সরওয়ার কামাল :
বাংলা সাহিত্যের যে কিনারের কিনারে (Margin of the margin) উপকূলীয় সংস্কৃতির রেখাপাত ঘটেছে তার বিস্তৃতি সংকীর্ণ। তাতে কবিতানির্ভর নান্দনিকতার চর্চা, মূর্ত কিংবা বিমূর্ত উভয় দিক থেকেই ক্ষীণ। তাই উপকূললগ্ন কবির সংখ্যাও নগণ্য। মধ্যযুগের কথাসাহিত্যে যে-উপকূলীয় উপাখ্যান চোখে পড়ে তাতে স্থান-কালের, বিশেষ করে উপকূলীয় জীবন ও সংগ্রাম, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি, চিন্তা ও চেতনার প্রতিফলন ঘটেনি। কিছু কাল্পনিক উপাখ্যান, বীরত্বগাথা এবং শোকগাথা নিয়েই মধ্যযুগীয় সাহিত্যের নির্মিতি। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগীয় কালপর্বে দৃষ্টিপাত করলে মিছে মরীচিকার মতো বাংলার কাদা-মাটি-জলে আরব মরুভূমির অধরা অবভাস ভেসে ওঠে, যেন-বা বর্ষামুখর জলমগ্ন বাংলায় লু হাওয়ার দহন আরোপ করার কোশেশ, যা এই নাতিউষ্ণ জীবনে মিছে তাপ সঞ্চারণের নির্বিচার প্রয়াসেরই নামান্তর। তবে সমাজমানসে আরোপিত এই অলীক চিত্রকল্পের প্রভাব স্থায়িত্ব পায়নি। এর অবশ্য সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক কারণ আছে। সব কারণের সাধারণ সামষ্টিক পরিণামগত কারণ হলো এই যে, সেই উপাখ্যানে সমকালের যুগসন্তাপ প্রতিফলিত হয়নি। কাল ও কালের বাস্তবতাকে বিমূর্ত কল্পনার আয়নায় দেখে অভ্যস্ত যুগপ্রতিনিধিরা সমকালকে মূর্তরূপে হাজির করতে পারেননি। নিজেদের অস্ফুট প্রান্তিক স্বরকে প্রাবল্য না যুগিয়ে বরং তারা নিজেরাই হিজরত করেছেন ঐতিহাসিক অতীতে। সে কারণেই উপকূলের কঠিন সংগ্রামী জীবনকাহিনি ঘোমটাপরা বোবা বালিকার গোপন অশ্রুর মতোই অলীক ধর্মীয় জজবার আড়ালে থেকে গেছে। কেউ স্থানকালহীন কল্পলোকে ভাবের সুউচ্চ মিনার গড়েছেন ধ্রুপদি রোমান্টিকতার আবহে। তাদের স্বপ্ন আছে, বেদনা আছে, আছে উপলব্ধিও, শুধু নেই তার সুনির্দিষ্ট দেশকাল। ব্রাত্য ও প্রাকৃতজনের শ্রুতিতে, গীতনির্ভর ভাবচর্চায় ব্রহ্মা-ের ভাব, হওয়া না হওয়া, অস্তি-নাস্তি, নানাশক্তির প্রতীক ও রূপক স্থান পেয়েছে ঢের। আরোপিত মহিমায় শোভিত হয়েছে বস্তুবাদী মানুষের অবিকশিত কল্পনার ফানুস। এইসব তৎপরতায় নেই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ও সবিচার ভাববাদনির্ভর নিরিখ। সে কারণেই তাতে মানবজীবন ও জীবনবিজড়িত নানাপ্রশ্নের মীমাংসা করুণভাবে অনুপস্থিত। তিরিশের দশকে পঞ্চপা-বেরা আধুনিক কবিতায় যে মান, গুণ ও শ্রী বাংলা সাহিত্যে যুক্ত করেছেন, তা পরবর্তীকালে বিভ্রান্তিজনক অবনতিতে পর্যবসিত হয়েছে। বাঁকবদলজনিত রূপান্তর ও কালান্তরে কবিতায় নান্দনিকতার, উৎকর্ষতার, শিল্পমানসের, দর্শনের এবং সর্বোপরি জীবনবোধ ও উপলব্ধির উন্মেষ এবং বিপর্যয় এক অসমচক্রে আবর্তিত হয়েছে। ফলত, ভারতভাগের পরেও সৃজনশীল ও কল্পনাশ্রয়ী সাহিত্যচর্চায় মধ্যযুগীয় আবহের এবং কল্পচিত্রের পৌনঃপুনিক আবির্ভাব ঘটেছে। তবে মাত্রাগতভাবে এই পর্যায়ে কিছু যুক্তিযুক্ততা বা সবিচার স্বাগতমন্যতা লক্ষ করা যায়।
