বিপুল বড়ুয়া »
লম্বা রাস্তার এ মাথায় আজমীর স্টোর ও মাথায় অনন্যা গিফটশপ। রাস্তার এ মাথা থেকে ও মাথা নাক সিধে দেখা যায়। গাড়ি নেই-ঘোড়া নেই। কী ভীষণ সুনসান অবস্থা।
দীপ্ত ছাদে দাঁড়িয়ে চারপাশে দেখে। পাশের বিল্ডিংগুলোর ছাদও যেনো ঝিমিয়ে আছে। কারো ওঠানামা নেই, দাপাদাপি নেই।
কী করে দীপ্ত। স্যারের বাসা বন্ধ। ইশকুল সে তো কবেই ছুটি হয়ে গেছে, মনে মনে বেশ খুশি হয় দীপ্ত। তা বাপু-ঝারা হাত পা। খাও দাও আর ঘুম মারো। কেউ কিছু বলার নেই।
কিন্তু কোথায় ঘুমানো? কিচ্ছুটি বলার নেই।
ছোড়দি তো চটে মটে একাই একশো। ‘দীপ্ত খালি খাওয়া-আর ঘুম দিলে চলবে না। সকালে অংক-গ্রামার নিয়ে বসে যাও। বিকেলে নেবে ইংরেজি-বাংলা-সমাজ-আইসিটি।’
দীপ্ত মাঝে মাঝে গঁ ধরে বসে। কী বাপু পড়া আর পড়া। এতদিন তো কী মেশিন ছোটা ছোটো, সেই সাত সকালে ওঠো। বিছানা ছাড়ো। কিছু একটা মুখে দিয়ে-তা বাপু ছোটো ইশকুল। পাশ ফেরার যেনো জো নেই।
ভাগ্যিস-ইশকুল হাতের কাছে। দু পা ফেলো তো ইশকুলের বারান্দা। অ্যাসেম্বলি ষে। ক্লাসে ঢোকো এ ক্লাস সে ক্লাস। চোখ কান খোলা রাখো। কখন ক্লাস টেস্ট কোন বিষয়ের কতটুকু দেখে শুনে টুকো। শুনো স্যার কী বলেন।
ইশকুল শেষ। ঢাউস ব্যাগ পিঠে বাসা। তা থেকে আবার ছোটো সাদমান স্যারের কোচিং-এ। সেই এটা সেটা পড়া। হৈ চৈ ফিসফাস করার সুযোগ কই। যা মাথা গরম স্যারের। অমনি চটেমটে আগুন। এই মারে তো সেই মারে।
তা সেই-ইশকুল কোচিং-এ ছুটতে ছুটতে হাঁপিয়ে ওঠে দীপ্ত। না খোলা না ঘোরা। শুধু বই আর বই নিয়ে পড়ে থাকা। ক্লাস টেস্টের যা না ফর্দ। আজ বাংলা তো কাল ইংরেজি।
চারদিকে এরি মধ্যে করোনা নিয়ে হৈ চৈ। কতো বলাবলি। ভয়ংকর ব্যাপার-মস্তো বিপদ-সাবধানে থাকো-বন্ধ অফিস আদালত, রাস্তায় এতো এতো ছয়ন ং, নয় নং এক-দুই নং কতো কতো বাস ভোজবাজির মতো উধাও এবং ইশকুলও বন্ধ।
কবে খুলবে, দীপ্তও জানে না। কেউ জানে না। সে হতে ঘরবন্দি দীপ্তও। একটু আয়েশ করবে তারও জো নেই, ছোড়দির হাঁকডাক। ডানে বাঁয়ে খবরদারি। বইপত্তর নিয়ে বসো দীপ্ত।
‘বাংলা-নাও ধর্ম নাও-সমাজ নাও-অংক নাও-ইংরেজি নাও। হেলা করা চলবে না। গত সাময়িকীতে তোমার অংকে কম নম্বর এসেছে। ইংরেজিতে কতগুলো প্রশ্ন ভুলভাল উত্তর দিয়েছো-দেখেছো-এবার তা শুধরে নেবে বলে দিলাম। আইসিটিতে একটু খাটলে ভালো নম্বর আনা যায় দেখো দীপ্ত।’
দীপ্ত ঝিম মেরে বসে থাকে। ছোড়দির কথা এ কান দিয়ে ঢোকে তো ও কান দিয়ে গট্্গট্্ করে বেরিয়ে যায়।
বাবারও অফিস বন্ধ। বাবা ড্রয়িংরুমে পত্রিকা নেড়ে চেড়ে দেখে। দীপ্ত আড়চোখে বাবাকে দেখে। বাবাও বোঝে দীপ্তর মাথায় গোল বেঁধে যাচ্ছে। এই ঝগড়া বাঁধাবে মুনার সঙ্গে।
‘মা-মুনা এতো হৈ চৈ রাখ না বাপু। দীপ্ত বেশ খেটেখুটে পড়ছে তো। তুই মাথা চটিস না তো। দেখিস সামনের পরীক্ষায় দীপ্ত ভালো করবেই। তুই দেখিস মুনা।
