জোবায়ের রাজু
রোকসানা চৌধুরী দেশের নামকরা একটি জাতীয় দৈনিকের বিভাগীয় সম্পাদক। দশ বছর ধরে তিনি এই পেশায় নিয়োজিত। সাহিত্যপাতার ইমেইলে আসা পাঠকের শত শত মেইলগুলো থেকে ভালোমানের লেখাগুলো বাছাই করে নিতে রোকসানা চৌধুরী বেশ পারদর্শী। প্রতিদিন বহু মেইল আসে। কিন্তু সব লেখা গ্রহণযোগ্য নয়। মানসম্মত লেখার সংখ্যা খুবই নগণ্য। বেশ কয়েকজন কবির লেখা রোকসানা চৌধুরীর ভালো লাগে, যাদের কবিতার হাত দারুণ। তাই তাদের আসা মেইলগুলোর দিকে বাড়তি একটা সুনজর রোকসানা চৌধুরীর থেকেই যায়।
সুমি রহমানের আসা ইমেইলের কবিতাগুলো বেশ প্রাঞ্জল। খুব গুছিয়ে লিখতে পারেন এই কবি। লেখার মান খুবই উন্নত। রোকসানা চৌধুরী সুমি রহমানের কবিতায় ভুল খুব একটা পান না। কোনো এক ভালোবাসা দিবসে কবিতা লিখে ইমেইল করার সময় সুমি রহমান তার ফোন নাম্বারটিও দেন। সেই কবিতা এতটাই অসাধারণ হয়েছে যে রোকসানা চৌধুরী উক্ত ফোন নাম্বারে কল করে ধন্যবাদ জানান সুমি রহমানকে। এত বড় একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকের কল পেয়ে সুমি রহমান তো আনন্দে নির্বাক ছিলেন কতক্ষণ।
সেই থেকে দুজনের প্রায়ই কথা হয় ফোনে। বিশেষ সংখ্যার জন্য জরুরি কোনো লেখা লাগলে রোকসানা চৌধুরী সুমি রহমানকে কল করে লেখা চেয়ে নেন। নির্দিষ্ট সময়ে সুমি রহমানও তার যত্নে লেখাটি পাঠিয়ে দেন। ততদিনে দুজনের সম্পর্কটাও বেশ মজবুত হয়ে উঠেছে। সুমি রহমান প্রায়ই তার উত্তরার বাসায় রোকসানা চৌধুরীকে ইনভাইট করেন। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের নানান ব্যস্ততার কারণে রোকসানা চৌধুরী সুমি রহমানের কথা রাখতে পারেন না বলে আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেন।
২.
দুপুরবেলায় রোকসানা চৌধুরীর ফোনে সুমি রহমানের কল আসে। ওপার থেকে সুমি রহমানের বিনীত অনুরোধ, আপা, আগামী সাত তারিখে আমাদের আঠারোতম ম্যারিজ ডে। আপনাকে কিন্তু আসতেই হবে। কথা দেন।
সুমি রহমানের জোরালো আবদারের কাছে পরাজিত হয়ে রোকসানা চৌধুরী কথা দিতে বাধ্য হলেন সুমি রহমানকে। বাসায় যাবার যাবতীয় ঠিকানা ভালো করে বুঝে নিয়ে রোকসানা চৌধুরী সাত তারিখে সুমি রহমানের বাসায় যাবেন বলে পাকা কথা দিলেন।
আজ সাত তারিখ। সুমি রহমানের উত্তরার বাসায় আসতে খুব একটা ঝামেলা হয়নি রোকসানা চৌধুরীর। সম্পাদক সাহেবার এমন আগমনে সুমি রহমান কি পরিমাণ খুশি হয়েছেন, তা ভাষায় বোঝাতে পারলেন না।
নানান বিষয়ে আলোচনা জমে ওঠে দুজনের। কিচেন থেকে পোলাও-কোরমার মিষ্টি গন্ধ আসছে। ডাইনিং টেবিলে শোভা পাচ্ছে বিবাহ বার্ষিকীর দামি কেক। গিফট হিসেবে রোকসানা চৌধুরী দারুণ একটা শাড়ি এনেছেন সুমি রহমানের জন্য। সুমি রহমানের স্বামী এখনো অফিসে। একটু পর অফিস থেকে বিশেষ ছুটি নিয়ে বাসায় ফিরবেন বলে জানা গেছে।
