জুয়েল আশরাফ :
খোশালকে পাড়ার সবাই পেটুক হিসেবে চেনে। শুধু মাথার ভেতর খাই-খাই চিন্তা। একটি খাবার শেষ না হতেই কী করে আরেকটি মুখে নেবে, এমন ভাবনায় ডুবে থাকবে সারাদিন।
সেদিন সকাল থেকেই খোশালের খুব চিকেন বার্গার খেতে ইচ্ছে করল। গ্রাম- শহর, মফস্বলে চলছে হরদম লকডাউন। হোটেল, রেস্তোরাঁ, ফাস্টফুড কোনোকিছু খোলা নেই। খোশালের মা বিরক্ত মুখে বলল, আজ বিশ্বস্বাস্থ্য দিবস। এত খাই-খাই করিস না বাপ। নিজের শরীরের দিকে নজর রাখ।
খোশাল নিজের একশ সাতাশ কেজি শরীরটার দিকে নজর না দিয়ে পেটের দিকে তাকাল। তার পেট খিদেয় চু চু করে যাচ্ছে। ছাদের ওপর তাদের ছাগলটা বেঁধে রাখা ছিল। গত মাসে তার বাবা তাকে একটি ছাগল কিনে দিয়েছে। তার বাবার ধারণা, ছাগল পালনকারীর শরীর ফুলে-ফেঁপে ওঠা থেকে নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এ জন্য খোশালকে প্রতিদিন দুই ঘণ্টা ছাগল চরে বেড়ানো লাগে মাঠে।
খোশাল ছাদে ওঠে এল। এখন ছাগল নিয়ে মাঠে চরে বেড়ানোর উপায় নেই। ছাগলের জন্যেও হোম কোয়ারেন্টাইন। ছাগলকে কিছু ঘাস খাইয়ে দিল। এরপর ছাগলকে ঘাস খাওয়ানোর ছবি মোবাইল ক্যামেরায় বন্দি করে মাকে দেখিয়ে বলল, এই দেখো মা ছাগলটাকে কেমন ঘাস খাওয়াচ্ছিলাম।
মা বলল, এ আবার নতুন কি? আমি তো রোজই ছাগলকে ভাত খাওয়াই। কেউ ছবি তুলে রাখে না, তাই দেখাতে পারি না।
অধিক ভোজনবিলাসিতার কারণে মা তাকে ছাগলের সঙ্গে তুলনা করছে, পেটুক খোশাল সেটা অনুভব করতে পারল না।
খোশালের বার্গার খাবার ইচ্ছে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এসব খাওয়া তার একধরনের ইচ্ছা। খাওয়ার ইচ্ছা তীব্র হলে কী হবে সে তো আর বাইরে যেতে পারবে না। কারণ সে গৃহবন্দি, মানে হোম কোয়ারেন্টাইনে আছে। আবার লকডাউন শহরে ফাস্টফুড শপগুলো খোলা আছে কি না কে জানে? অনেক সাহস সঞ্চয় করে মাকে বলল, আব্বাকে বলো দুটো চিকেন বার্গার নিয়ে আসতে।
মা ভাবলেশহীন হয়ে বলল, তোর আব্বা আনতে পারবে, তবে তা সেভলন দিয়ে ধুয়ে ভেতরে প্রবেশ করাতে হবে।
বার্গার খাবার ইচ্ছা যত উঁচুতে উঠেছিল তার থেকে দ্বিগুন নিচে নেমে গেল। বেসিনের কল ছেড়ে কুলি করে নিল বেশ কয়েকবার। গড় গড় গড়।
