গুমের ঘটনা তদন্তে কমিশন করল সরকার

সুপ্রভাত ডেস্ক »

কমিশন গঠনের একদিন আগে প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে গুমের ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিতের কথা বলেন।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ‘গুমের’ ঘটনা তদন্তে হাই কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারকের নেতৃত্বে কমিশন গঠন করেছে সরকার।

অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের ওই কমিটি গঠন করে মঙ্গলবার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

তদন্ত কমিশন আইন, ১৯৫৬ সালের ক্ষমতাবলে এই কমিটি গঠনের কথা উল্লেখ করে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘আইন-শৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থা তথা বাংলাদেশ পুলিশ, র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বিশেষ শাখা, গোয়েন্দা শাখা, আনসার ব্যাটালিয়ন, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), প্রতিরক্ষা বাহিনী, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই), কোস্ট গার্ডসহ দেশের আইন প্রয়োগ ও বলবৎকারী কোনো সংস্থার কোনো সদস্য কর্তৃক জোরপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানের’ জন্য এ কমিশন।

কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন হাই কোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত বিচারপতি মো. ফরিদ আহমেদ শিবলী, মানবাধিকার কর্মী নূর খান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাবিলা ইদ্রিস এবং মানবাধিকার কর্মী সাজ্জাদ হোসেন।

আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনকালে ক্রসফায়ারের নামে বিচার বহির্ভূত হত্যা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নেওয়ার পর লাশ উদ্ধার বা নিখোঁজের ঘটনাগুলো আলোচনায় ছিল।

এসময় হেফাজতে নিয়ে নির্যাতন, গোপন বন্দিশালায় দীর্ঘদিন আটকে রাখার ঘটনাগুলোও উঠে আসে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে। ডিজিএফআইয়ের বিরুদ্ধে ‘আয়নাঘর’ নামে গোপন বন্দিশিবির তৈরি করে নির্যাতনের অভিযোগও আসে বিভিন্ন প্রতিবেদনে।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ অগাস্ট দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ‘গুমের’ এসব ঘটনা তদন্ত কমিশন গঠনের কথা বলে আসছে অন্তর্বর্তী সরকার। জাতিসংঘের গুম বিষয়ক কনভেনশনে পক্ষভুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথাও জানিয়েছে সরকার।

সোমবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাবসহ সরকারি বাহিনীর যে সদস্যরা ‘গুম, খুন, নির্যাতনের’ মত অপরাধে যুক্ত ছিলেন, তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়া হবে।

তিনি বলেন, “ফ্যাসিবাদী সরকারের বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন, অপহরণ এবং আয়নাঘরের মত চরম ঘৃণ্য সকল অপকর্মের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে। এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত সকলের বিচার নিশ্চিত করা হবে। তালিকা প্রস্তুত করে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা হবে। দুর্নীতি ও সম্পদ পাচারের বিচার করা হবে।”

তার বক্তব্যের পরদিন গঠিত কমিশনের কার্যপরিধিতে ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট পর্যন্ত গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান, তাদের শনাক্ত এবং কোন পরিস্থিতিতে গুম হয়েছে, তা নির্ধারণের ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, “জোরপূর্বক গুম হওয়ার ঘটনাসমূহের বিবরণ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট দাখিল করা এবং এতদ্বিষয়ে সুপারিশ প্রদান করা; জোরপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান পাওয়া গেলে তাহাদের আত্মীয়- স্বজনকে অবহিত করা এবং জোরপূর্বক গুম হওয়ার ঘটনা সম্পর্কে অন্য কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিচালিত তদন্তের তথ্য সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে এই কমিশন।”

এসব উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সংশ্লিষ্ট যেকোনো কার্যক্রমও এই তদন্ত কমিশন চালাতে পারবে বলেও প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে।

কমিশনকে তদন্তকাজ সম্পন্ন করে আগামী ৪৫ কার্যদিবসের মধ্যে সরকারের কাছে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

“মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কমিশনকে সাচিবিক সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি কমিশনের প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহ এবং কমিশনকে সহায়তা দিতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত যেকোনো ব্যক্তিকে দায়িত্ব দিতে পারবে।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বলছে, কমিশনের সভাপতি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারক এবং সদস্যরা হাই কোর্ট বিভাগের বিচারকের মর্যাদা এবং অন্যান্য সুবিধা ভোগ করবেন।

আন্দোলনে সহিংসতা তদন্তে গঠিত কমিশন বাতিল

এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ১৬ থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত ঘটনায় মৃত্যু, সহিংসতা, নাশকতা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা তদন্তে হাই কোর্ট বিভাগের তিন বিচারপতির সমন্বয়ে তদন্ত কমিশন বাতিল করে মঙ্গলবার আলাদা প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।

গত ১ অগাস্ট এক প্রজ্ঞাপনে বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানের নেতৃত্বে ওই কমিশন গঠন করেছিল তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকার।

ওই কমিশনকে তদন্ত শেষ করে ৪৫ কার্যদিবসের মধ্যে সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছিল।

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ১৬ জুলাই পর্যন্ত সহিংসতার তদন্তে প্রথমে এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় কমিশন করে বিচাপতি দিলীরুজ্জামানকে দায়িত্ব দেয় সরকার।

এরপর আন্দোলন চলাবস্থায় এবং দাবির মুখে সরকার কমিটির সদস্য ও তদন্তের আওতা বাড়ায়।

বিচারপতি দিলীরুজ্জামানের সঙ্গে যুক্ত হন তার দুই সহকর্মী বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ার ও বিচারপতি মোহাম্মদ শওকত আলী চৌধুরী।

ওই কমিশনের কাজ চলার মধ্যে গণআন্দোলনের মুখে ৫ অগাস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা।