সাঈফী আনোয়ারুল আজিম »
সভ্যতা আর সাংস্কৃতিক আভিজাত্য প্রষ্ফুটিত করার অন্যতম বাহন হলো গ্রন্থাগার। গ্রন্থাগারকে বলা হয় সভ্যতা বিকাশের মূল বাহন। হাজার বছরের অতীত ইতিহাসকে জানার জন্য এবং কোন ঐতিহাসিক ঘটনার শেকড় থেকে শেখরে পৌঁছানোর জন্য গ্রন্থাগার হলো অন্যতম ঠিকানা।
সর্বসাধারণের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে গ্রন্থাগারের সুদূরপ্রসারী ভূমিকা বিদ্যমান। গ্রন্থাগার হলো একটি সার্বজনীন প্রতিষ্ঠান। গ্রন্থাগারের বিকল্প নাম হচ্ছে ‘জনতার বিশ্ববিদ্যালয়’। পৃথিবীর সমস্ত প্রতিষ্ঠানে প্রবেশের ক্ষেত্রে বয়স কিংবা মানুষের শ্রেণিবিন্যাস থাকলেও গ্রন্থাগার এমন একটি পাঠশালা যেখানে শিশু থেকে বায়োবৃদ্ধরা একসাথে অধ্যয়নের সুযোগ পায়। নির্বিঘেœ স্বাধীনচিত্তে অধ্যয়ন করতে পারে। যেটা অন্য প্রতিষ্ঠানের বেলায় ভিন্ন। মানুষ এখানে অধ্যয়নের জন্য অবাধ সুযোগ পায়।
গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীতা উল্লেখ করতে গিয়ে পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত আমেরিকান কবি ও প্রাবন্ধিক রীতা ফ্রান্সেস ডভ তার একটি উক্তিতে বলেছেন, লাইব্রেরি হলো সম্ভাবনাময় জায়গা, এমন একটি স্থান যেখানে হৃদয় ও পৃথিবী উভয়ের দরজাই খুলে যায়। বলা হয়, লাইব্রেরি হলো উদ্ভাবনী চিন্তার জন্ম নেয়ার স্থান এবং এমন একটি জায়গা যেখানে ইতিহাস পাঠকের জীবনের সাথে মিশে যায়, পাঠকও ইতিহাসের সাথে মিশে যায়।
গ্রন্থাগার ছাড়া যেখানে সভ্যতার বিকাশ ঘটেনা, ইতিহাসের সংরক্ষণ হয়না এবং মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত হয়না। সেই গ্রন্থাগারগুলোর অবস্থা এখন কেমন? কেমন আছে বাংলাদেশের রাজধানী থেকে একেবারে প্রান্তিকে ছড়িয়ে থাকা বেসরকারি গণপাঠাগারগুলো! খোঁজ নিয়ে যতটুকু জানা যায়, তা আমাদের জন্য হতাশার সংবাদ। সভ্যতার আলো যেখান থেকে প্রজ্বলিত হয়, হাজার বছরের ইতিহাস যেখানে চর্চা হয়, সে সভ্যতার দিকপাল আলোর গ্রন্থাগারগুলোর অবস্থা এখন অনেকটা শোচনীয়। সময় পরিক্রমায় অযতœ আর অবহেলার কারণে দেশের অধিকাংশ গণপাঠাগার এখন পোকা মাকড়ের বসতঘরে পরিণত হয়েছে।
অবস্থা এমন যে, সভ্যতার আলো ছড়ানোর বাতিঘরগুলো আজ নিজেই যেনো অন্ধকারে নিমজ্জিত। প্রবীণ বুদ্ধিজীবী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কথায়, টিকে থাকার অন্তহীন লড়াইয়ে এ যেন আত্মসমর্পণের নীরব অসম্মতি।
বর্তমান সময়ে সঠিক উদ্যোগ, কার্যকর বিধিমালা এবং সরকারি সংশ্লিষ্ট দফতরসমূহের অবহেলার কারণে আজকে দেশের বেশিরভাগ মানুষ গণ গ্রন্থাগার বিমুখ এবং বই হতে বিচ্ছিন্ন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জনই মানুষের জন্য যথেষ্ট নয়। স্বাধীনভাবে সৃজনশীল জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে গ্রন্থাগার বন্ধুর মতো সামনে এসে দাঁড়ায়। গ্রন্থাগার প্রসারিত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে উপস্থিত হয়। গ্রন্থাগারের মাধ্যমে সবশ্রেণির মানুষই উপকৃত হয়। কম লেখাপড়া জানা ও গরিব মানুষের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে গ্রন্থাগার যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তেমনি জ্ঞানী ও প-িত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও গ্রন্থাগারের ভূমিকা অভাবনীয়। গ্রন্থাগারে থাকে জ্ঞানবিজ্ঞানের বিচিত্র বিষয়ের গ্রন্থ।
