ওসমান গণি :
আমরা সবাই বই পড়তে ভালোবাসি। যুগে যুগে জ্ঞানী -গুণীব্যক্তিরা যেসব মূল্যবান কথা আমাদের জন্য রেখে যান, সেসব গল্প-কাহিনি আমাদের মনকে দোলা দিয়ে যায়, সেসব জানার জন্য মন আমাদের
কত আকুলি-বিকুলি করে। মহাপুরুষেরা তাঁদের রচনায় রেখে যান অমর প্রতিভার স্বাক্ষর। তাঁরা যুগে যুগে আমাদের চিন্তাজগতে আলোড়ন তোলেন, বদলে দেন আমাদের জীবনের গতিপথ। আমরা অনুপ্রেরণা পাই নতুন পথে চলার। কোরান, বেদ, বাইবেল যেমন জন্ম দিয়েছে নতুন জাতির। ভলতেয়ার, রুশো, গোর্কি তেমনি দিয়ে গেছেন সমাজগঠনের নতুন নতুন ইঙ্গিত। বইয়ের মধ্যে বন্দি হয়ে আছে মানুষের যুগ-যুগসঞ্চিত অভিজ্ঞতার মণিমাণিক্য।
দেশে দেশে ভ্রমণ করতে কতই না আনন্দ! হিমালয়ের বুকে খেলতে, ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতের সৌন্দর্য দেখতে, এস্কিমোদের সাথে মিশতে কতই না সাধ জাগে। কিন্তু সাধ থাকলেও সব সময় সাধ্য থাকে না। কত বাধা, কত বিঘœ এসে পথরোধ করে দাঁড়ায়।
ও-সব দেখা জীবনে হয়ত কখনই হয়ে ওঠে না।
কিন্তু এতে অসুবিধার কিছুই নেই। আমাদের হাতের কাছে রয়েছে বই। বইয়ের মধ্যে লেখা রয়েছে প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে নানাকথা। বই পড়, তোমার চোখের সামনে ধরা পড়বে হিমালয়ের সৌন্দর্য, ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতের মধুর দৃশ্য। বই-ই তোমাকে জানিয়ে দেবে এস্কিমোদের আচার-ব্যবহার, পোশাক-পরিচ্ছদ। তাদের আহার বিহারের খুঁটিনাটি সব তথ্য।
তোমার হয়তো কোনো বিখ্যাত ব্যক্তি সম্পর্কে জানার খুব আগ্রহ। কিন্তু তিনি হয়তো মারা গেছেন অনেক আগে। তিনি তো আর এই পৃথিবীতে নেই। কী করে জানবে তুমি তাকে? ধর তুমি রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে জানতে চাও। জানতে চাও কবি ইকবাল সম্বন্ধে। শেক্সীপার কে ছিলেন? কোথায় ছিল তাঁর বাড়ি?
জানা যাবে কেমন করে? এখন উপায় কি? উপায় নিশ্চয় আছে। তাঁরা যেসব বই লিখে গেছেন, সেসব পড়। তাঁদের সম্পর্কে তোমার নিশ্চয় ধারণা হবে।
ওঁদের সম্পর্কে অন্যরা যেসব বই লিখেছেন, সেসব বই পড়লে ওঁদের সম্পর্কে তোমার ধারণা আরও স্পষ্ট হবে। ওঁদের জীবনী পড়, তাহলে জানবে কেমন করে তাঁরা সামান্য অবস্থা থেকে পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের ফলে জগদ্বিখ্যাত হয়েছেন। বই-ই তোমাকে ওঁদের অন্তরঙ্গ করে গড়ে তুলবে। ওঁদের সাথে গড়ে উঠবে তোমার নিবিড় বন্ধুত্ব।
রাত্রির অন্ধকারে অসীম আকাশে কত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তারা জ্বল জ্বল করছে। আর কত বিনিদ্র রজনী জেগে জেগে কত জ্যোতির্বিদ দুরবিন চোখে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। তোমরাও তো ওদের দিকে চেয়ে থাক। কিন্তু ওদের মধ্যকার কোনো রহস্য কি খুঁজে পাও ? জ্যোতির্বিদদের রচিত বই পড়। জানতে পারবে নীল আকাশটা কত রহস্যময়।
অতল সমুদ্র সম্বন্ধেও তোমাদের কত আগ্রহ। কিন্তু সে সম্বন্ধে জানতে পারবে কি করে। সেখানে যাওয়া অত সহজ নয়। কত নাম-না-জানা হিংস্র জীব-জানোয়ার রয়েছে ওর তলায়। কত হাঙর, অক্টোপাস সেখানে ঘুরে বেড়ায় শিকারের সন্ধানে। একটু সুযোগ পেলেই সে তোমার জীবন সংহার করবে। কিন্তু এত কষ্ট, এত বাধা সব তুচ্ছ করে ডুবুরিরা যায় সেখা মণিমুক্তার খোঁজে। জীবন বিপন্ন করে এই যে রহস্যময় সমুদ্র, সেখানে হয়তো তুমি কখনো যেতে পারবে না।
কিন্তু ওর