ছোড়দি রাগে আরো গজ্ গজ্্ করে ওঠে। ‘বাবা-তুমি ওকে কিছু বলবে না। আমি একটু কিছু বললে তুমি দীপ্তকে ছাড়িয়ে নাও।’
দীপ্ত বাবার দিকে তাকায়। বাবা বাসায় তাহলে রক্ষে। না হলে বলতো-এই বই নাও-সে বই নাও। আরো কত কি করতো ছোড়দি।’
করোনায় ইশকুল বন্ধ। বাবার অফিস নেই। ছোড়দির ভার্সিটিও নেই। সবাই ঘরবন্দি। মা আছে রান্না নিয়ে। বলতে গেলে এখন শুরু হয়েছে মজার পিঠাপুলি-ভাজিভুজি খাওয়ার মচ্ছব। আজ এ পিঠে তো কাল সে পিঠে, কখনো খিচুড়ি-কখনো ডালনা-পায়েস-সেমাই এই করা-এই খাওয়া। তা ঘরে থাকা ভারি মজা।
দীপ্তর বলতে গেলে বেশ ভালোই লাগছে। বাবা-মা ছোড়দি সবাই বসে এক সাথে সকালে নাস্তা-দুপুরে-বিকেলে এটা সেটা-রাতের খাওয়া সারা। কী গল্প গল্প। পত্রিকায় এটা সেটা লেখা নিয়ে কী যে কথাবার্তা। কোথায় কি হলো-কে কি বললো-করোনায় কোন দেশ কি করছে। কেমন করে সামাল দিচ্ছে-আমাদের দেশে কী হচ্ছে না হচ্ছে-সব বিষয়ে সবাই কথা বলছে।
প্রথম প্রথম দীপ্তর এতসব খটখটে বিষয়-আশয়গুলো নীরস নীরস মনে হলেও আজকাল দীপ্তর অতসবে বেশ মাথা ঢোকে যায়। অতসব শুনতে-ভাবতে ভালোই লাগে।
এ নিয়ে একটা বিষয় দীপ্তর মনে বেশ দাগ কাটে। আগে দেখেছে দীপ্ত-ছোড়দি ভার্সিটি ট্রেন ধরার জন্য সেই সাতটায় বেরিয়ে পড়ে। তার পর পর দীপ্তর ইশকুলে ছোটা। বাবার বেরিয়ে পড়া অফিসে নয়টায়। সকালের চা-চু খেয়ে যে যার মতো বাইরে যাওয়া। দীপ্ত দুপুরে ইশকুল ফিরে আবার কোচিং। ছোড়দি সেই চারটায় ফিরে আবার একটু খেয়ে দেয়ে টিউশনিতে ছোটা আর ফেরা রাত নয়টায়। তারপর কম্পিউটারে এ কাজ সে কাজ নিয়ে বসা।
বাবা সন্ধ্যায় অফিস ফিরে কখনো কাগজপত্র নিয়ে বা টিভি খুলে বসা। এ খবর সে খবর দেখা। মনোযোগ দিয়ে পত্রিকা পড়া। মার সাথে এটা সেটা নিয়ে গপপো টপপো। এভাবে সময় পেরিয়ে যাওয়া। এদিকে টিভিতে চলে টকশো-সঙ্গীতানুষ্ঠান-খবর। স্টার প্লাস-জলসা মুভিজ কিংবা জি বাংলায় সিনেমা-সিরিয়াল কেউ দেখলো-তো দেখলো না।
সব্বার সে কি ব্যস্ততা। সবাই ব্যস্ত। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সবার দৌড়-ছুট অবস্থা। কে কখন খায়-কে কখন বেরিয়ে যায়-কে কখন ফেরে তার কোনো হদিস নেই।
কোথায় এক সঙ্গে বসে খাওয়া। এক সঙ্গে বসে টিভির টকশো-সিরিয়াল দেখা, দীপ্তকে বাবা-ছোড়দির বলা-‘পড়ো পড়ো। দেখো দেখো। কোচিং যাচ্ছো। ফাঁকি ঝুঁকি চলবে না কিন্তু। সামনে পরীক্ষা, ভালো পাস করো। তবে যা যা চাও সব পাবে বলে দিলাম।’
দীপ্তকে তখন পায় কে বাবার না হোক। ছোড়দির হাঁক ডাক থেকে তো বাঁচা গেলো। একটু ঘুরে-ইশকুল-কোচিং সেরে-গির্জার মাঠে ছুট-দৌড়ে খেলে তবেই বাসা। নাক মুখ গুঁজে টেবিলে বসা-ইশকুলের পড়া শেষ করা-ক্লাস টেস্টের সিলেবাস দেখে নেওয়া-আর ফাঁকে ফাঁকে ছোড়দির কাছে সব দেয়া।
