খালিদ আহসান : কবিই শুধু নিজের জোরে মাতাল

কামরুল হাসান বাদল »

স্বপ্নে কবিতা পাওয়ার বিষয়টি অনেকে বিশ্বাস করেন। মধ্যযুগের ‘মঙ্গলকাব্যে’ তার প্রমাণ আছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও স্বপ্নে পাওয়া নিয়ে লিখেছেন, ‘কোন এক মন্দিরের সিঁড়ির উপর বলির রক্তচিহ্ন দেখিয়া একটি বালিকা অত্যন্ত করুণ ব্যাকুলতার সঙ্গে তাহার বাপকে জিজ্ঞাসা করিতেছে, ‘বাবা একী! এ-যে রক্ত।’ বালিকার এই কাতরতায় তাহার বাপ অন্তরে ব্যথিত হইয়া অথচ রাগের ভান করিয়া কোন-মতে তার প্রশ্নটিকে চাপা দিতে চেষ্টা করিতেছে।” জাগিয়া উঠিয়াই মনে হইল এটি আমার স্বপ্নলব্ধ গল্প।’ জীবনস্মৃতি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রাজনারায়ণ বসুর সঙ্গে দেখা করে দেওঘর হতে কলকাতা ফিরছিলেন কবিগুরু। গাড়িতে ছিল ভিড়, আর কম্পার্টমেন্টে আলো জ্বলছিল। ফলে ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছিল তাঁর। সে সময় ‘বালক’ পত্রিকার জন্য গল্প নিয়ে ভাবছিলেন। ভাবতে ভাবতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন তিনি। তখন স্বপ্ন দেখেন যার বর্ণনা পূর্বে দেওয়া হয়েছে।

স্বপ্ন থেকে উপাদান নিয়ে কবি ইয়েটসও বেশকিছু কবিতা লিখেছিলেন। ইয়েটসের একটি কবিতার নাম, Crazy Jone Grown old Looks at the Dancers.  এই কবিতা প্রাপ্তি নিয়ে তিনি তাঁর বান্ধবী অলিভিয়া শেক্সপিয়ারকে লিখেছিলেন- ‘Last night I saw in a dream Strange ragged excited Peaple Surging in a Crowd. The Most visible. Were a man and a woman who were I think dancing. এরকম তাঁর আরেকটি কবিতার নাম His Dream.

জার্মান কবি রিলকের জীবনে এমন একটি অদ্ভুত ঘটনা আছে। তখন তিনি সুইজারল্যান্ডের বার্গ দুর্গে বসবাস করছিলেন। একদিন সন্ধ্যায় লেখার টেবিলে বসে আছেন তিনি। হঠাৎ তাঁর মনে হলো কে যেন অর্ধালোকিত ঘরের ছায়ায় ফায়ারপ্লেসের সামনে চেয়ারে বসে আছে। সে আগন্তুকের পরনে অষ্টাদশ শতকের পোশাক। গালে হাত দিয়ে আগুনের দিকে দৃষ্টিপাত করে সে আগন্তুক একের পর এক কবিতা রিলকে শুনিয়ে যাচ্ছেন। রিলকে লিখে নিচ্ছেন সে কবিতা। পরে রিলকে সে অশরীরি ব্যক্তির নাম দিয়েছিলেন, Count C W. এই কবিতাগুচ্ছের নাম দিয়েছিলেন, From the Remains of Count C.W.

উইলিয়াম মরিসের খুব ইচ্ছে ছিল স্বপ্নে একটি কবিতা পাওয়ার। তিনি তা পেয়েও ছিলেন। তবে জাগরণের পর মনে ছিল শুধু একটি পংক্তি, ‘The Moonlights slept on a Treacle sea.’

