গৃহ

জুয়েল আশরাফ

সূর্য মধ্যগগনে। বিটুমিনের কালো রাস্তা তেতে উঠেছে। গরমে যাত্রীদের অস্থিরতা বাড়ছে। রাস্তার একধারে বাসে তিন উৎসুক যুবতী ওঠে ভিড়ের ওপর দিয়ে দেখতে চায় সিটদখলের লড়াই। ওদের একজনের কোলে এক ফুটফুটে গোলগাল শিশু অবাক চোখে মাথা ঘুরিয়ে কা-কারখানা বোঝার চেষ্টা করছে। বছর দেড়-দুই বয়স হবে। মাঝে-মাঝে অকারণে খলবল হেসে উঠছে। মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কারও চুল ধরে টানছে। খুব দুষ্টু। ওর হাবভাবে মজা পেয়ে অন্যমেয়েরা হেসে কুটিপাটি। আদর করে নরম বাদামি চুলের শিশুটিকে কোলে নিচ্ছে, কিন্তু সে চটপট ফিরে যাচ্ছে মা’র কাছে। এতক্ষণে হারিছের নজর গেল বাচ্চাটার দিকে। দৃষ্টি ফিরিয়ে আবার জানালার বাইরে তাকাল সে। আজ তার কষ্ট হচ্ছে। তার খুশি হওয়া উচিত, কারণ ছয়মাস পর সে নিজের বাড়ি ফিরছে। বিশাল কাচের দরজা, আধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিস, কম্পিউটার এবং টার্গেটের ব্যস্ততম জগত থেকে সাময়িক নিস্তার পেয়ে বাড়ি যাচ্ছে। সেখানে একজনকে নিয়ে জীবনের একটি সুন্দর ছবি আঁকতে হবে বাস্তবতার ক্যানভাসকে রঙে পূর্ণ করে।
বাস ছাড়ার এখনও সময় হয়নি। নিজের সিটে বসে জীবনের অঙ্ক কষছে হারিছ। হঠাৎ বন্ধু আরিফের ঘটনা মনের মধ্যে চেপে বসে। আরিফ এবং শাকুরা দুজনে একই কোম্পানিতে চাকরি করতো। তারা একে অপরের ভালো বন্ধু নিজেদের গল্প শেয়ার করতো। সময়ের সঙ্গে দুজন এত কাছে এলো যে, জীবনসঙ্গী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিছুদিন প্রেমজীবন কাটিয়ে গাঁটছড়া বাঁধল তারা। চাকরির টানাপোড়েনে এবং সেলস টার্গেট তাদের সম্পর্ককে খারাপ করে দিল। দ্রুতগতির জীবনযাত্রা এবং আরও বেশি করে পাওয়ার আকাক্সক্ষা তাদের জীবনকে বিষিয়ে তোলে। এই বাড়বাড়তি ও গতির কারণে দুজনের মধ্যে অবিশ্বাসের স্রোত বাড়তে থাকে। শাকুরা পদোন্নতি পেয়ে পৃথিবীতে হাঁটার পরিবর্তে আকাশে উড়তে শুরু করে। আজ সিঙ্গাপুর, কাল জাপান। আধুনিকতা আর অর্থের কাছে সে অন্ধ হয়ে যায়।
দুবছর আগে যখন শাকুরার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়, তখন তার সরলতায় মুগ্ধ হয়েছিল আরিফ। কিন্তু বিয়ের দুবছর পর বদলে যায় শাকুরার চেহারা। নিজেকে পুরোপুরি আধুনিকতার ছাঁচে ঢেলে দেয়। এখন তার বিবাহিত জীবনের জন্য সময় নেই। ক্যারিয়ারের ভূত তার ঘাড়ে বাসা বেঁধেছে। মনের মিলন ঠিক মতো হচ্ছে না। তাহলে সেখানে কী দরকার এই বিয়ে টিকিয়ে রাখার! প্রতিদিনই কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া। অবশেষে