সহসা কাটছে না দুর্ভোগ
রাজিব শর্মা
নগরীতে গ্যাস সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। চাহিদার তুলনায় মহেশখালী এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় এ সংকট দেখা দিয়েছে। সাধারণত পুরো চট্টগ্রামে জাতীয় গ্রিড থেকে ৩১০ থেকে ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যেত। এখন প্রায় তার অর্ধেকে নেমে এসেছে। গ্যাসের এ সমস্যা সহসা কাটছে না বলে জানায় কর্তৃপক্ষ।
বুধবার সকালে নগরীর বাকলিয়া মীর ফিলিং স্টেশন, নিউ মার্কেট ফিলিং স্টেশন, মইজ্জ্যারটেক ফিলিং স্টেশন, কর্ণফুলী ক্রসিং এলাকার ফিলিং স্টেশন, পতেঙ্গা থানাধীন কয়েকটি ফিলিং স্টেশনে সিএনজি চালিত যানবাহনের দীর্ঘ সারি দেখা যায়। এতে অনেক স্থানে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হতে দেখা যায়। এছাড়া শিল্প-কারখানাসহ বাসাবাড়িতে রান্নার কাজ করতে ব্যাপক ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে গৃহকর্ত্রী বা গৃহকর্মীকে। ফলে ভোগান্তির অন্ত নেই মানুষের।
ফিরিঙ্গী বাজার এলাকার গৃহকত্রী সাইমা আক্তার বলেন, গত ১৫ দিন ধরে বাসায় গ্যাস সরবরাহে সমস্যা হচ্ছে। সিলিন্ডার কিনে ব্যবহার করছি। নিম্ন আয়ের সংসার। কতদিন সিলিন্ডার ব্যবহার করে রান্না করবো। এরকম হলে গ্রামমুখী হওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই।
পশ্চিম বাকলিয়া এলাকার শিক্ষিকা নাহিদা আক্তার বলেন, গ্যাস কখন আসে কখন যায় জানি না। সারাদিন থাকি স্কুলে। স্কুল শেষে বাসায় ফিরে দেখি গ্যাস নেই। কয়েকদিন ধরে রাইস কুকারে ভাত রান্না করে বাইরে থেকে রান্নার সবজি বা মাছ কিনে এনে বাচ্ছাদের খাওয়াচ্ছি। অনেক সময় স্কুল থেকে আসার সময় গ্রামের বাড়ি থেকে রান্না করা খাবার নিয়ে আসি।
মো. আলতাফ হোসেন নামে এক গ্রাহক বলেন, গ্যাসের তীব্র সংকটের কারণে বাসার চুলা জ্বলছে না। রাতে একটু সংযোগ আসলেও তার চাপ অনেক কম। সামান্য পানি গরম দিতেও অনেক দেরি হয়ে যায়। এ বিষয়ে কেজিডিসিএল বরাবর জানালেও তারা নানারকম কথা বলে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।
বাকলিয়া সৈয়দ শাহ রোডের বাসিন্দা মো. জয়নুল আবেদীন বলেন, গ্যাস ব্যবহার করি বা না করি, মাস শেষে ঠিকই আমাদের বিল দিতে হচ্ছে। তার মধ্যে একদিনও স্বাভাবিক গ্যাস পায়নি। কর্তৃপক্ষের কাছে ফোনে জানতে চাইলেও তারা কোন জবাব দেয় না। তারা বলে, গ্যাস আসলে দেখবেন।
পাথরঘাটা আশরাফ আলী রোডের বাসিন্দা মো. আবদুল হালিম বলেন, গত সপ্তাহ থেকে গ্যাস সরবরাহের সমস্যা দেখা যাচ্ছে। গত রাতে বারোটার দিকে গ্যাস এসেছিল শুনছি, সকালে দেখি গ্যাস নেই। আপাতত বাইরের খাবার কিনে খাচ্ছি।
বহদ্দারহাট এলাকার ভাড়াটিয়া শিক্ষক মো. আলমগীর বলেন, গ্যাস প্রায় সময় থাকে না। অনেক সময় এক টাইম জমিদার গ্যাস লাইন দিতো। এখন এক সপ্তাহ ধরে তাও পাচ্ছি না। জমিদার বলছে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ। তাই আপাতত হোটেলের খাবার কিনে খাচ্ছি।
কোরবানিগঞ্জ এলাকার মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে দিনের অধিকাংশ সময় গ্যাস সরবরাহ না থাকাতেই ভাড়াটিয়ারা বাসা ছাড়তে চাচ্ছে। বিষয়টি সমাধান পেতে কেজিডিসিএল এ অভিযোগ দিয়েছি।
