হুমাইরা তাজরিন
গামের্ন্টসকর্মী নাসরিন সুলতানা। তার কর্মস্থলে যাওয়ার নিত্যসঙ্গী নগরীর পাবলিক বাস। যাত্রাপথের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, প্রতিদিন গরম ইঞ্জিনে পা রেখে বসতে হয়। এতে মাথা ধরে যায়। এ রকম সিটে একবার পা রাখলে বের করে আনতে বেশ কষ্ট হয়। অনেক সময় সিটে বসলেও পা রাখা যায় না ভালো মতন। আর গ্যালারিতে বসলে ছেলেরা চিল্লাচিলি করে। হাটহাজারী সড়কের নতুন পাড়া এলাকায় কথা হয় নাসরিন সুলতানার সঙ্গে।
একই এলাকায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আফিয়া তাবাস্সুমের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, সংরক্ষিত আসনগুলো বসার উপযোগী কিনা সেটা কেউ তদারকির প্রয়োজন মনে করছে না। গ্যালারির সিট এগুলোর চেয়ে একটু ভালো হলেও সেখানে বসতে গেলে পাশের সিটের পুরুষযাত্রীটি কখনও ঘুমের ভান করে গা এলিয়ে দেয়। নয়তো পিছনের সিট থেকে পা দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে স্পর্শ করতে চায়। আবার সিটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষযাত্রী নানা ছুঁতোয় শরীরের ঝুঁকে কোণঠাসা করে ফেলে। প্রতিবাদ করলে বলে, এখানে বসলে এমন হবেই। বাধ্য হয়ে প্রতিদিন এসব হয়রানি সয়ে ভার্সিটি যাওয়া-আসা করতে হয় তাবাস্সুমকে।
নাসরিন ও তাবাস্সুমের মতো এ রকম আরো অনেক নারীযাত্রীকেই এ নগরীতে প্রতিদিন নানা অব্যক্ত যন্ত্রণা সহ্য করে পাবলিক বাসে গন্তব্যে পাড়ি দিতে হয়। এ অভিযোগ দীর্ঘদিনের। কিন্তু কোনো প্রতিকার মেলেনি কখনো।
চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন গণপরিবহন ঘুরে দেখা যায়, যাত্রীসংখ্যা বাড়াতে গরম ইঞ্জিনের ওপর ওয়েল্ডিং করে সংরক্ষিত আসন বানানো হয়েছে। যেখানে যুৎসই করে বসার উপায় থাকে না। ব্রেক কষলে ছিটকে পড়ার আশংকা থাকে সব সময়।
আবার কোনো বাসে এসব আসনে ট্রাকের টায়ার বিছানো থাকে। মাঝেসাঝে টায়ারের ওপর কাঠের তক্তাও ফেলে রাখা হয়। সিট না পেয়ে বাধ্য হয়ে কেউ কেউ সেখানেই বসতে বাধ্য হয়। সংরক্ষিত এসব আসনে মুখোমুখি বসলে পা রাখাটাই হয় বড় দায়। অন্যদিকে বেশিভাগ গণপরিবহনের ফিটনেস নেই। এর ফলে ঝুঁকি নিয়েই নারীকে তার জন্য সেই নির্ধারিত আসনে বসতে হয় বাধ্য হয়ে।
সরকারি নীতিমালা অনুসারে নারীদের জন্য সংরক্ষিতভাবে ৯টি আসন বরাদ্দের কথা থাকলেও বেশিভাগ পরিবহনে থাকে ৫ থেকে ৭টি। সেই আসনগুলোও কখনও-কখনও পুরুষযাত্রীর দখলে চলে যায়। ফলে নারীদের সিট পেতে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। সংরক্ষিত আসনের বেশিরভাগ আসনই বসার অযোগ্য। তার চেয়েও অস্বস্তিকর ব্যাপার হলো, ঠাসাঠাসি করে বসানো এসব সিট থেকে বের হতে গেলে ঘটে বিপত্তি। অন্য যাত্রীদের পা মাড়িয়ে জায়গাটি অতিক্রম করতে হয় বলে কখনও-কখনও বিরূপ মন্তব্য হজম করতে হয়। এতসব অসুবিধার পরও এসব আসনে বসে নারীদের পুরোটা পথ অতিক্রম করতে হয় একপাশ হয়ে। মিনিবাসগুলোর ৪ জনের সিটে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকলেও মহিলাযাত্রীদের ড্রাইভার-হেলপারের চাপে গাদাগাদি করে বসতে হয়। পুরুষদের সাথে দাঁড়িয়ে গেলে অনাকাক্সিক্ষত স্পর্শের শিকার হতে হয়। আসন সংকটের পাশাপাশি এটিও নারীর ওপর এক ধরনের মানসিক নির্যাতন।
এছাড়া এসব সংরক্ষিত আসনে না বসে কোনো নারী গ্যালারিতে বসতে গেলে প্রায়ই পুরুষযাত্রীদের আপত্তির মুখে পড়তে হয়। গ্যালারি সিটে বসা নারীদের পাশে দাঁড়িয়ে যাওয়া পুরুষযাত্রীরা প্রায়ই নারীকে পর্যাপ্ত সম্মানজনক জায়গা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। বরং ইচ্ছাকৃতভাবেই শারীরিক দূরত্ব কমিয়ে গাদাগাদি করে অবস্থান নেয়। আর এ ধরনের পরিস্থিতিতেই ঘটে অধিকাংশ যৌনহয়রানির ঘটনা। হয়রানির মাত্রা বেড়ে যায় যখন ভুক্তভোগীটি শিশু কিংবা কিশোর-কিশোরী হয়। নিপীড়কদের নিত্যনতুন কৌশল সম্পর্কে অবগত না থাকার কারণে তাদের জন্যে এই ধরনের হয়রানি পরিণত হয় চাইল্ডহুড ট্রমায়। কেউ কেউ লোকলজ্জার ভয়ে সেই আতংকের কথাও জানাতে চায় না কাউকে।