খোশালের চিন্তাভাবনা এলোমেলো লাগছে। বার্গার খেতে না পারলে তার চিন্তা-ভাবনা এলোমেলো লাগে। সে অগোছালো ভাবনায় ডুবে যায়- আজকাল সবাই করোনার ভয়ে ভীত। বাজারে মাস্কের চাহিদা অনেক। মাস্ক বিক্রেতারা লাভের টাকা দিয়ে অনেকগুলো চিকেন বার্গার খাবে নিশ্চয়ই। ছোটবেলায় সে কালো পিঁপড়াকে মুক্তিবাহিনী-পিঁপড়া ভাবতো, আর লাল পিঁপড়াকে মিলিটারি। পোকায় খাওয়া ফল খেলে সাঁতার শেখা যাবে- বড়দের মুখে শুনেছে। খোশাল পোকায় খাওয়া ফল জীবনে অনেক খেয়েছে, সে কোনোদিনই সাঁতরাতে পারেনি। সাঁতরাতে গেলেই পানির নিচে তলিয়ে যায়। ইঁদুরের গর্তে দাঁত রেখে দিলে ইঁদুর সুন্দর দাঁত ফিরিয়ে দেয়। খোশাল পড়ে যাওয়া দাঁতও ইঁদুরের গর্তে রেখেছে। কিন্তু তার দাঁত কোনোদিন ইঁদুরের দাঁতের মতো হয়েছে কি না জানে না সে। কারণ, খোশাল কোনোদিন ইঁদুরের দাঁতই দেখেনি।
এমন ভাবনা ভাবতে ভাবতেই খোশাল পড়ল ঘুমিয়ে। কিছুক্ষণ পরেই আব্বা জাগিয়ে তুলল। খোশাল অবাক, আব্বা বাইরে যাওয়ার পোশাক পরেছে। সে আরও অবাক হলো যখন আব্বা বলল, ওঠ, জলদি রেডি হয়ে নে। আজ ঈদের দিন। যা খেতে মন চায় খাবি, কোনো বাধা নেই। চল তোকে বাইরে নিয়ে গিয়ে কিছু খাওয়াব। আব্বার বলতে দেরি, খোশালের রেডি হতে দেরি নেই। তাকে সঙ্গে নিয়ে আব্বা বাইরে এলো। একটি ফাস্টফুডের দোকানে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, যত পারিস খা বাপ। বিল নিয়ে চিন্তা করিস না।
এক আলিশান ফাস্টফুডের দোকানে ঢুকল খোশাল। দোকানের মালিক তাল গাছের মতোন লম্বা দেখতে। দোকানের কাস্টমার-কর্মচারী সবাই লম্বা মানুষ। তাদের হাঁটুর নিচে পড়ে যায় সে। খোশাল এগিয়ে গেল একটি টেবিলের কাছে। চেয়ার দেখেই সে হতভম্ব! এত বড় চেয়ার জীবনে দেখেনি। চেয়ারে উঠতে হলো মই বেয়ে। এরপর আরাম করে বসে দেখে, আরও দশজন বসার মতো খালি জায়গা পড়ে রয়েছে চেয়ারে। অর্ডার নেওয়ার জন্য তালগাছ সমান লম্বা একজন লোক এসে দাঁড়াল। খোশাল অর্ডার করল চিকেন বার্গার। পাঁচ মিনিট পর বিশাল একটি খাঞ্চা এলো তার সামনে, টেবিলে। এত বড় বার্গার আর চিকেনের সাইজ দেখে খোশালের চোখ চরকির মতোন ঘুরছে। চিকেনের এক টুকরো পায়ের মাংস যদি হয় ছাগল সমান, তাহলে আস্ত চিকেনটা কত বড় হবে! খোশাল মনে করল হয়তো ঈদের কারণেই এতো বড় আয়োজন। এ রকমটা ভেবেই বার্গারে দিল সে কামড়, ঠিক এমনই সময়েই মা এসে পেছন থেকে জোরে ধাক্কা মেরে বলল, এই, ওঠ রে, ছাদের ওপর ছাগলটা ম্যা ম্যা করে যাচ্ছে। কিছু ঘাস পানি দিয়ে আয়।
খোশালের মুখের ভেতরটা কেমন নোনতা নোনতা লাগছে। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে, পুরানো কাঁথা চিবাচ্ছে। মায়ের ওপর সে খুবই বিরক্ত বোধ করল। তাকে যদি এখনই ঘুম থেকে না জাগাত তাহলে সে বার্গারটা খেয়ে শেষ করতে পারতো। ঈদের দিনেও শান্তি মতো খেতে দিল না!