প্রত্যাশা, খোলামেলাতা এবং ক্যারিয়ারের উচ্চাভিলাষের কারণে বিবাহটি বিচ্ছেদে পরিণত হয়। প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে যায় আর হারিছ তার প্রিয় দুই বন্ধুকে হারায়। এই ঘটনার পর যেন নীরবতা ঢেকে রেখেছে আরিফকে। জীবন তার শূন্যতায় ঘেরা। বেশ কয়েকদিন ধরেই মানসিক অবসাদে ভুগছে সে। হারিছ সেই কথাটি মনে করল, জীবন বদলাতে সময় লাগে না, সময় বদলাতে জীবন লাগে।
হঠাৎ কারো আসার আওয়াজ হলো আর হারিছ সম্বিৎ ফিরে পেল। সে দেখতে পেল তার পাশে একজন মডেল মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার সিট খুঁজছে। দেখতে পরিপক্ক হলেও খুব সুন্দর। আধুনিক পোশাক ও আঁটসাঁট পোশাকে তার আকর্ষণ আরও বেড়ে গেছে। দুধের মতো ফরসা শরীর, লম্বা চুল, স্থূল শরীর, গভীর কালো নেশামাখা চোখ, তন্দ্রাচ্ছন্ন আচার-আচরণ। সে আসার সঙ্গে সঙ্গেই অনেকের দিকে তাকাল। বাসের সব মেয়েরা তার দিকে তাকিয়ে হতবাক হয়ে গেছে। তার শাড়িটা কেমন উজ্জ্বল, শুভ্রতার আভা! একজন ওঠে বললো, আমার মনে হয়, আপনার সিট এখানে।
লোকটি দ্রুত সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দিল।
মেয়েটি অভিনয়ের হাসি হেসে বলল, আপনি খুব ভালো, আপনার উদ্বেগের জন্য ধন্যবাদ।
মেয়েটি একটি কথার ধনুক দিয়ে তির ছুঁড়ে দিয়েছে লোকটিকে। লোকটি মনে হলো হতভম্ব। এবার মডেলগোছের মেয়েটি হারিছের দিকে ফিরে এলো।
শুনছেন! আমি আপনার পাশে বসি। আপনি কিছু মনে করবেন না, আমি যদি জানালার সাইটে বসে থাকি …।
ওহ নিশ্চয়ই, কেন নয়! আপনি আরাম করে বসুন …।
বলতে বলতে হারিছ মেয়েটিকে জানালার সিট দেয়। হারিছ পরের বাক্যটি শেষ করতে পারার আগেই মেয়েটি নিজেকে সিটে বসিয়ে দিয়ে বলল, ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ।
এরপর দুজনই চুপ করে থাকলো। হারিছ একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। মনে মনে সর্বশক্তিমানকে ধন্যবাদ জানাল। আজ চাঁদ বেরিয়েছে রাস্তায় … তার চোখ দুটি বন্ধুত্বপূর্ণ মুখ খুঁজছে। কিন্তু পরের মুহূর্তে হারিছের বুঝতে সময় লাগেনি যে মেয়েটি শুধু আধুনিক নয়, খুব আধুনিক এবং সাজসজ্জার নেশায় মত্ত। তার জবজবে পারফিউমের মাতালগন্ধ আর স্পর্শ হারিছের ভেতরটাকে নাড়াতে থাকে। কিছুক্ষণ পর বাস ছেড়ে দিল। হারিছ একদৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকাল।
আরে এ কী! গড়িয়ে পড়ল … এসির শীতল বাতাস আর জানালার সাপোর্ট! মেয়েটা ঘুমের কোলে চলে গেল … ভেবেছিল ভালো টাইম পাস হবে, কিছু কিছু হবে, কিন্তু এ কী!
