনকারীর তথ্য না থাকায় মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে।
এ আসন মনোনয়ন বৈধ হয়েছে- মহিউদ্দিন বাচ্চু (আওয়ামী লীগ), সাবেক মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলম (স্বতন্ত্র), মো. ফেরদৌস রশিদ (তৃণমূল বিএনপি), মুহাম্মদ আলমগীর ইসলাম বঈদী (বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট), আবুল বাশার মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন (ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ), মিজানুর রহমান (বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট), জহুরুল ইসলাম (জাতীয় পার্টি), মো. আনিসুর রহমান (জাসদ) ও মঞ্জুরুল ইসলাম (বিএনএফ) ।
চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর)
এক শতাংশ ভোটারের তথ্য গরমিল থাকায় স্বতন্ত্র প্রার্থী রেখা আলম চৌধুরীর মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে। এ আসনে মনোয়নয়ন বৈধ হয়েছে- এম আবদুল লতিফ (আওয়ামী লীগ), মো. জসিম উদ্দিন (জাসদ), আবুল বসার মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন (বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট), মো. মহি উদ্দিন (বিএসপি), জিয়াউল হক সুমন (স্বতন্ত্র), দীপক কুমার পালিত (তৃণমূল বিএনপি), নারায়ণ রক্ষিত (এনপিপি) ও উজ্জ্বল ভৌমিক (গণফোরাম)।
চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া)
এ আসনে তিন প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করা হয়। এরমধ্যে এক শতাংশ ভোটারের তথ্যে গরমিলের অভিযোগে স্বতন্ত্র প্রার্থী ইলিয়াস মিয়া ও গোলাম কিবরিয়া চৌধুরীর মনোনয়ন বাতিল করা হয়। বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের প্রার্থী এম এ মতিনের বিদ্যুৎ বিল বাকি থাকায় মনোনয়ন বাতিল হয়।
মনোনয়ন বৈধ হয়েছে- দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী (আওয়ামী লীগ), সামশুল হক চৌধুরী (স্বতন্ত্র), এম এয়াকুব আলী (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন), মো. নুরুচ্ছফা সরকার (জাতীয় পার্টি), কাজী মুহাম্মদ জসীম উদ্দিন (ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ), রাজীব চৌধুরী (তৃণমূল বিএনপি) ও সৈয়দ মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন (বাংলাদেশ কংগ্রেস)।
চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া)
এ আসনে ভোটারের তালিকায় গড়মিল থাকায় দুই স্বতন্ত্র প্রার্থী এম এ মোতালেব ও আ ম ম মিনহাজুর রহমানের মনোনয়ন অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) প্রার্থী ফজলুল হক আয়কর রির্টান দাখিল না করা এবং মনোনয়নপত্র অসম্পূর্ণভাবে জমা দেওয়ার জন্য বাতিল হয়েছে।
এ আসনে মনোনয়ন বৈধ হয়েছে- আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী (আওয়ামী লীগ), মোহাম্মদ ছালেম (জাতীয় পার্টি), ফজলুল হক (এনপিপি), মো. সোলাইমান কাশেমী (বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি), মোহাম্মদ হারুণ (ইসলামিক ঐক্যজোট), মো. জসীম উদ্দিন (মুক্তিজোট) ও মুহাম্মদ আলী হোসাইন (বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট)।
চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী)
এ আসনে ঋণখেলাপি হিসেবে দুইজন ও আয়করের রির্টান দাখিল না করার কারণে একজনের মনোয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। ঋণখেলাপির অভিযোগে বাতিল হয়েছে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী ও বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি প্রার্থী আশীষ কুমার শীলের মনোনয়নপত্র। এছাড়া আয়কর রির্টান দাখিল না করায় ইসলামী ঐক্যজোটের মো. শফকত হোসাইন চাটগামীর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে।
এ আসনে মনোনয়ন বৈধ হয়েছে- মোস্তাফিজুর রহমান (আওয়ামী লীগ), মুজিবুর রহমান সিআইপি (স্বতন্ত্র), মো. খালেকুজ্জামান (স্বতন্ত্র), আব্দুল্লাহ কবির (স্বতন্ত্র), মোহাম্মদ এমরানুল হক (স্বতন্ত্র), মুহাম্মদ মামুন আবছার (এনপিপি), আবদুল মালেক (ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ), মো. মহিউল আলম চৌধুরী (বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট), কামাল মোস্তফা চৌধুরী (জাসদ), এম জিল্লুর করিম শরীফি (বাংলাদেশ কংগ্রেস)।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ও নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের দ্বিতীয়দিনে যে ১৪টি মনোনোয়ন বাতিল বলে গণ্য করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্যই স্বতন্ত্র প্রার্থী। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভোটার সমর্থকদের তালিকায় গরমিল থাকায় মনোনয়নগুলো বাতিল করা হয়। এছাড়া রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের অনেকের ট্যাক্স রিটার্ন, বিদ্যুৎ বিলসহ বিভিন্ন কাগজের ঘাটতি দেখা যায়। যাদের মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে তারা চাইলে নির্বাচন কমিশনে আপিল করতে পারবেন। ৫ ডিসেম্বর থেকে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ আপিল করা যাবে।’
হুইপ সামশুলের শিক্ষাগত সনদ নিয়ে প্রশ্ন
মনোনয়ন যাচাই-বাছাই কালে স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং বর্তমান সংসদ সদস্য হুইপ সামশুল ইসলাম চৌধুরীর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আইনজীবী মুজিবুল হক। সঙ্গে সঙ্গেই হুইপের ছেলে শাহরুন চৌধুরী তার বাবার প্রত্যয়ন পত্র উপস্থাপন করেন।
তখন জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মো. ফখরুজ্জামান বলেন, ‘আপিল করলে তা যথাযথভাবে করতে হয়। এ মুহূর্তে যাচাই-বাছাই করে তার মনোনয়ন বৈধ ঘোষণা করা হলো। তবে চাইলে আপনারা নির্বাচন কমিশন বরাবর আপিল করতে পারেন।’
পরে অ্যাডভোকেট মুজিবুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘মনোনয়ন ফরমে তিনি শিক্ষাগত যোগ্যতা দিয়েছেন এইচএসসি পাস। যে সনদটি দাখিল করেছেন, সেখানে ক্রমিক নম্বর ও রোল নম্বর নেই। আবার বর্তমানে তিনি জাতীয় সংসদে হুইপের দায়িত্ব পালন করছেন। সেখানে তার শিক্ষাগত স্ট্যাটাস দেখিয়েছেন বি-কম পাস। সব মিলিয়ে তার শিক্ষাগত সনদ নিয়ে আপত্তি রয়েছে।’
বিষয়টি নিয়ে আপিল করবেন কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এখানে যেহেতু আপত্তি তোলা হয়েছে তাই কোনোভাবে আপিল না করার সুযোগ নেই। তবে এ ব্যাপারে আমার প্রার্থীর সঙ্গে আলাপ আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
হুইপের ছেলে নাজমুল হাসান চৌধুরী শারুন বলেন, ‘মনোনোয়ন দেওয়ার সময় বাবার শিক্ষাগত সনদ জমা দেওয়া হয়েছিল। ওগুলো অনেক পুরোনো। এটা নিয়ে কেনো প্রশ্ন করা হলো বুঝতে পারছি না।