এই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক হারুকি মুরাকামি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘একটা উপন্যাস লেখা আমার জন্য অনেকটা স্বপ্নের মতো। উপন্যাস লেখা আমার জন্য জাগ্রত অবস্থায় স্বপ্ন দেখার মতো, কিন্ত সেট উদ্দেশ্যপূর্ণ। আমি আজকের স্বপ্নটা কালঅব্দি দেখতে পারি- কিছু ব্যাপার আপনি স্বাভাবিকভাবেই চালিয়ে যেতে পারবেন না। এটা আমার চেতনার গভীরে সাজিয়ে নেবার নিজেস্ব উপায়। তাই আমি যখন এটা স্বপ্নপ্রসূত হিসেবে দেখি- একে কল্পনা বলে মনে হয় না। আমার জন্য এ স্বপ্ন বেশ সত্য।’

কবি খালিদ আহসানের ‘কলম লিখেছে কবিতা আমি তার প্রথম শ্রোতা’ কাব্য পড়তে গিয়ে বারবারই পূর্বোক্ত কথাগুলো স্মরণে এসেছে। স্মরণে আসার মানে কী? আমার কি মনে হয়েছে এই গ্রন্থের কবিতাগুলোও খালিদের স্বপ্নে প্রাপ্ত?খালিদ আহসানও কি এমন ইঙ্গিত দেননি? ‘কলম লিখেছে কবিতা বলার’ মধ্যে তিনিও কি আমাদের এমন ইঙ্গিত দিলেন যে, তিনি নন এক অলৌকিক শক্তি তার কলম দিয়ে কবিতাগুলো লিখিয়ে নিয়েছেন?

এ বইয়ের প্রথম কবিতার কয়েকটি পংক্তি :

‘তোমাকে আজ আমি আত্মা প্রসঙ্গে বলবো। আত্মা-আত্মপ্রকৃতি যা মহান সৃষ্টির অনু অংশ। যার কার্যশক্তি ভয়াবহ- তারপর সে বিশ্রাম চায়-ভ্রমণে যেতে চায় ও নিজ প্রকোষ্ঠে ফিরে আসে।’

এই কাব্যের ভূমিকায় খালিদ আহসান নিজেই লিখেছেন, ‘তখন সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা-ধ্যানবাজারেই আবর্তিত। (তিনি তাঁদের দেওয়ানবাজারের বাড়িটিকে ধ্যানবাজার বলতেন) দুপুরে আঁকতে বসি। সন্ধ্যায় লিখতে। বহু অস্থির সময় চলছে, গ্রাফিতির তখন লাভলেইনে অফিস। লাভলেইন, ধ্যানবাজার, বাসা এই তিনে ভ্রমণ ও গুটিয়ে নেয়া যাবতীয় ব্যস্ততা। এক দুপুরে আঁকতে বসে দেখি কলম লিখতে শুরু করেছে, প্রতিদিন ৬/৭টি স্লিপ। ৩/৪ দিনে ৩৬টি লিখে কলমটি ভেঙে ফেলেছিলাম।’

আমরা যারা কবি খালিদ আহসানকে চিনতাম, তাঁকে কাছ থেকে দেখতাম, তারা জানতাম খালিদ ছিলেন এক ঘোরগ্রস্ত মানুষ। যে ঘোর কাটিয়ে উঠতেন তিনি কবিতার মাধ্যমে। জীবনানন্দ লিখেছিলেন, ‘সবাই কবি নয় কেউ কেউ কবি।’ তেমনি করে বলতে হয় ‘কবি হলেও কবির জীবনযাপন  সবাই করতে পারেন না, কেউ কেউ পারেন।’ খালিদ ছিলেন সেই কেউ কেউদের মধ্যে একজন, যিনি একজন কবির জীবনই যাপন করে গেছেন।

আসলে কবিতা তো হচ্ছে, ঘোরলাগা জীবনের এক বিস্ময়কর সময়ের প্রকাশ। কবিতার ঘোরে না থাকলে কেউ উৎকৃষ্ট কবিতা লিখতে পারেন না।

