রতন কুমার তুরী :
সাহিত্যের উৎসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন উৎস হচ্ছে লোকসাহিত্য। যে জাতির লোকসাহিত্য যতো সমৃদ্ধ সেই জাতির সাহিত্যও ততো উর্বর। পৃথিবীর লোকসাহিত্যসমূহ বেশিরভাগই লোক মুখ হতে নিঃসৃত। আবার সেগুলো যুগের পর যুগ অলিখিত থেকেই গেছে। পরবর্তীতে অবশ্য বিভিন্ন জাতি তাদের লোকসাহিত্য সমূহ মানুষের মুখ থেকে শুনে তা লিখিত আকারে প্রকাশ করেছে। এধরণের লোকসাহিত্য পৃথিবীর প্রায় সব জাতিরই রয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য ভাষার মতো বাংলা ভাষারও রয়েছে অজস্র লোকসাহিত্য। এই লোকসাহিত্যগুলো যুগ যুগ ধরেই বাংলা ভাষাভাষী মানুষকে তাদের অতীত ঐতিহ্যকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে সাহায্য করে চলেছে। লোকসাহিত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো বেশিরভাগ লোকসাহিত্য রচিত হয়েছে অঞ্চল ভিত্তিক, ফলে এসব লোকসাহিত্য দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এমনও দেখা গেছে কোনো জাতির লোকসাহিত্যের কিছু অংশ আবিষ্কার হয়েছে হাজার বছর পর। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের লোকসাহিত্যের মতো চট্টগ্রাম অঞ্চলেরও রয়েছে শক্তিশালী লোকসাহিত্যের ধারা। এসব ধারার মধ্যে চট্টগ্রামের পালাগানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এটা চট্টগ্রামের প্রাচীন একটি ধারা। এ অঞ্চলের পালা শিল্পীরা তৎকালীন সময়ে পালাগান গেয়ে মানুষের মনোরঞ্জনের মাধ্যমে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতো। এ পালাগান সাধারণত কোনো মাজারের ওরশে, বিবাহ অনুষ্ঠানে, ঋতু ভিত্তিক অনুষ্ঠানসমূহে দেখা যেতো। শীত মৌসুমে চট্টগ্রাম অঞ্চলে পালাগান অনুষ্ঠিত হতো বেশি। চট্টগ্রামর বিভিন্ন অঞ্চলের পালা শিল্পীরা তখন বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে পালাগান গাইতেন। চট্টগ্রামের পালাগানগুলো প্রায় সবগুলো সংগৃহীত হলেও এগুলো প্রায় সবগুলোই প্রকাশিত হয়েছে। চট্টগ্রামের পালাগানগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রেম-বিচ্ছেদমূলক হলেও এগুলো ময়মনসিংহ গীতিকার মতো নারী প্রধান নয়। চট্টগ্রামের পালাগানগুলো অধিকাংশই পুরুষ প্রধান এবং বহু সংগ্রামের মাধ্যমে নায়ক, নায়িকাকে উদ্ধারের কাহিনীই বিধৃত হয়েছে। চট্টগ্রামের সবচেয়ে জনপ্রিয় পালাগান হচ্ছে ‘ভেলুয়া সুন্দরী’ – র পালা। আমির সওদাগর ও ভেলুয়ার কাহিনী নিয়ে গড়ে ওঠা এই পালা একসময় চট্টগ্রামে বেশ জনপ্রিয় ছিলো। এই পালাটি একসময় চট্টগ্রামের বিবাহ অনুষ্ঠানেগুলোতে প্রায় গাওয়া হতো। এই পালাগানের অনেকগুলো মুদ্রিত সংস্করণ রয়েছে।