আগ্রহী পাঠকের জন্যে গ্রন্থাগার জ্ঞানার্জনের যে সুযোগ তৈরি করে দেয়, সে সুযোগ অন্য কোথাও নেই। গ্রন্থাগার গ্রন্থের বিশাল সংগ্রহশালা, যা মানুষের প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম। গ্রন্থাগারের মাধ্যমে মানুষ জ্ঞানসমুদ্রে অবগাহন করে জ্ঞানের মণিমুক্তা সংগ্রহের সুযোগ পায়। গ্রন্থাগার শুধু সমাজসংস্কারের কাজই করে না, তা সমাজের সভ্যতা বিকাশের স্থায়ী উপকরণ হিসেবেও ভূমিকা পালন করে।
পাঠাগারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বিচারপতি হাবিবুর রহমান বলেছেন, গ্রন্থাগারের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠে সংহতি যা দেশ গড়া কিংবা রক্ষার কাজে অমূল্য অবদান রাখে। বই পড়ার যে আনন্দ মানুষের মনে থাকে, তাকে জাগ্রত করে তুলতে আজ সব ধরণের পাঠাগারের ব্যাপক প্রসার প্রয়োজন।
গ্রন্থাগার হলো মানবসভ্যতার শ্রেষ্ঠ সম্পদ। আর সেই সম্পদের যথোপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে তার প্রকৃত উপকার ভোগ করা যায়। জীবনে পরিপূর্ণতার জন্য জ্ঞানের বিকল্প আর কিছু হতে পারে না। জ্ঞান তৃষ্ণা নিবারণ করতে রয়েছে গ্রন্থাগার। একটি সমাজের রূপরেখা বদলে দিতে পারে একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার। মনকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পাঠাগারের অবদান অনস্বীকার্য। তাই অযতেœ অবহেলায় পড়ে থাকা গণপাঠাগারগুলোকে সংস্কার করা হোক। পাঠকের জন্য উপযোগী করে তোলা হউক। এক্ষেত্রে সরকারিভাবে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। দেশের সরকারি বেসরকারি গণপাঠাগারসমূহের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে।
আজ জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসে আমাদের দাবি, তদারকির অভাবে যে সমস্ত গণপাঠাগারগুলো এখন অযতœ অবহেলায় পড়ে আছে, অস্তিত্ব হারিয়ে বিলীন হওয়ার পথে, সেগুলোকে সংস্কার করে পাঠকমুখী করা হোক। সভ্যতার বিকাশ ছড়ানোর বাতিঘরগুলো সংস্কার করে গণমুখী করে গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। সভ্যতার বিকাশ এবং মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত করার জন্য এখনই গণপাঠাগারগুলোকে যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। এর মাধ্যমে আমরা লাভ করতে পারি জ্ঞানসমৃদ্ধ একটি জাতি, যাঁদের বহুমুখী জ্ঞানার্জনের অন্যতম বিদ্যাপীঠ হবে পাঠাগার।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা
উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরি
ছনুয়া, বাঁশখালী, চট্টগ্রাম