আধুনিক পুনর্জাগরণের প্রভাবে বাংলা সাহিত্যের যে উৎকর্ষতর বিনির্মাণ সাধিত হয়েছে, ইতিহাসের নিরিখে তারও আছে নানা ইতি-নেতি। চব্বিশ বছরের পাকিস্তানি ঘেরাটোপ এবং স্বাধীনতা-উত্তর বিপ্লব-প্রতিবিপ্লবের দেশকালে কবিতার বুননে ছিল না কোনো হৃদ্য প্রাক্সিস। এ রকম কালিক ও ঐতিহাসিক পটভূমিতে সমকালের কবিতার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে বিনির্মাণবাদী ঔপনিবেশিকোত্তর চেতনার, কেন্দ্রবিমুখ, প্রান্তিক প্রতিনিধিত্বের জোরালো স্বর ধরা পড়ে। নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, রাজনীতি, পরিবেশ, জীবনকৌশল ও সংস্কৃতির মাঝে সচেতনভাবে হাজির থেকে এথনোগ্রাফিক অন্বেষণের প্যারাডাইমে কবিও নির্মাণ করে চলেন শ্রেয়তর সামাজিক জ্ঞান। তেমনি নৃপাঠনির্ভর জ্ঞানকুশলে আবিষ্কৃত জলমগ্ন ধীবরের উপকূলীয় চিত্র বিম্বিত হয়েছে যার কবিতায়, তাঁর নাম খালেদ মাহবুব মোর্শেদ।
মানবিক সমাজের রূপকল্পের ফেরিওয়ালা স্বাপ্নিক বিপ্লবীরা যখন সুবিধাবাদের পোষ মানে, পুঁজিবাদের পুঁজ গিলে উৎকট উল্লাসে মেতেছে যখন ফেরারি প্রেমিকেরা, তখন সংবেদনশীল ভাষাশিল্পীর নীরব দহনদ্রোহ কবিতাকারে চারিত হয়। নকল নায়কদের দর্পে সমাজ যখন অন্ধকারের দিকে ধাবমান, অজস্র গণমাধ্যমে যখন মূর্খনটের কসরতকে শিল্প হিসেবে জায়েজ করানোর পাঁয়তারা চলে, তখন আমাদের সামাজিক জ্ঞানতত্ত্বও মূর্খতার আবর্তে ঘুরপাক খেতে থাকে। ফলে ধীমান শিল্পপ্রকরণ হিসেবে বুদ্ধিদীপ্ত কবিতার, ক্রান্তদর্শিতার অভাব দিনে দিনে বাড়ছে। সেই অভাবজনিত শূন্যতাপূরণের একটি দায় থেকেই যেন মোর্শেদের কবিতাগুলো লিখিত হয়েছে। সমকালীন ভাবাদর্শের, শিল্পচৈতন্যের এবং ধীমান দ্রোহের প্রান্তিক স্বর অত্যন্ত পরিমিতভাবে উচ্চারিত হয়েছে তাঁর কবিতায়। প্রচলিত বিচার পদ্ধতির নিরিখে মোর্শেদের কবিতা মূল্যায়নের পূর্বে বলে রাখি, কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নির্বাণে বিনীত কাঁটা’’ প্রকাশিত হয় ২০০০ সালে। দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘আয়নাজোড়া অন্ধকার’ প্রকাশিত হয় ২০০৩ সালে, ‘সম্পন্ন সাম্পান’ ২০১২ সালে এবং সর্বশেষ ‘মহাপ্লাবনের পলি’ প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালে। কালিক পর্বান্তরের সাথে সাথে তাঁর কবিতারও উৎকর্ষতর স্বরান্তর ঘটেছে। তাই তাঁর কাব্য ‘সম্পন্ন সাম্পান’ শুধু সম্পন্ন জীবনচেতনার উৎসারণ নয়, সম্পন্ন কাব্যবোধের ঘোষণাও। এই ঘোষণায় অতিশায়ন নেই। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম যুগের উপভোগ্য কাব্য অন্বেষায় প্রবৃত্ত হলে, নন্দনবোধ, দর্শন, বাহাস, জ্ঞানভাষ্য, হৃদয়প্লাবী বৌদ্ধিক আবেগ, সর্বজনের প্রতি রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার নিরিখে ‘সম্পন্ন সাম্পান’কে বাংলা ভাষার মানোত্তীর্ণ যুগকাব্য বলার পর্যাপ্ত কারণ রয়েছে। পুঁজিবাদ ও পণ্যায়নের ব্যষ্টিক পাঠ থেকে উৎসারিত সামষ্টিক বোধ নিরবচ্ছিন্ন ও নিরাপোষরূপে হাজির আছে মোর্শেদের কবিতায়।
ছান্দসিক সাগরের নোনতা প্রহরে জ্যোৎস্নাস্নান সেরে, পুরাণ, ইতিহাস ও উপকূলীয় নৃতত্ত্বের সরোবরে অবগাহন করা সম্পন্ন কবি মোর্শেদ। উপকূলীয় মাটিগন্ধি জীবনের অনুপাঠ, শ্রম পরিশীলনের লবণাক্ত ঘ্রাণ, উজানের রাজনীতি যেন একাকার হয়ে আছে তাঁর কবিতায়। সুন্দরী গাছের মতোই তাঁর কবিতার বেশুমার শ্বাসমূল প্রথিত রয়েছে লবণাক্ত প্লাবনভূমিতে। এই লবণাক্ত জীবনের শতমূলী বোধের ভিত রচিত হয়েছে উপকূলের পরিবেশ, জীবনধারা, প্রান্তিক বঞ্চনা, ভুল উন্নয়নের অভিশাপ এবং প্রেম-দ্রোহ-সংগ্রামের সামষ্টিক অনুধাবন দ্বারা। আধুনিক কবিতাকলায় দীক্ষিত কবির বাক্যবুনন, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, শব্দসজ্জা, ভাবের গতিময় প্রবাহ, মিথের ব্যবহার, দার্শনিকবোধ এবং সর্বোপরি সামাজিক প্রপঞ্চের বিচারমূলক উপস্থাপন তাঁর সচেতন অবস্থান নির্দেশ করে। (চলবে)