জুয়েল আশরাফ :
বৈশাখ মাস।
বাড়ির কাছে শিমুল গাছ। অপলক তাকিয়ে আছে জুবাইদা। তার দৃষ্টি মুগ্ধ ও অভিভূত। গাছে লাল আগুন ছড়িয়ে এখন ফুটে আছে শিমুল ফুল। শিমুল গাছে আগুনরঙা লাল ফুলের উচ্ছ্বাস। লাল কমলা রঙের বড়ো বড়ো ফুল। বাহ! দেখতে কী আকর্ষণীয়। জুবাইদার ইচ্ছে হচ্ছে গাছে উঠে হাত ভর্তি ফুলগুলো ছিঁড়ে নিয়ে আসে। কিন্তু গাছটির গায়ে কাঁটা অনেক। একারণেই এই গাছে সে কোনদিন কাউকে চড়ত দেখেনি। একটা পাখি ফুড়ুত ফুড়ুত এ ডাল-ও ডালে নেচে বেড়াচ্ছে। কী পাখি এটা?
জুবাইদা চেঁচিয়ে বলল, ও পাখি কী নাম তোমার? আমাকে একটা শিমুল ফুল পেরে দাও।
পাখিটি তার কথা শুনল না। শুনলেও মানুষের ভাষা বুঝতে পারেনি। জুবাইদা পাখিদের মতন কয়েকবার কিচির মিচির করল। তবু অহংকারী পাখি তার দিকে একবার ফিরেও তাকাল না। মন খারাপ করে ঘরের দিকে হাঁটতে থাকে জুবাইদা।
ঠিক তখনই সে শুনতে পেল, দাঁড়াও যেও না। শোনো কথা আছে।
জুবাইদা পেছনে তাকিয়ে কাউকে খুঁজে পেল না।
আবার শব্দ এলো, উপরের দিকে তাকাও। গাছে। এই আমি এখানে।
জুবাইদা এগিয়ে এসে শিমুল গাছের দিকে তাকাল। নাম না জানা পাখিটা তাকে ডাকছে। সে একেবারে নিচের ডালে নেমে এসেছে। পাখিটি বলল, আমার নাম ঘুঘু। বড় বিপদে পড়ে তোমাদের এই গাছে আশ্রয় নিয়েছি।
জুবাইদা জিজ্ঞেস করল, কী বিপদ?
ঘুঘু পাখি বলল, তোমাদের যেমন করোনা ভাইরাসের কারণে ঘর থেকে বের হওয়া বারণ, আমাদের পাখিদের মধ্যেও এক ধরনের রোগ ছড়িয়েছে। এই রোগের কারণে আমাদের পাখিদের একগাছে একসাথে বসবাস করা যাবে না। একারণে আমি আলাদা বাসা করেছি।
জুবাইদা খুশি হয়ে বলল, আমাকে একটা ফুল ছিঁড়ে দাও ঘুঘু।
ঘুঘু পাখি অভিমানী সুরে বলল, ফুল তো তোমাকে অবশ্যই দেব। কিন্তু তুমি যে আমাকে অহংকারী বলেছ, কথাটা ঠিক বলোনি। পাখিরা কখনো অহংকার করে না। অহংকার করো তোমরা মানুষেরা।
জুবাইদা বলল, মাফ করো পাখি। আমার ভুল হয়ে গেছে।
ঘুঘু বলল, মাফ করতে পারি এক শর্তে। আমাকে গান শোনাতে হবে। শরীরটা ম্যাজ ম্যাজ করছে। গান শুনতে শুনতে ঘুম দেব।
জুবাইদা অবাক হয়ে বলল, আমি তো গান পারি না। কী গান শোনাব?
যেমনই হোক, একটা গান গেয়ে তো আমাকে শোনাতেই হবে। না হলে ফুল পাচ্ছো না।
জুবাইদার ভুরু কুঁচকে এলো। মনে মনে ভারি বিরক্ত হচ্ছে। ঘাড় ত্যাড়া পাখির ঝামেলায় পড়ে গেছে সে। শুধু ঘাড় ত্যাড়া না, ঠ্যাটা পাখি। ঘুঘুর শরীর ভরা ঠ্যাটামিপনা শুধু। জুবাইদার রাগ পেয়ে গেলেও মুখে কিছু বলল না। বরং নরম কোমল গলায় বলল, ও ঘুঘু পাখি ভাই, গান জানা নেই আমার। অন্য কিছুর আবদার করো।
ঘুঘু নীরস গলায় বলল, একটা কৌতুক বলো। শুনে দেখি হাসি পায় কি না। অনেক দিন হাসি আসে না। একারণেই শরীরটা ম্যাড়ম্যাড়ে লাগছে। যদি হাসির কিছু শুনে হাসতে হাসতে ডানা দু’টো চাঙ্গা হয়!
জুবাইদা বলল, হাসির কী না জানি না, তবে তোমাকে একটি গল্প বলি শোনো, এক রাখাল একটি টিয়া পাখি পুষতো। রোজ পাখিটির যতœ নিতো, খাওয়াতো, গোসল করাতো, কথা শেখাতো। এভাবে চার মাস কেটে গেল। টিয়ার সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিল, শুধু কথার বেলায় বেঁকে বসতো। চার মাস চেষ্টার পরও রাখাল টিয়া পাখিকে একটি কথাও শেখাতে পারল না, অথবা টিয়া কথা শিখল না। রাগে দুঃখে রাখাল একদিন টিয়ে পাখিকে খাঁচা থেকে মুক্ত করে দিল। টিয়া তখন ফুড়ুত করে উড়াল দিয়ে ঘরের ছাদে গিয়ে বসল। তারপর বলল, ‘ওরে বোকা রাখাল, আমি তোর চেয়ে ভালো কথা বলতে জানি। এতোদিন বলিনি কারণ, কথা বললে তুই আমাকে কোনোদিন ছেড়ে দিতি না। তাই বোবা হয়ে মুক্তি পাব একদিন অপেক্ষায় ছিলাম। তোর আগে আরও ছয় জনকে বোকা বানিয়েছি!’ টিয়ার কথা শুনে রাখাল তখন আরও বোকা হয়ে গেল। আমার গল্প শেষ, এখন ফুল ছিঁড়ে দাও।
ঘুঘু হো হো করে হাসছে। জুবাইদা অবাক হয়, এবং খুশিও হয়। সে তো হাসির কোনো গল্প বলেনি। বানিয়ে বানিয়ে গল্প এই ঠ্যাটা ঘুঘুকে শুনিয়েছে শুধু। তাতেই ঘুঘুটা মজা পেয়ে হেসে উঠেছে। তার মানে এখন তাকে ফুল দেবে।
হাসি থামিয়ে ঘুঘু বলল, একদম ঠিক হয়েছে। উচিত হয়েছে। রাখালের শিক্ষা হয়েছে। আমাদের পাখিদের খাঁচায় বন্দি করে রাখে দুষ্টু মানুষগুলি।
বলতে বলতেই ঘুঘু পাখি ঠোঁট আর পায়ের নখ দিয়ে তিনটে শিমুল ফুল ছিঁড়ে নিচে ফেলল। ফুল তিনটে কুড়িয়ে নিয়ে জুবাইদা পাখিকে ধন্যবাদ দিয়ে চলে এলো। আসার সময় শুনতে পেল, ঘুঘু পাখিটি বলছে, ঘরে থাকো নিরাপদ থাকবে। এখন ঘর থেকে বাইরে ঘুরে বেড়ানোর সময় নয়। সৃষ্টিকর্তা তোমার মঙ্গল করুন।