হারিছ তার গন্তব্য জানে। তার চিন্তাকে সংযত করে এখন তার জীবনের কথা ভাবতে লাগল। মেয়েটির ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে তার মনকে নতুন মোড় দিল। হারিয়ে গেল বাড়ির স্মৃতিতে। বাড়িটা তার বাবার। যেখানে রোদ-ছায়া-শান্তি। ফোনে বাবা তাকে জানিয়েছেন, তার বিয়ের কথা চলছে এবং মেয়ে দেখার দিন-তারিখ ঠিক করা হয়েছে। কিন্তু হারিছ ঘাবড়ে যাচ্ছে। সে চেয়েছিল, ছোটবোনের আগে বিয়ে হলে বাবা-মায়ের বড় দুশ্চিন্তা কেটে যাবে। কিন্তু এমনটা হয়নি। এত কিছুর পরেও প্রতিটি ভাবনার কথা সত্যি হয় কোথায় ! আচ্ছা, এখন দেখাদেখিটা করতেই হলো। তার মুক্তজীবনে মজার কোটা বোধ হয় পূরণ হতে চলেছে।
হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি পড়ল আর মেয়েটার মাথাটা একটু হারিছের কাঁধে শুয়ে পড়ল। তার চুলগুলো হারিছের কাঁধে স্পর্শ করতে থাকে। সে একটু অদ্ভুত বোধ করতে লাগল। মনের মধ্যে স্বপ্নের বৃষ্টি শুরু হলো। মেয়েটির মাথাটা তার ওজন না দিয়ে তাকে আরাম দিচ্ছে। সর্বোপরি, সেও একজন মানুষ, তারও অনুভূতি আছে। কিন্তু হায় ভাগ্য! একটি প্রচ- নদীর কাছে থাকা সত্ত্বেও, তাকে হতাশায় জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাতে বাধ্য করা হয়েছে। উত্তেজনা আর উত্তাপে ক্লান্ত চোখের পাতা অচিরেই ঘুমের হ্রদে ভেসে উঠতে লাগল। সে যখন জেগে উঠল, তার শহর তাকে স্বাগত জানাচ্ছে। বাস গন্তব্যে এসে থামে। আর পাশের মেয়েটি অনুরণিত বাতাসে অদৃশ্য হয়ে যায়। সবকিছু হঠাৎ এমন কিছু জাদুর মতো ঘটে গেল যে হারিছ বিশ্বাস করতে পারল না। কিছুদিন হলো সে স্বপ্নেও বাস করছে না! এভাবেই সে উপলব্ধি করতে লাগলো। বাস্তবতার মামলায়, এই শতাব্দীর মুখে দাঁড়িয়ে সে স্থির হয়ে যাওয়া মেয়েটির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। শুকনো পাতার মতো সুখের ঝরে পড়া অনুভব করে, সে প্রশান্তিময় মুহূর্তগুলো তার হাত দিয়ে বালির মতো পিছলে যেতে দেখছে। এ ছাড়া সে কী করতে পারে? মরুভূমিতে অনেক পানি থাকলেও নেশার এই দশা!
সে এমন সুখের আশা করেনি, তবে সে সাধুও না। মৃদুমন্দ শীতল হাওয়া এলো মনকে সান্ত¡না দিয়ে। তারপর ভাবিয়ে তোলে এমন অমৌসুমি বাতাসের ভরসা কি! নিজের ইচ্ছায় প্রবাহিত হয়, কখনও পূর্ব কখনও পশ্চিমে। এখন অজান্তেই বিষণœতা এসে তার সারা শরীরকে গ্রাস করল। একজন ভাবুকের কণ্ঠ মনের মধ্যে ধীরে ধীরে কড়া নাড়ল- এ শতাব্দী নারীর শতাব্দী। তাদেরও নিজেদের মতো করে জীবনযাপন করার অধিকার রয়েছে।
ুহারিছের আগমনের খবরে পরিবারের সদস্যরা খুব খুশি। পরিবারের সদস্যদের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সে একমত পোষণ করেছে। সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষ করে হারিছ সন্ধ্যায় বাবা-মা এবং বোন ডোরার সঙ্গে মেয়ে দেখতে যেতে রাজি হলো। কেনই বা রাজি হবে না, এত কিছুর পরেও মেয়ে দেখার প্রোগ্রাম করা হলো! অফিস থেকে ছুটি নেয়াটা তার জন্য নাকে ছোলা চিবানোর মতো! কিন্তু কি আর করা, বাবার ডাকটা এতই জেদভরা ছিল যে সে চাইলেও এড়াতে পারেনি। হারিছ জানতো, বসের কাছে ছুটি চাওয়ার অর্থ তার কথা শোনা। তার অনুমান সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের পর অবশেষে পাঁচদিনের ছুটি মঞ্জুর হলো, তাতেই জীবনের সিদ্ধান্ত নিতে হলো। দেহ, মন ও আত্মার মিলনের লক্ষ স্থির করা।
