সানজিদা আকতার আইরিন :
সদ্য অংকুরিত চারা গাছটির এখনো মাটির সাথে ভালোভাবে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। মাটির এঁদো গন্ধ তার সারা শরীর জুড়ে ছড়িয়ে আছে। খুব ভোরের নরম রোদে চোখ মেলে আড়মোড় দিতে দিতেই বাগানের মালি ছিটিয়ে দেয় প্রশান্তির স্বচ্ছ পানি। সারা শরীর যেনো চাঙ্গা হয়ে ওঠে। বাগানের পাশে শিশুদের খেলার মাঠ। তাদের চিৎকার, কোলাহল, ছোটাছুটি চারাগাছ টির মন কেড়ে নেয়। ইচ্ছে করে দৌড়ে গিয়ে শিশুদের সাথে খেলা করে। কিন্তু উপায় কী? গাছের শরীর শেকড় দিয়ে মাটির সাথে বাঁধা। তাছাড়া গাছের ভাষা কী মানুষ বোঝে। নবীন গাছটির খুব মন খারাপ হয়। তখন থেকেই সে মনে মনে ঐ শিশুদের সাথে বন্ধুত্ব করে নেয়। প্রতিদিন কল্পনায় সেও ওদের সাথে খেলতে থাকে। শিশুদের কোলাহল শুনতে শুনতে গাছটি বড় হতে থাকে। ওদের খেলার আওয়াজ পেলেই তার পাতা নাড়িয়ে ভাব করে কিন্তু শিশুরা তার কথা বোঝে না। সে প্রতীক্ষায় থাকে,একদিন ওরা ঠিক আসবে তার কাছে এই আশায়। সময়ের সাথে সাথে মাটিতে তার শেকড়গুলো বেশ একটু শক্ত পোক্ত জায়গা করে নেয়। অজস্র সতেজ পাতা মৃদু হাওয়ায় নাচে আর ডালগুলো দুলে দুলে গান গায়। সে গানের ভাষা ঠান্ডা বাতাস হয়ে ওই বন্ধুদের কাছে পৌঁছে যায়। মালির হাতের যতেœর ছোঁয়ায় ধীরে ধীরে ডাল ফুঁড়ে বের হয় অনেক ফুলের কুঁড়ি। গাছটি ডাল ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে বন্ধুদের ডেকে বলতে চায় দেখ বন্ধুরা আমার কত ফুলের কুঁড়ি। আমি অনেক ফুল ফোটাবো। আমি রঙিন হব। সেজে উঠবো নতুন সাজে। আমি এমন সুবাস ছড়িয়ে দেবো তোমরা আমার কাছে আসবেই। সত্যি এল সে দিনটি। গাছের সারা শরীর ভরে গেলো রঙিন ফুলে। মিষ্টি গন্ধে ভরে গেল চারপাশ। ডালে ডালে পাখির কুজন আর ফাগুন হাওয়ার দোলায় দুলে দুলে গাছটি ধন্য হতে থাকে। এবার আমার বন্ধুরা আমার কাছে ঠিক আসবে ভেবে গাছের আনন্দ আর ধরে না। বার বার পাতা নেড়ে নেড়ে বন্ধুদের কাছে ডাকে। কিন্তু গাছের কথা মানুষ বোঝে না তাই হাওয়ায় মিলিয়ে যায় তার আকুতি। দিন কয়েক পর বাগানের মালি অসুস্থ হয়ে পানি না দিতে পারায় পানি শূন্যতায় ভোগে গাছটি। প্রবল তৃষ্ণায় শরীর খারাপ করা গাছটি ঝিমিয়ে পড়ে। দু ফোঁটা পানির আবেদন কে শোনবে তার। সে দিন বিকালে খেলতে এসে মালি না থাকার সুবাদে হৈচৈ করে ঢুকে পড়ে শিশুরা বাগানে। দৃষ্টি নন্দিত ফুল আর মন মাতানো সুবাসে গাছটি আকৃষ্ট করে তাদের। অবসাদ শরীরেও আনন্দে ডাল ঝাকাতে চেষ্টা করে। শিশুরা এত কিছু না বুঝেই গাছের ফুল, পাতা ডাল টানাটানি করে। কেউবা আবার গাছের ডাল ধরে ঝোলাঝুলি শুরু করে। দু এক জন গাছটি ধরে এমন ঝাকাঝাকি করে যে গাছটি উপড়ে যাবার পালা। ক্ষুধায় তৃষ্ণায় নেতিয়ে পড়া গাছটির আর্তনাদ “আমায় মেরো না, আমায় মেরো না”। কিন্তু কেউ শুনলো না।”আমার খুব কষ্ট হয়” বলে কান্নার প্রলাপ কারো বোধগম্য ছিলো না। জন্ম থেকে যাদের বন্ধু মনে করেছে গাছটি তাদের এই নিষ্ঠুর আচরণ সইতে না পেরে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে। মনে মনে বলে গাছ তোমাদের কত উপকার করে। অক্সিজেন দেয়, ছায়া দেয়। ফুল,ফল, ফসল দিয়ে তোমাদের সাহায্য করে তাও কেনো তোমরা গাছকে এত কষ্ট দাও। গাছ তোমাদের বন্ধু হলেও তোমরা গাছের বন্ধু হতে পারো না কখনো।