অন্যদিকে গ্যাসের সংকটে সিএনজি চালিত যানবাহনগুলোর সারি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে ফিলিং স্টেশনগুলোতে। গ্যাসের জন্য এক লাইনে শত শত গাড়ি অপেক্ষা করতে দেখা যায়।
পেকুয়া থেকে মইজ্জারটেক ফিলিং স্টেশনে গ্যাস নিতে আসেন মো. আশরাফ নামের এক সিএনজি চালিত টেক্সিচালক। তিনি বলেন, মঙ্গলবার রাত থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। গ্যাসের সংকটের কারণে লোড সরবরাহ করতে পারছে না ফিলিং মালিকরা।
নিউমার্কেট জিপিও এলাকায় গ্যাস নিতে আসা রেঞ্জারচালক মো. ফারুক বলেন, ‘সকাল থেকে এসেছি। গ্যাসের সরবরাহ জটিলতার কারণে গ্যাস দিতে পারছে না। যার ফলে গাড়ি বন্ধ রেখে অপেক্ষা করছি।’
এদিকে গ্যাসের সংকটের কারণে গাড়ি চলাচল বন্ধ রেখেছেন অনেক টেক্সি ও রেঞ্জার চালকরা। তাদের দাবি, গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত আপাতত বন্ধ থাকবে গাড়ি চলাচল।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ২১ অক্টোবর সকাল থেকে নগরীতে গ্যাস মিলছে ২৫০ থেকে ২৬০ মিলিয়ন ঘনফুট। ওইদিন থেকে বিভিন্ন বাসাবাড়ি, কলকারখানা, সিএনজি স্টেশনগুলোতে গ্যাস সরবরাহ কমে যায়। অনেক বাসাবাড়িতে রান্নার চুলাও জ্বলেনি। চরম দুর্ভোগে পড়তে হয় গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল গ্রাহকদের।
এদিকে গ্যাসের এ সংকট সহসা কাটছে না। এ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও মাস দুয়েক লাগতে পারে বলে জানায় কেজিডিসিএল কর্তৃপক্ষ।
কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) এর গ্যাস বিপনন দক্ষিণ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী আমিনুর রহমান বলেন, ‘চট্টগ্রাম এলএনজি গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। প্রতিদিন ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যেত। কিন্তু এলএনজি সরবরাহ কমেছে। বর্তমানে দৈনিক ২৬০ থেকে ২৮০ মিলিয়ন ঘনফুট পাওয়া যাচ্ছে। এ কারণে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে এ গ্যাস দিয়ে দুটি সারকারখানা ও বিদ্যুৎ চলছে। আমরা চাইলে এ তিনটি খাত বন্ধ রাখতে পারি না। তার মধ্যে বর্তমান দুটি গ্যাস টার্মিনালের মধ্যে একটি টার্মিনাল বন্ধ রয়েছে। এই একটা দিয়ে গ্যাসের চাপ সামলাতে হচ্ছে। নির্দেশনা ছিল ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট কমাতে। এখন ১৫ ঘনফুট কমাতে গিয়ে দেখা গেল চট্টগ্রামের চারদিকে গ্যাসের সংকট দেখা দিয়েছে। তবে কোন কোন স্থানে এখন গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে। গ্যাস সরবরাহের এ সমস্যা কাটিয়ে স্বাভাবিক হতে মাস দুয়েক লাগতে পারে।
চট্টগ্রামে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের মোট গ্রাহক ও সংযোগ আছে ছয় লাখ এক হাজার ৯১। এর মধ্যে গৃহস্থালি সংযোগ পাঁচ লাখ ৯৭ হাজার ৫৬১টি। যাতে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট। পাওয়া যেত ৩১০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এছাড়া বর্তমানে নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ রয়েছে। নতুন করে কোনও আবেদনও গ্রহণ করা হচ্ছে না। আবাসিকে ২৫ হাজার গ্রাহক গ্যাস সংযোগের জন্য আবেদন করে দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষায় আছেন গ্রাহকরা। এসব আবেদনকারী বছরের পর বছর ধরে সংযোগ না পেয়ে আদালতেরও দ্বারস্থ হয়েছেন।