মেয়ে দেখার অনুষ্ঠান ঠিক সময়েই শেষ হয়ে গেল। সম্পর্কটা জাত-ভ্রাতৃত্বের সঙ্গে, যেটা আজকাল খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে! এই সম্পর্ক নিয়ে বাড়ির লোকেরা খুব খুশি। হারিছের বাবা-মা মেয়েটিকে খুব পছন্দ করলেন। বোন ডোরাও এই সম্পর্ক নিয়ে খুব খুশি। হারিছের বাবা লুৎফর রহমান সরকারি ব্যাঙ্ক থেকে অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার হিসাবে গত বছর অবসর নিয়েছেন। তিনি মেয়েটির পরিবারকে খুব ভালো করেই জানেন। তারা ভাবছেন, হারিছ বিয়ে করলে এ বছর মেয়ে ডোরার বিয়েটাও হয়ে যাবে। মেয়েটির বাবা হোজায়ফা রেলওয়ের একজন সিনিয়র অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। মা একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক যথেষ্ট পেনশন পাচ্ছেন। তাদের একমাত্র মেয়ে জুয়াইরিয়াকে খুব আদরে বড় করেছেন পড়াশোনায়। লম্বা ফরসা সিøম ভালো চাকরিজীবী প্রকৌশলী জুয়াইরিয়ার বেতনও ভালো। ব্যবসায়িক সফরের জন্য বিদেশভ্রমণ তার জন্য সাধারণ ব্যাপার।
জুয়াইরিয়া অবশ্যই আধুনিক, তবে বিয়ের ছাঁচে পড়ার পরে সে পারিবারিক দায়িত্বে পড়বে। এমনটাই লুৎফর সাহেব বিশ্বাস করেন। হারিছও একটা উড়ন্ত পাখি। লুৎফর সাহেব চাচ্ছেন শীঘ্রই বিয়েটা হোক এবং তারা যেন সংসারে নিমগ্ন হয়। হাই প্রেফাইল পুত্রবধূর আগমনে সমাজে তার মর্যাদা আরও বাড়বে। উভয় পরিবারের মধ্যে স্নেহের সম্পর্কও বাড়বে। সন্তানদের জীবনে নতুন রঙভরানোর স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দুই পরিবারের লোকজন।
দেখা আর স্বপ্ন দেখতে-দেখতে দুদিন কেটে গেল। এরই মধ্যে একদিন জুয়াইরিয়ার বাবার ফোনও এলো লুৎফর সাহেবের কাছে। তিনি হারিছের মতামত জানতে আগ্রহী। লুৎফর সাহেব এখনও এই বিষয়ে হারিছের সাথে খোলামেলা কথা বলেননি, তাই তিনি একদিনের সময় চেয়ে নিলেন। সময়-সুযোগ দেখে পরিবারের সবাই হারিছের সিদ্ধান্ত জানতে চাইল। হারিছের জন্য একটি কঠিন পরীক্ষার সময়। প্রথমে সে তার পরিবারের সদস্যদের মতামত জানতে চাইল। সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে সম্মত হয়ে বলল, আমরা সবাই জুয়াইরিয়াকে পছন্দ করি।
হারিছের মা মিষ্টির বাক্স নিয়ে বসে আছেন। তিনি শুধু ছেলের হাঁ করার অপেক্ষায়। আজ পর্যন্ত হারিছ পরিবারের সদস্যদের প্রতিটি প্রত্যাশা পূরণ করেছে। সে তার বোনকে চোখে রঙিন স্বপ্ন নিয়ে বসে থাকতে দেখল। বাবা নাকে চশমা লাগিয়ে ‘হ্যাঁ’ শুনতে ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন। সবাই অপেক্ষা করছে সুসংবাদের জন্য।
হারিছ লাজুক মুখে বলল, বাবা, আমি আপনাদের অনুভূতিকে সম্মান করি। জুয়াইরিয়া সত্যিই সুন্দরী। ইঞ্জিনিয়ার, আধুনিক নারী।
হারিছের মুখ থেকে এ কথা শুনে তার মা মিষ্টি বিতরণ শুরু করেন। বিষয়টিকে আরও এগিয়ে নিয়ে হারিছ বলল, আমি জুয়াইরিয়ার সাথে বসে যে কথা বলেছি তাতে আমি সন্তুষ্ট। সে আমার কাছে পছন্দের। আমি তার চিন্তাধারাকে সম্মান করি। আমি নিজে একটি কোম্পানিতে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে এগারো থেকে চৌদ্দ ঘণ্টা ডিউটি করি, আমি একজন পেশাদার। জুয়াইরিয়ার মতো অনেক মেয়ে আমার সাথে সহকর্মী হিসাবে কাজ করে। তাই আমি তাদের মানসিক চিন্তাভাবনা এবং অনুভূতি সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন। উচ্চবেতন, লক্ষমাত্রা, পদোন্নতি, বিক্রয় এবং কর্মঘণ্টার চাপে আমাদের জীবন কেবল একটি মেশিনে পরিণত হয়েছে। আমরা বাড়ি, পরিবার ও দেশ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। দেশে ও বিশ্বে যা ঘটছে তা নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। সব সময় কাজের চাপ আর সামনে বসের মুখ! বাবা, আপনি জানেন, আমরা রাজার মতো উপার্জন করি কিন্তু গাধার মতো কাঁদি এবং ভিক্ষকের মতো খাই। এটা কি জীবন, বাবা! এত টাকা দিয়ে কী করবেন, যখন আরামের খাবার আর শান্তিতে ঘুমানো আপনার ভাগ্যে নেই!