কিন্তু হঠাৎ দেয়ালে ঝুলানো ছবিটির দিকে তাকাতেই রোকসানা চৌধুরীর পায়ের তলার ভূমণ্ডল যেন নড়ে উঠলো। সুমি রহমানের পাশে ছবিতে যে মানুষটিকে দেখা যাচ্ছে, সে যে স্বয়ং জাবেদ, একদিন যে ছিল রোকসানা চৌধুরীর স্বপ্নের মানুষ।
আপা, কি দেখছেন ছবিতে? উনি আমার স্বামী জাবেদ রহমান। ব্যাংকে জব করেন। আমার সঙ্গে মানিয়েছে না? হি হি হি।
হ্যাঁ, দারুণ মানিয়েছে।
অতীতের স্মৃতিগুলো চোখে ভাসতে থাকে রোকসানা চৌধুরীর। এই জাবেদকে একদিন হৃদয় উজাড় করে ভালোবেসেছেন তিনি। জাবেদের সাথে হুড তোলা রিকশায় চড়ে সারা শহর কত যে চষে বেড়িয়েছেন দুজনে। দুজনের প্রেমের যখন তিন বছর চলছে, একদিন রোকসানা চৌধুরী জাবেদকে অনুরোধ করেন তার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে আলাপ করতে। কিন্তু তাতে নারাজ ছিলেন জাবেদ। কারণ তার জীবনে আরেক নারীর আবির্ভাব ঘটে গেছে ইতিমধ্যে। সুমি নামের সেই মেয়েটিকে বিয়ে করবেন বলে জাবেদ রোকসানা চৌধুরীকে জানিয়ে দেন। জাবেদের এমন বিশ্বাসঘাতকতা সহজে মানতে পারেননি রোকসানা চৌধুরী। তাই তিনি সরে দাঁড়ান ওই বিশ্বাসঘাতকের জীবন থেকে। জাবেদকে তিনি এতটাই ভালোবেসেছেন যে অন্য কোনো পুরুষকে আর তার জীবনে আসতে দেননি। একাকী নিঃসঙ্গ জীবন বেছে নেন রোকসানা চৌধুরী।
আজ এতটা বছর পর সেই জাবেদের বাসায় রোকসানা চৌধুরী। কবি সুমি রহমান জাবেদের স্ত্রী, জানা ছিল না তার। পরিস্থিতি আজ জানিয়ে দিয়েছে কবি সুমি রহমানের স্বামী রোকসানা চৌধুরীর সেই হারানো মানুষ।
সুমি রহমান জাবেদের সাথে ফোনে কথা বলে রোকসানা চৌধুরীকে বললেন, ও কিছুক্ষণ পর আসবে আপা। অফিস থেকে রওনা দিয়েছে। রোকসানা চৌধুরীর হাত-পা ঘেমে যাচ্ছে। জাবেদ এক্ষুণি বাসায় আসবে। না, ওই বিশ্বাসঘাতকের মুখোমুখি হবার ইচ্ছে নেই রোকসানা চৌধুরীর। এখান থেকে এক্ষুণি চলে যেতে হবে। কিন্তু এখনই যেতে চাইলে সুমি রহমান যেতে দেবেন না। তাই মিথ্যার আশ্রয় নেন রোকসানা চৌধুরী।
আপা, আপনাকে এত অস্থির দেখাচ্ছে কেন? কোনো সমস্যা?
বাসা থেকে মেসেজ এসেছে মোবাইলে। আম্মা স্ট্রোক করেছেন। আমাকে এক্ষুণি উঠতে হবে।
সে কি, এখনই চলে যাবেন?
অবশ্যই। পরে অন্য একদিন আসব। বিবাহ বার্ষিকীতে আপনাদের জন্য শুভকামনা থাকল। উঠি তবে।
সুমি রহমান আর না করতে পারেননি। বিবাহ বার্ষিকীতে উপস্থিত থাকার চেয়ে অসুস্থ মায়ের কাছে থাকাটা জরুরি বলে ভাবছেন সুমি রহমান।
বিদায় নিয়ে রোকসানা চৌধুরী বাসা থেকে বের হলেন। যদি আর কোনোদিন সুমি রহমান তাকে এখানে আসার আমন্ত্রণ জানান, তিনি মুখের ওপর না করে দেবেন। কারণ, এটা সেই বিশ্বাসঘাতকের বাসা, যে রোকসানা চৌধুরীর জীবনটাকে বদলে দিয়ে একাকী নিঃসঙ্গ করে দিয়েছে।