সুপ্রভাত ডেস্ক »
গত বছরের ৫ আগস্ট দুপুরের আগেই শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়ে। শুরুতে এটিকে কেউ কেউ গুজব মনে করেন। কিন্তু দুপুরে টেলিভিশনের স্ক্রলে ভেসে ওঠে, জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন সেনাপ্রধান। তখন লোকজন মোটামুটি নিশ্চিত হয়, বড় কিছু ঘটে গেছে!
দুপুর আড়াইটার দিকে খবর আসে পদত্যাগ করেছেন শেখ হাসিনা। তিনি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পালিয়ে গেছেন। ততক্ষণে চট্টগ্রামের অলিগলি থেকে লোকজন বের হতে থাকেন। একপর্যায়ে নগরীর সড়কগুলো দখলে নেয় ছাত্র-জনতা।
সেদিন চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন এলাকায় দুপুরের পর জনতার স্লোগানে স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে পুরো শহর। মোড়ে মোড়ে চলে মিষ্টি বিতরণ। ফুল বিনিময় করেন অনেকে। বিজয় মিছিলে প্রিয়জনের সঙ্গে ছবি তুলে স্মৃতি সংরক্ষণ করেন কেউ কেউ। দীর্ঘদিন ধরে হাসিনার নিপীড়নের শিকার হওয়া লোকজনের কাছে ওইদিন ছিল ঈদের চেয়েও আনন্দের।
কিছু জায়গায় পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ থাকলেও বিকেলের পর চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানা ঘিরে ফেলে ছাত্র-জনতা। কোতোয়ালি, পতেঙ্গা, পাহাড়তলী, ডবলমুরিং ও লোহাগাড়াসহ বিভিন্ন থানায় আক্রমণ শুরু হয় বিক্ষুব্ধ জনতার। এসব থানায় ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। পুলিশের অস্ত্র ও গুলি নিয়ে যায় অনেকে। এসময় অনেক পুলিশ সদস্য কোনো রকমে থানা থেকে পালিয়ে যান। কেউ কেউ পোশাক পরিবর্তন করে জনতার সঙ্গে মিশে যান। এ ছাড়া চট্টগ্রামজুড়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাসায় হামলা ও কোনো কোনো বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষুব্ধ জনতা।
সেই দিনের স্মৃতিচারণ করে বেসরকারি একটি ব্যাংকে কর্মরত মো. সাইফ উদ্দিন বলেন, এক বছর আগের এই দিনে ১৫ বছরের স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটেছিল। মনে হয়েছিল আমরা দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা শ্বাস ফিরে পাচ্ছি। তবে আশা করছিলাম হাসিনা পালানোর পর এ দেশটা নতুনভাবে গড়ে উঠবে। কিন্তু বাস্তবে জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে থাকা পক্ষগুলোর মধ্যে বিভেদ তৈরি হয়েছে। সংস্কার প্রক্রিয়াও ভালোভাবে এগোয়নি। তারপরও আশায় আছি, জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী চেতনায় এ দেশ সামনে এগিয়ে যাবে।
চট্টগ্রামের চকবাজার এলাকার ব্যবসায়ী মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, সেদিন বিকেলে খবর শুনে আমার মনে হচ্ছিল, আমরা মুক্ত। কখনো আর ভয় পেতে হবে না। রাজনৈতিক কারণে আমার মতো অনেকেই স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেননি। সেদিন লোকজন রাস্তায় নেমেছিল, যেন সব বাঁধন খুলে গিয়েছিল।
ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম মহানগর উত্তর শাখার তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান সভাপতি তানজীর হোসেন জুয়েল বলেন, সেদিন আমরা ঘর থেকে বের হয়েছি শহীদ হওয়ার ইচ্ছে নিয়ে। সকাল থেকেই সবাইকে নিয়ে সড়কে অবস্থান নিই। কেউ উত্তর পাহাড়তলী, কেউ অলঙ্কার মোড়, কেউ কাজির দেউড়িতে আলাদা আলাদা দলে ভাগ হয়ে আমরা শহরের গুরুত্বপূর্ণ সব পয়েন্টে দাঁড়িয়ে ছিলাম। প্রতিটি মুহূর্তে প্রস্তুত ছিলাম চূড়ান্ত ঘোষণা পাওয়ার জন্য। দুপুর ১টার পর যখন খবর আসে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়েছে আমরা কারো মুখের দিকে তাকানোর সুযোগ পাইনি, সবাই চিৎকার করে কাঁদছিলাম।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, এক দফা দাবিতে সকাল থেকে আন্দোলনে ছিলাম। দুপুরে খবর পাই হাসিনা পালিয়েছে। কী আনন্দ, আশপাশের কেউ কেউ আনন্দে কান্না করেছেন। কেউ কেউ হাসিনার বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে যাচ্ছিলেন। সেদিন মুক্তিকামী জনতা চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষ রাজপথে নেমে পড়েছিল।
এ ঘটনাকে স্মরণ করে মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে আলোচনা সভা, স্মৃতিচারণ, মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে দিনব্যাপী আয়োজনের মধ্যে রয়েছে– শহীদদের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ, আন্দোলনে আহত ও শহীদ পরিবারের লোকজনকে ফুল দিয়ে বরণ, চলচ্চিত্র প্রদর্শন ও আলোচনা সভা। এ ছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নিজেদের মতো করে মিছিল ও সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি পালন করবে।