খালিদের বিশ্বাস ছিল অলৌকিকত্বে। তিনি বিশ্বাস করতেন আত্মা আছে। সে সঙ্গে বিশ্বাস করতেন অশরীরি কোনো কিছুকে। সেটি তিনি আলাপচারিতায় প্রকাশও করতেন। প্রথম কবিতাতেই তিনি আরও লিখেছেন, ‘আত্মার ভ্রমণের জন্যে অন্ধকারই শ্রেয়। মধ্যরাত বা সুবহে সাদিক অধিক পবিত্র সময়। চেতনা পাখিরা তখন অনেকেই ঘুমিয়ে থাকে। তখন সময় কেবলই দু’জন কথা বলবার, শুনবার অথবা ফিস ফিস করতে করতে থেমে গিয়ে যখন তৈরি হয় একটি মোলায়েম গীতিময়তা-ঈশ্বরের অনুষঙ্গে সেই গীতি কবিতার বেশ পরদিন বা তারও পরদিন-অনেক সময় অব্দি সজাগ করতে পারে।’

আমরা কি ধরে নিতে পারি যে, খালিদের লেখা এই কবিতাগুলোও স্বপ্ন, ঘোর বা তার অবচেতনে তৈরি হওয়া? ১৭ নম্বর কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘আমি মুখাগ্নি করেছি প্রাচীন ভব্যতাকে। ভালোবেসে অবতরণের অনুমতি চায় কোমল নিন্মোষ্ঠে।

১৯ নম্বর কবিতায় তিনি লিখছেন, ‘কি লাভ, কেটে গেলে ঘোর। রাত হলে ভোর। শুরু হবে কর্মব্যস্ত যাপনটাই।’ বোঝা যায় ঘোরটুকু কাটাতে চান না ঘোরগ্রস্ত কবি।

স্বপ্নে পাওয়া কবিতার কথা বলেছিলাম। আসলে স্বপ্ন কী? আমাদের অবচেতন মনে যা আছে যা প্রকাশিত হয়নি এমনকি যার হাদিস সচেতন মনও জানে না। যেটা আসলে সাবকনসাসের রূপ। স্বপ্নদ্রষ্টা আসলে অবচেতন মনে নিজেই স্বপ্নটা রচনা করেন। সচেতন অবস্থায় তিনি যা অনুধাবন করতে পারেন না। তাহলে কি ব্যাখ্যাটা এমন দাঁড়াচ্ছে যে, স্বপ্নে পাওয়া কবিতা কিংবা কোনো প্লট আসলে স্বপ্নদ্রষ্টারই পরোক্ষ সৃষ্টি? এ বিষয়ে কাটখোট্টা কথা বলেছেন টি.এইচ ইলিয়ট। তিনি বলেছেন, ড্রিম পোয়েট্রির বৈশিষ্ট হলো সে যতটা বলে বলে মনে হয়, প্রকৃতার্থে ততটা বলে না। অধিকাংশ সমালোচক বলেন, ইয়েটস স্বপ্নের উপাদান নিয়ে যে সব কবিতা লিখেছিলেন, সেগুলোর কোনোটাই উল্লেখযোগ্য নয়। তাঁর সেরা কবিতাগুলোর কোনোটাই স্বপ্নে প্রাপ্ত নয়।

কবি খালিদ আহসান বলেছেন বটে, ‘কলম লিখেছে কবিতা, আমি তার প্রথম শ্রোতা।’ কিন্তু তিনি যে কলমকেই অনুশাসন করতে চান। তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চান। ২২ নম্বর কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘কলম তুমি কি সত্যিই ভালোবাসা শব্দটির কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলে? তাহলে তোমাকে আগামী প্রার্থনার সময় আমি কানে কানে কিছু উচ্চারণ শোনাবো। নিজের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার মতোই।’