পূর্ববঙ্গের গীতিকার আশুতোষ চৌধুরী এই পালাগানটি চট্টগ্রামের কয়েকজন পালা শিল্পীর কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন রাউজানের বাগোয়ান গ্রামের জেবল হোেেসন, লাম্বুরহাটের ইসমাইল এবং রাঙ্গুনিয়া থানার পোমড়া গ্রামের ওমর বৈদ্য। বিশেষত ওমর বৈদ্যের নিকট থেকেই তিনি ভেলুয়ার পালাটি সংগ্রহ করেছিলেন। এই পালাগানটি আমির সওদাগর এবং ভেলুয়াকে নিয়ে রচিত হলেও এর পেছনে ছিলো বিশেষ প্রেক্ষাপট। এই পালার ঘটনাসমূহে চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গার নাম উল্লেখ রয়েছে, যে জায়গাগুলো বর্তমানেও পরিলক্ষিত হয়। পালায় উল্লেখিত শাফলাপুর বর্তমানে মহেশখালির অন্তর্ভুক্ত শাফলাপুর নামেই আছে। মহেশখালির শাফলাপুর আর ভেলুয়ার পালার শাফলাপুর এক এবং অভিন্ন। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, মধ্য যুগের পর চট্টগ্রামে পর্তুগীজদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গিয়েছিলো এসময় পর্তুগীজরা ব্যবসায়িক কারণে শাফলাপুরে একটি বন্দর স্থাপন করেছিল। এই শাফলাপুর বন্দরটি তৎকালীন সময়ে বেশ প্রসিদ্ধ ছিল। পালায় উল্লেখিত ভেলুয়ার পিত্রালয় তৈলন্যাপুর হচ্ছে বর্তমান আনোয়ারা থানার শঙ্খনদীর তীরস্থ তৈলারদ্বীপ। এই পালার ভিলেন ভোলা সওদাগরের বাড়ি ছিল কাট্টলি গ্রামে।
পাহাড়তলি স্টেশনের নিকটেই ভেলুয়ার দীঘি বর্তমানেও রয়েছে। বর্তমান চট্টগ্রাম শহরের খুলসীর পশ্চিমেই কাট্টলির অবস্থান। ভেলুয়া পালাগানের সারেঙ্গ বাদক টোনাবারুই – এর বাড়ি বর্তমান রাঙ্গুনিয়া থানার সৈয়দ নগর। সেখানে টোনা বারুই- এর ভিটা এখনও বর্তমান আছে। চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানার সরাইপাড়া নামক স্থানে পালায় বর্ণিত মুনাপ কাজির কাছারি ঘর ছিলো। সরাইপাড়ার পার্শ্ববর্তী এলাকা এখনও কাজীপাড়া নামে খ্যাত এখানে মুনাপ কাজির নামে দীঘিও আছে। কুড়াল্যামুড়া নামক পাহাড়টি চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত। তৎকালীন সময়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ছিলো এই কুড়াল্যামুড়া পাহাড়। কুড়াল্যামুড়ার পাহাড়ের উত্তর পূর্বে কর্ণফুলির নদীর পানির ভয়াবহ ঘূর্ণিপাক ছিলো যা কাউখালি ঘূর্ণিপাক নামে বেশ পরিচিত ছিলো। ভেলুয়ার পালার আমির সওদাগর এই কাউখালি ঘূর্ণিপাকেই ঝাঁপ দিয়েছিলেন বলে একাধিক প্রমাণ পাওয়া যায়। ভেলুয়ার পালায় বর্ণিত শ্রীমাই, শঙ্খ, বাইচা ইত্যাদি নদী চট্টগ্রামে বেশ পরিচিতো। ভেলুয়া সুন্দরী পালার পটভূমি হচ্ছে –
শাফলানগরের মানিক সওদাগরের একমাত্র পুত্র আমির সওদাগর শিকারে বেরিয়েছেন তেলন্যানগরের পাহাড়ে সেখানে তিনি ভেলুয়ার কবুতরকে তীরবিদ্ধ করলে ভেলুয়া কান্নায় ভেঙে পড়ে এমন অবস্থায় ভেলুয়ার সাত ভাই আমির সওদাগরকে বেঁধে নিয়ে আসে ভেলুয়ারদের ঘরে। আমির সওদাগরকে বেঁধে আনার সময় পথে জানতে পারে আমির সওদাগর সম্পর্কে ভেলুয়ার খালাতো ভাই এবং এই আমির সওদাগরের সাথেই ভেলুয়ার বিয়ে হওয়ার কথা দিয়েছিলো ভেলুয়ার মা। মায়ের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আমির সওদাগর এবং ভেলুয়ার মধ্যে বিবাহ সম্পন্ন হলে