নাহিদা বেগম নামের একজন অভিভাবক বলেন, আমার মেয়ে ক্লাস ফোরে পড়ে। থ্রি পর্যন্ত আমিই আনা-নেওয়া করতাম। পড়ে কেবল গাড়িতে তুলে দিতাম ও নিজে-নিজে যেতে পারতো। কিন্তু কিছুদিন যাবত দেখি, ও কিছুতেই বাসে যাবে না। জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলে না। পরে একদিন জোরাজুরি করাতে জানালো, বাসে এক লোক তাকে বাজেভাবে স্পর্শ করেছে। এখন তার বাসে যাতায়াত করতেই ভয় করে। ডাক্তারের সাথে পরার্মশ করলাম। উনি বললেন, এটা ওর একটা ট্রমাতে পরিণত হয়েছে।
ইউনিসেফ এর চাইল্ড প্রটেকশন স্পেশালিস্ট মনিরা হাসান বলেন, এ ধরনের ঘটনা অহরহই ঘটছে। এসব আচরণ শিশু-কিশোর-কিশোরীদের জন্য ট্রমায় পরিণত হয়। ভুক্তভোগীদের মধ্যে মেয়েশিশুর সংখ্যা বেশি হলেও ছেলেশিশুও এ ধরনের অশোভন আচরণের শিকার হয়। এর ফলে বেশিভাগ শিশু-কিশোর স্কুল থেকে ড্রপআউট হয়ে যায়। ঘর ছেড়ে বের হতে চায় না। কোণঠাসা হয়ে পড়ে। তাই আমরা শিশু-কিশোরীদের বলে থাকি, যাতে তারা একা চলাচল না করে দলগতভাবে চলার র্চচা করে। দলগতভাবে চলাচল করাটা বেশ ফ্রুটফুল হয়। যদি শিশু হয় তাহলে দলগতভাবে একেক সপ্তাহে একেকজন অভিভাবক তাদের আনা-নেয়া করবেন। হেলপারেরা বাসে ওঠানোর নামে গায়ে হাত দিলে তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করবে। কেউ গায়ে হাত দিলে উচ্চস্বরে বলতে হবে, ‘আমার গায়ে হাত দিলেন কেন? জানতে চাইবে। যদি অপরাধী হয় মুষড়ে যাবে।
ইমারজেন্সি হেলপের জন্য যদি তাদের কারো কাছে ফোন থাকে, ১০৯ কিংবা ৯৯৯ তে ফোন করা শেখাতে হবে।’
আমরা সারাদেশে ১ লাখ শিশুর আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছি। এর মধ্যে চট্টগ্রামে ১৫ হাজার শিশুকে এ প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। এছাড়া বাসমালিকসহ সংশ্লিষ্টদের সাথে বসে গণপরিবহনে চলাচলের শিষ্টাচার নির্ধারণ করে ড্রাইভার-হেলপারদের জন্যও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ভিডিও ক্লিপ, বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণের মাধ্যমে জনসচেতনতা তৈরি করা যেতে পারে।’
এ ব্যাপারে সমাজবিজ্ঞানী ড. এ এফ ইমাম আলী বলেন, ‘সবার আগে চিন্তা করতে হবে সবাই মানুষ। তারপরে শারীরিক ভিন্নতার কারণে কেউ পুরুষ, কেউ নারী। আবার সামাজিক নানা কারণে যেহেতু নারীরা অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত, তাদের উন্নয়নের জন্য নিরাপত্তসহ বিশেষ ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন। প্রথমত, সমাজে প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবটাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। নারী-পুরুষের সমান অধিকার, এটা সকলকে মানতে হবে। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। সংরক্ষিত আসনে গাদাগাদি করে বসানো, ইঞ্জিনের ওপর বসানো এসব আসলে অধিক মুনাফালাভের উদ্দেশ্যে করা হয়। এই সীমাহীন লোভ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যেহেতু নারীযাত্রীর সংখ্যা অতীতের তুলনায় বেড়েছে, তাই সংরক্ষিত আসন বাড়ানোর কথাও ভাবতে হবে। সে আসন অবশ্যই মানসম্মত হতে হবে। কোনো নারী গ্যালারি সিটে বসলে কোনো পুরুষ যেন সেখানে না দাঁড়ায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। বাসমালিকদেরও একত্র করে এসব ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপ নেবার ব্যবস্থা করতে হবে।’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান সুপ্রভাত বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিষয়টা বুঝতে পারলাম। আমি বিষয়টা আমাদের পরবর্তী মিটিংয়ে উত্থাপন করবো।’