কবিতার সমালোচকরা বলেন, প্রেরণা যেভাবেই আসুক স্বপ্নে বা জাগরণে বা মাতাল কৃপায় কবিতা উচ্চ মানের হবে না নিম্ন মানের হবে তা নির্ভর করে কবির সচেতন থাকার ওপর।

তাই এই কাব্যের প্রতিটা কবিতা পড়নে আমাদের স্থির হতে সমস্যা হয় না যে, খালিদ আহসান প্রকৃত অর্থে সরস কবি। উচ্চ মানের কবি।

একটি  সময়ে এসে খালিদ আহসান সিকদার আমিনুল হকের কবিতার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পর্কও ছিল আন্তরিক। সিকদার আমিনুল হকের কয়েকটি কাব্যের প্রচ্ছদও করেছিলেন তিনি। সিকদার আমিনুল হক তাঁর সমসাময়িক কালে অন্য কবিদের চেয়ে স্বতন্ত্র ছিলেন। তাঁর কাব্যভাষায় ছিল ফরাসি কবিতার ছাপ। তিনি গদ্য কবিতাই লিখতেন। কিছুটা বিমূর্ত্ত। আলোচ্য বইয়ের  সবকটি কবিতাই গদ্য কবিতা। হয়ত তিনি সিকদার আমিনুল হক থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তবে এ কথা বলে রাখা দরকার গদ্য কবিতা শুধু সিকদার আমিনুল হক লিখতেন তা নয়। বাংলাদেশের প্রধান/অপ্রধান অনেক কবিই গদ্য কবিতা লিখেছেন।

৩৬ কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘আমি কে টের পাচ্ছি না। এই মুহূর্তে নিজের ভেতরে তুমিই বা কে- বলি একটি কথা এই মাতাল সময় নিয়ে কাল ভোরে এই বসনাগুলো হারিয়েও যেতে পারে।’ এই কবিতার শেষ পংক্তি, ‘প্রতিদিন আমরা যেখানে বিশ্বাস ভাঙছি অন্ধ বিশ্বাসে ডগমগ সে পুরোপুরি ইলুমিনেটেড বা দীপিত।’

ইচ্ছে করলেই কবিতা লেখা যায় না। প্রস্তুতি নিয়ে লিখতে বসে কবিতা লেখা যায় না। কবিতা আসে। এক অপার্থির জগৎ থেকে কবিতা আসে। তাই সে কবিতা পাওয়ার জন্য কাবিকে ঘোরে থাকতে হয়,  মাতাল হতে হয়।

আমার বক্তব্য স্পষ্ট করার জন্য শঙ্খ ঘোষের উদ্ধৃতি দিই-

‘মদ খেয়ে তো মাতাল হতো সবাই

কবিই শুধু নিজের ঘোরে মাতাল।’

 

খালিদ আহসানের দুটি অপ্রকাশিত কবিতা

 

যারা পথভ্রষ্ট, বিভ্রান্ত

দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে

সাম্য, শান্তি প্রগতি আর সম্প্রীতির কথা

সব ধর্মেই বলে

আজকাল ধর্মগুরুরা রাজনীতির সাথে

আঁতাত করে নিয়েছে

আর যে যার সিন্দুক ভরছে

ইচ্ছেমত

পরের টাকা পরের জমীন

কোথায় পাচার করিস

বিচার করার দায়িত্ব দুদকের

সাংঙ্কট কেবল লোকবলের।

 

কেউ কি দুঃখ টেনে বলেছিলো

আয় সম্ভাস করি

চোখ দুটো কপালে এবং বন্ধ

মাথাটা বুকে টেনে সব

ঘোচাতে চেয়েছে?

এই তো বৃষ্টিপাতের গল্প

ভেজা শরীর ভেজা জামা

ভেজা ভেজা গালগল্প

সব মুছে যাবে দেখিস

সময় হলে সব ঠিক মুছে যাবে

আকাশটা ফর্সা হবে, হাসবে।

এখন আমার ডুবসাঁতারে

আপত্তি নেই