জুয়েল আশরাফ »
গুলজার মামার মাথায় আজ নতুন খেয়াল। আজ হাটে-টাটে, খেতে-খামারে সবাই যে শুধু একটাই কথা বলছে, এই বছর নৌকা বাইচ হবে মহা জমজমাট!
শুনেই মামার বুক ফুলে ওঠে। তিনি হাঁটছেন আর গুনগুন করছেন, নৌকা মানেই পানি, পানি মানেই ছপছপ, আর ছপছপ মানেই আমার জয়!
আমি বললাম, মামা, তুমি তো জীবনে নৌকা বাইচে নামোনি!
মামা হেসে দাঁত দেখালেন।
বোকা, বাইচ মানে বাইচই তো! নৌকা টানতে কি ডিগ্রি লাগে?
আমি হেসে বললাম, ডিগ্রি না লাগলেও পেটের পেশি লাগে। আর তোমার পেটে তো শুধু ভাতের গুদাম!
মামা রেগে না গিয়ে হাত চাপড়ালেন।
ভাতের গুদাম থাকলেই তো শক্তি বেশি! নৌকা আমি একাই টেনে প্রথম হব। তুই দেখিস!
মামার মাথায় যখন এমন পোকা ঢোকে, তখন তাকে থামানো যায় না। দুপুরে গরম রোদে মাঠের ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন মামা। গায়ের গেঞ্জি অর্ধেক ঘামে ভিজে গেছে। এক হাতে গামছা, আরেক হাতে বাঁশ। আমি পিছনে হাঁটছি।
রাস্তার লোকেরা হাসাহাসি করছে।
কোথায় যাইতেছ গুলজার ভাই?
মামা গম্ভীর গলায় বললেন, নৌকা বাইচে নামুম।
শুনেই সবাই খিলখিল করে হেসে উঠল।
কেউ বলল, আবার গাধার খেলা!
কেউ বলল, পানিতে নামলে ডুবে যাবে!
মামা একেবারেই পাত্তা দিলেন না।
আমাকে কানে কানে বললেন, তুহিন, শোন। হাসুক না। শেষমেশ যখন আমি চ্যাম্পিয়ন হই, তখন এরা সবাই আমার পায়ে ধরে সালাম দেবে।
বিকেলে আমরা গেলাম নদীর ধারে। হাটবারের দিন। দুই পারে লোকের ভিড়। মাইকে ঘোষণা হচ্ছে, এবার নামবে ‘পদ্মাপুত্র’ আর ‘মেঘনামল্লিক’। তারপর নামবে ‘জোয়ারঝাঁপা’।
গুলজার মামা হুড়মুড় করে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। বললেন, আমার নৌকা কোনটা?
লোকজন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। একজন বলল, আপনে তো তালিকায় নাম দেন নাই!
মামা হা করে বললেন, নাম না দিলে কী হইছে? নৌকা তো আছে! ওই যে খালি নৌকাটা বাঁধা আছে। আমি ওইটায় নামুম।
আয়োজকরা মাথায় হাত দিল। কিন্তু মামাকে ঠেকানো যায় না। তিনি খালি নৌকায় চড়ে বসলেন। বসে সঙ্গে সঙ্গে বউরানির মতো হাত নেড়ে বললেন, চলো, চালাও!
আমি তাড়াতাড়ি চিৎকার দিলাম, মামা, বাইচে তো নৌকা চালাতে হয়! শুধু বসে থাকলে চলবে না!
মামা বললেন, ওরে বাবা, তা তো ঠিক।
তারপর বাঁশ দিয়ে এক ঠেলা দিলেন।
ঠেলাতেই নৌকা ঘুরে উল্টো দিকে চলে গেল। ভিড় থেকে হট্টগোল উঠল, আরে! গুলজার ভাই নৌকা উল্টোদিকে বাইতেছে!
আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছি। মামা ঘেমে নেয়ে একাকার। তিনি চেঁচাচ্ছেন, তুহিন, দিকটা কোনটা? সামনের দিকটা কই?
আমি বললাম, যেদিকে মুখ ফিরায়ে চিৎকার করতেছ, ওটাই পেছন!
লোকজন হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। কেউ বলছে, গাধা তো গাধাই!
কেউ আবার হাততালি দিচ্ছে, গুলজার ভাই, এভাবেই চালান!
মামা অনেকক্ষণ ধরে উল্টোদিকে নৌকা বেয়ে চলেছেন। লোকজন হাসতে হাসতে পেটে ব্যথা করছে। কেউ বলছে, এইভাবে তো মামা বাজারে চলে যাবে!
কেউ বলছে, এবার গাধা না, মামাকে নদীর কই মাছ ডাকতে হবে!
মামার মুখ গরম লাল। তিনি দাঁত কামড়ে দাঁড় টানলেন। নৌকাটা এমন দৌড় দিল যে চোখের পলকে ভিড়ের সামনে এসে পড়ল।
হট্টগোল-
আরে বাপরে! গুলজার ভাইয়ের নৌকা রকেট!
ঠিক তখনই মামার দাঁতকপাটি বাজলো। কারণ নৌকাটা সোজা গিয়ে ধাক্কা খেল ঘোষকের মাইকের খুঁটিতে। ঢ্যাং করে মাইক পড়ল পানিতে। এক সেকেন্ড নীরবতা। তারপর পুরো মাঠে বিস্ফোরণের মতো হাসির শব্দ। নদীর ভেতর ভিজে ভিজে দাঁড়িয়ে মামা বুক ফুলিয়ে বললেন, দেখলা তো তুহিন! একাই আমি পুরো বাইচ থামাইয়া দিলাম। জেতার চাইতেও বড় কাজ আমি করে ফেলছি!
পুরো ভিড় একসাথে হাততালি দিল। কেউ চিৎকার করে উঠল, গুলজার ভাই নৌকা বাইচের আসল চ্যাম্পিয়ন, কারণ বাইচ শেষ করার আগেই বাইচ শেষ করাইছে!