হারিছ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। উচ্চবেতনের চাকরি কীভাবে মানুষকে ব্যক্তিগত জীবন থেকে দূরে সরিয়ে দেয় সে বিষয়ে সে দুঃখপ্রকাশ করল। সবার মুখেই নীরবতা। কেউ জানে না সে পরবর্তীতে কি বলতে চলেছে। একটা দীর্ঘনিশ্বাস নিয়ে হারিছ আবার বলতে শুরু করল, বাবা, আমি খুব বেশি টাকা রোজগার করতে চাই না। ক্যারিয়ার, প্রফেশনাল ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু আপনার জন্য ঘরের লক্ষ্মীর মতো পুত্রবধূ চাই। যার কাছে আমাদের সকলের কথা ভাবার মতো যথেষ্ট সময় থাকবে। আমাদের সুখ ও দুঃখ তার হবে। আপনার নাতি-নাতনিরা তাদের বাবা-মা বা দাদা-দাদির মমতায় বড় হবে। মা-বাবা এবং দাদা-দাদির ছায়ায় বেড়ে উঠবে। বাড়ির রান্নাঘরে সময় দেবে, বাগানে ঘুরে বেড়াবে।
আরিফ আর শাকুরার সেই নিষ্পাপ মুখটা হারিছের চোখে ভেসে উঠল। যখন শাকুরা নতুন চাকরি পেল আর পাখিরা উড়তে শুরু করল। ডানার শক্তি পাওয়ার সাথে সাথে তারা তাদের জমি ভুলে গেছে। তাদের বাহুতে আকাশ ঢেকে রাখার চেষ্টায় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এগিয়ে গেল পাখিরা!
বোন ডোরা বলল, ভাই কোথায় কোন ভাবনায় চলে গেলে! এটি আমাদের প্রশ্নের উত্তর নয়। শুধু খোলাখুলি কথা বলো।
ডোরার কন্ঠে হারিছের ভাবনা ভাঙল। সে আরও বলল, জুয়াইরিয়ার এত সময় কোথায়, বাবা? আমাদের সত্তায় বিশ্বাস করা উচিত, চেহারায় নয়। আমাদের দুজনের চিন্তাভাবনা ভিন্ন-ভিন্ন ঋতুর প্রকৃতি দ্বারা চালিত দুই মেরুর মতো। বিদেশে তার আকর্ষণ বেশি। আমিও দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াই, কিন্তু আমরা মাটির মমতা করি, দেশকে ভালোবাসি। আমি আমার দেশকে নিয়ে গর্বিত। বাংলাদেশি হিসাবে গর্বিত। বাবা, আমি ওই মেয়ের যোগ্য নই! জুয়াইরিয়া তার জায়গায় ঠিক আছে। সে তার ধারণার সাথে আপস করতে প্রস্তুত কিন্তু আমি তার স্বপ্নগুলোকে মরতে দিতে চাই না। আমি দুঃখিত বাবা, আমি আমার মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাই না। জুয়াইরিয়াও তার স্বপ্নের লাগাম লাগাতে চায় না। আমার বাস ছাড়ার সময় হয়ে গেছে, আমাকে কিছুক্ষণের মধ্যে চলে যেতে হবে।
এই বলে হারিছ বাবা-মাকে একবার বুকের মধ্যে আগলে নিল। বোনকে আদর দিল। সবার চোখ ভিজে উঠল।