তলদেশ সম্পর্কে তোমার জানার আগ্রহের তো সীমা নেই। তোমাকে জানতেই হবে সেখানকার রহস্য। তাই বইয়ের আশ্রয় নেয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই তোমার। বই-ই সর্বক্ষেত্রে সর্ববিষয়ে তোমার সঙ্গী। তাকে ছাড়া তোমার এক পা-ও চলার উপায় নেই। বই তোমাকে পড়তেই হবে কৌতূহল নিবারণের জন্য। তাহলে বুঝতেই পারছ, মানুষ পড়ে জানবার জন্য।
দুনিয়ার বুকে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে হলে তাকে পড়তেই হবে। জানতে হবে নিত্যনতুন খবরÑ বিজ্ঞানের চমকপ্রদ আবিষ্কার, সারা দুনিয়ার হালচাল। নিজেকে যদি তুমি দেশের ও দশের প্রয়োজন মতো গড়ে তুলতে না পার, তাহলে মানবসমাজে তোমার ঠাঁই নেইÑ তোমার মানবজন্ম ব্যর্থ।
তোমার খুব ইচ্ছা হল, তুমি প্রচুর বই পড়বে। কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও তুমি সব বই পড়তে পার না। এখানেও নানা বাধা আছে। সব চাইতে বড় প্রশ্ন টাকার, যা দিয়ে তুমি তোমার পছন্দ মতো বইটা কিনবে।
অনেক সময় টাকা থাকলেও পছন্দসই বই বাজারে পাওয়া যায় না। আর বাজারে পাওয়া গেলেও অত বই কেনা সহজও নয়। প্রতিবছর সারা পৃথিবীতে হাজার হাজার বই ছাপা হচ্ছে। তার ক’খানা তুমি কিনবে? আর তোমার পক্ষে সবগুলোর খোঁজ রাখাও দুরূহ ব্যাপার। তাহলে এ সমস্যার সমাধান কি?
লাইব্রেরি হচ্ছে লেখক ও পাঠকের মিলনকেন্দ্র। তাই লাইব্রেরিয়ানকে প্রায় সব বইয়ের খোঁজ রাখতে হয়। তোমার প্রয়োজন অনুযায়ী বই দিয়ে তিনি তোমার মনের ক্ষুধা মেটাবার চেষ্টা করেন। বই পড়ে তোমার পার্থিব, নৈতিক এবং মানসিক চাহিদারও নিবৃত্তি হতে পারে। তুমি নিজেকেও গড়ে তুলতে পার সত্যিকার মানুষ হিসেবে।
বই তোমাদের খুব দরকারি। বই তোমাদের কত জ্ঞানদান করে, জ্ঞান আহরণের জন্যই তুমি এত বই পড়। কিন্তু বই নেই, তুমি কি এমন পৃথিবীর কথা ভাবতে পারো? ভাবতে পারা কঠিন বটে। আমরা তো বই ছাড়া চলতেই পারি না। তবু কিন্তু মানুষ হাজার হাজার বছর বিনা বইয়ে কাটিয়ে দিয়েছে। ভাবতে খুব অবাক লাগে, তাই না? তুমি হয়তো বলে বসবে, তাহলে তাদের চলত কি করে? তারা একে-অপরের কাছে মনের ভাব প্রকাশ করতো কিভাবে? এখানে সে-কথাই তোমাদের বলছি।
যখন থেকে মানুষের জন্ম হয়েছে, সেই আদিকাল থেকেই মানুষ তার মনের ভাবপ্রকাশ করে আসছে। যেমন তুমি একখানা ভাল বই পড়লে। সেই বইখানা পড়ে তুমি প্রচুর আনন্দ পেয়েছ। তুমি সে কথা জানাতে চাও তোমার বন্ধুকে। বন্ধুটি কাছে থাকলে কোনো অসুবিধা নেই। তোমার মনের কথা তাকে মুখে মুখে বলতে পার। কিন্তু বন্ধুটি দূরে থাকলে তুমি কি কর? কাগজ-কলম নিয়ে তোমার মনের কথা অক্ষরের পর অক্ষর সাজিয়ে তোমার বন্ধুর কাছে পাঠাও। সে তোমার লেখা পড়ে বুঝতে পারে, বইখানি সম্বন্ধে তুমি তাকে কি বলতে চাও। যে সময়ের কথা বলছি, সেই প্রাচীনকালেও মানুষ তোমার মতো একে-অপরের নিকট মনের ভাবপ্রকাশ করত। কিন্তু সে সময় কাগজও ছিল না, অক্ষরও আবিষ্কার হয়নি। কি করে লিখতে হয়, সে-জ্ঞানও তাদের ছিল না। তার উপর সবাই বুঝতে পারে, এমন কোনো ভাষাও তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়নি তখন। কি করে লিখতে হয়, সে জ্ঞানও তাদের ছিল না। কি করে সবাই বুঝতে পারে, এমন কোনো ভাষাও তখন তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়নি। তাই একের কথা অপরের পক্ষে বোঝাও অত সহজ ছিল না। তাহলে সে সময় মানুষ কিভাবে তার বন্ধুর কাছে মনের কথা বলত?