আমির সওদাগর ভেলুয়াকে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেলো। কিছুূুদিন পর ভেলুয়াকে রেখে বাণিজ্যের জন্য বের হলে পথ ভুলে আবার একই ঘাটে এসে যায়, ফলে সে ভেলুয়ার সাথে রাত্রি যাপন করে ভেলুয়াকে ঘুমের মধ্যে রেখে আবার তার বাণিজ্য নৌকায় উঠে বাণিজ্যের জন্য রওয়ানা দেয়। এদিকে ভেলুয়ার ঘরের দরজা খোলা দেখে আমির সওদাগরের বোন এবং মা ভেলুয়াকে সতিত্ব হননের অভিযোগে অভিযুক্ত করে বিভিন্নভাবে জ্বালাতন করতে থাকে।
একদিন কলসি হাতে জল আনতে ভেলুয়া নদীতে গেলে ভোলা সওদাগরের নজরে পড়ে যায়। ভোলা সওদাগর সুন্দরী ভেলুয়ার প্রেমে পড়ে গেলে সে বিভিন্ন কৌশলে নদীর ঘাট থেকে ভেলুয়াকে অপহরণ করে নিয়ে যায় তার কাট্টলি বাড়িতে। সেখানে সে ভেলুয়াকে বোঝায় যে তার স্বামী আমির সওদাগর মারা গেছে সে যেনো তাকে বিয়ে করে। কোনো উপায় না দেখে ভেলুয়া ইজ্জত বাঁচানোর জন্য ভোলা সওদাগরের কাছ থেকে ছয় মাসের সময় নেয়। এদিকে আমির সওদাগর বাণিজ্য থেকে ফিরে এসে ভেলুয়াকে দেখতে না পেয়ে মনের দুঃখে ঘর থেকে বের হয়ে যায় এবং চট্টগ্রামের বিভিন্ন দুর্গম পথ অতিক্রম করে রাঙ্গুনিয়া থানার সৈয়দ নগরে টোনা বারুই-এর নিকট সারেঙ বাজাতে শেখে। রাঙ্গুনিয়া থেকে আমির সওদাগর বিভিন্ন মানুষের মাধ্যমে খবর নিয়ে কাট্টলি ভেলুয়ার কাছে পৌঁছে যায় এবং ভেলুয়া তার সাথে পালিয়ে আসতে চাইলে আমির সওদাগর তাতে রাজি না হয়ে স্থানীয় মুনাপ কাজির নিকট বিচার দেশ, কিন্তু বুড়ো কাজি ভেলুয়ার রূপে অন্ধ হয়ে নিজেই ভেলুয়াকে বিয়ে করতে চাইলে সে বিচার না করায় আমির সওদাগর ঘরে ফিরে এসে বিপুল লোক নিয়ে ভোলা সওদাগরের সাথে লড়াই করে ভেলুয়াকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। এই লড়াইয়ে ভোলা সওদাগর নিহত হয়েছিল। অন্যদিকে মুনাপ কাজি ভয়ে নিজেই ভেলুয়াকে আমির সওদাগরের নিকট তুলে দিয়েছিল।
ভেলুয়া সুন্দরী পালার শেষ দৃশ্যটা ছিলো ঠিক এমন-
ভোলা সওদাগরের কাছ থেকে কীভাবে মুক্তি পাবে সে চিন্তায় ভেলুয়া কাট্টলি থাকাকালীন কোনো কিছু আহার না করে একেবারে শীর্ণকায় হয়ে গিয়েছিলো। ভেলুয়াকে কাজির ঘর থেকে উদ্ধার করে নৌকায় করে আমির সওদাগর নিয়ে চললো শাফলা বন্দরের দিকে। নৌকা শাপলা বন্দরে ভিড়লে শতশত জনতা তাদের অভিবাদন জানাতে এসেছিলো। কিন্তু ভেলুয়ার শরীরের অবস্থা এতই খারাপ ছিলো যে তাই পালায় বলা হয়েছিলো-
‘বন্দরে লোক জন দেখে খাড়া হই
ঘাটে আইল চৈদ্দ ডিঙ্গা মরা কন্যা লই।’
প্রকৃতপক্ষে ভেলুয়ার ঘটনাটি অনেকেই উপকথা মনে করে উড়িয়ে দেয়। এই ঘটনা মোটেই কোনো উপকথা নয়, এর ভিত্তি ইতিহাসের উপর। ‘তারিখ ই হামিদী’ গ্রন্থের রচয়িতা হামিদুল্লাহ খান, হোসেন শাহের পুত্র নসরত শাহের সময়ে ষোড়শ শতকে এই ঘটনা ঘটে বলে বর্ণনা করেছেন। ভোলা সওদাগরের সাথে আমির সওদাগরের ভেলুয়াকে নিয়ে যে যুদ্ধ হয়েছিলো তার বিস্তারিত বিবরণ ‘তারিখ ই হামিদী’ তে লিপিবদ্ধ রয়েছে।