তবে এতে যে ভারি কড়াকড়ি থাকতো তা না। ছোড়দি নিজের পড়াশোনার ব্যস্ততার ভেতর থেকেও দীপ্তর পড়ালেখা দেখতো। খুব বেশি যে ছাড় দিতো তা না। তবে এখনকার মতো ভারি খেয়াল-নজরদারি থাকতো না বলে কিছুটা হেসে খেলে থাকতে পারতো দীপ্ত। কিন্তু আজ এই ঘরে থাকার সময়ে-দীপ্ত কিছুটা হলেও টের পায় তাদের ঘরে যেনো অন্যরকম আমেজ।
দীপ্ত বোঝে সে অন্যধরনের আমেজ। সবার সঙ্গে গল্পসল্প হয়। খাওয়াদাওয়া হয়। মজা করে টিভি দেখা হয়। বাবা অফিসের বড়ো সাহেবের মানি ব্যাগ হারিয়ে ফেলার মজার গল্প বেশ রগিয়ে রগিয়ে বলে। ছোড়দি তাদের ভার্সিটির শাটল ট্রেনে আসা-যাওয়ার হৈ-হল্লা-সিট-এ গ্রুপ সে গ্রুপের মধ্যে খিটিমিটি আবার মিলমিশের গল্প বলে। মা ওপাশের মন্দির-ঠাকুরবাড়ির অন্নপ্রাশন-সন্ধ্যা আরতির সুন্দর কীর্তনের কথা বলে। সবাই সবার ভালোলাগার-মন্দলাগার বিষয়গুলো গড়গড় করে বলে যায়।
আশ্চর্য তা দীপ্ত দেখে-সবাই সবার এ কথা সে কথা বেশ মন ভরে উপভোগ করে। শুনতে চায় কার কি বলার আছে। হ্যাঁ-তাইতো সবাইকে এই ঘরবন্দি সময় কতো কাছে এনেছে। সবার মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছে অপার আন্তরিকতা। একে অন্যকে বোঝার চেনার এ ধরনের সুযোগ সব ঘরে আসে না। দীপ্ত মনে করে সব ঘরে লকডাউনে ঘরে থাকার সুবাদে সবাই মিলে মিশে বসে দুদ- প্রাণ খুলে কথা বলার ভারি সুযোগ হয়েছে।
তবে দীপ্ত মনে করে এই মজার মজার খেয়েদেয়ে ছাদে ওঠে গায়ে বাতাস লাগানোর পাশাপাশি তার লেখাপড়ায় ছোড়দি যে হম্বিতম্বি করে গতি এনে দিয়েছে তা বেশ টের পেয়েছে দীপ্ত।
বুঝে নিয়েছে দীপ্ত ইংরেজি-অঙ্কে তার বেশ কিছু ঘাটতি ছিলোই। তা ঘরে থাকাকালীন ছোড়দি ডেকে সামনে বসিয়ে সব বুঝিয়ে দেওয়াতে তার একটা বড়ো কাজ হয়েছে। আইসিটির বেশ কিছু কিছু বিষয় ছোড়দি দেখিয়ে দেওয়াতে এক্কেবারে বোঝা সহজ হয়ে গেছে দীপ্তর।
দীপ্তর এখন ম্যালা অবসর। ইশকুল-কোচিং এ না গেলে মাঠে খেলতে না গেলেও এখন দীপ্তর দিনরাত্রি কাটে যেনো এক অন্য ধরনের আনন্দময়তা নিয়ে। ছাদে ওঠে ভোরের মিষ্টি পাখি দেখা-বিকেলের নীল আকাশ ও রাতের তারার ঝলমলে আকাশ দেখার দারুণ সময় এসেছে যেনো দীপ্তর কাছে।
দীপ্ত মনে করে নানা এ-কথা সে কথা থাকার পরও প্রকৃতি যেনো করোনা ভাইরাসের কারণে শহরে ঘরে থাকার সময় দীপ্তকে অনেক কিছু অন্যরকমভাবে ফিরিয়ে দিয়েছে। নিদারুণ কৃত্রিমতার ভেতর বসবাস করা বেড়ে ওঠা জীবন আজ যেনো হেরে গেছে কবেকার আলোহাওয়ার হাসি খুশির মধুর সময়কালের জীবনের কাছে।
ছাদে দাঁড়িয়ে ঝিমধরা নিস্তব্ধতায় অতসব অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে দীপ্ত এক সময় হারিয়ে যায় জন কোলাহলহীন এক মধুর ভুবনে। যার ঠিকানা কেনো জানি মনে হয় দীপ্ত নিজেও জানে না। হয়তোবা কেউই জানে না। তারপরও দীপ্ত-একা-ভীষণ একা লকডাউনে ঘরে থাকার সময়ের সুলুকসন্ধান দারুণভাবে উপভোগ করে।