তুমি যেমন কোনো কিছু বোঝাতে হলে বাংলা ইংরেজি লিখে তোমার মনের ভাব প্রকাশ কর,ত খনকার দিনে মানুষ কি করত? তুমি-আমি সে যুগে জন্মালে আমরাই বা কি করতাম? তুমি আমাকে কোনো জিনিস বোঝাতে চাইলে তোমাকে সে বস্তুটির ছবি আঁকতে হত। ধর, তোমার সামনে একটি বিড়াল আছে। তুমি আমাকে সে বিড়ালটি সম্বন্ধে বোঝাতে চাও। বিড়ালটির একটি ছবি আঁক। তাহলেই আমি তোমার মনের কথা বুঝতে পারব।
তবে তাই বলে তোমাকে যে একজন ওস্তাদ আঁকিয়ে হতে হবে, এমন নয়। আমি যাতে বিড়ালটির আকৃতি মোটামুটি বুঝতে পারি, তেমন করে আঁকতে পারলেই হল। তাই সবচাইতে পুরনো পদ্ধতি। লেখা হল- ছবি এঁকে লেখা। ছবি আঁকতে আঁকতেই মানুষ একদিন অক্ষরের সৃষ্টি করেছিল। অর্থাৎ প্রথম অক্ষর সৃষ্টি হয়েছিল ছবি থেকেই। এই যে ছবি এঁকে লেখা এর নাম চিত্রলিপি।
প্রথম মিসর দেশে চিত্রলিপির প্রচলন হয়।
১৮৭৯ সালের কথা। স্পেন দেশে সাউটুলা নামে এক প্রতœতত্ত্ববিদ বাস করতেন। একদিন তিনি তার ছোট্ট মেয়ের হাত ধরে এক গুহার মধ্যে ঢুকলেন, পরীক্ষা করবেন বলে। এর চার বছর আগেও তিনি গুহার মধ্যে ঢুকেছিলেন। কিন্তু তখন তার চোখে কিছুই পড়েনি। এবারও হয়ত তার চোখে কিছুই পড়ত না। মেয়েটি তার সঙ্গে ছিল, তাই রক্ষে।
গুহাটার ছাদ ছিল নিচু। সাউটুওলা মাথা হেট করে পাথর খুঁজছিলেন। মেয়ের কোনো কাজ ছিল না। তাই সে বাতি হাতে এদিক-ওদিক দেখছিল। হঠাৎ তার নজরে পড়ল গুহার ছাদের দিকে। ছাদে ওসব কি? মেয়ে চিৎকার করে উঠল। বাবা টেরো টেরো। সাউটুওলা মাথা উঁচু করে দেখবেন তার উপায় নেই। তবু মেয়ের চিৎকারে ঘাড় বেঁকিয়ে তিনি মেয়ের দৃষ্টি অনুসরণ করলেন। ছাদের দিকে নজর পড়তে তিনিও অবাক। চোখ তাঁর আটকে রইল গুহার ছাদের ওপর। সাউটুওলার পলক আর পড়ে না। গুহার ছাদ জুড়ে আঁকা রয়েছে সব জন্তু জানোয়ারের ছবি। ‘টেরো’ শব্দের অর্থ ষাঁড়। আসলে মেয়েটা দেখেছিল কতগুলো বাইসনের ছবি। সাউটুওলার আর আনন্দ ধরে না। এতদিন তিনি যা খুঁজে বেড়াচ্ছেন, আজ তার সন্ধান পেলেন। তিনি গুহার আরও ভেতরে ঢুকলেন। সুড়ঙ্গগুলো পরীক্ষা করলেন। আবিষ্কার করলেন আরও অনেক ছবি। প্রতœতত্ত্বের আবিষ্কারে যারা নাম রেখেছেন,তাদের মধ্যে এই মেয়েটিই সকলের ছোট।
মেয়েটির বয়স মাত্র পাঁচ বছর। ঐ গুহাটির নাম কি বল তো? আলতামিরা। সেদিন ওই গুহার নাম বড় একটা কেউ জানত না। কিন্তু আজ হয়েছে বিশ্ববিখ্যাত। প্রথম সাউটুওলার আবিস্কারে কেউই বিশ্বাস করেনি। শেষে প-িতেরা একমত হয়েছেন যে, ওই গুহাচিত্র ও গুহাশিল্প হাজার হাজার আগেকার মানুষের সৃষ্টি।