সুপ্রভাত ডেস্ক »
চলমান অর্থ ও ডলার সংকটের মাঝে আমদানি সক্ষমতা কমে যাওয়ায় অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়িয়ে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যস্ত সময় পার করছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এজন্য বোরো মওসুমে উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি গমের উৎপাদন- একইসঙ্গে পেঁয়াজ, আলু, ডাল ও ভুট্টার উৎপাদন বাড়াতেও আবাদী জমির পরিমাণ বৃদ্ধি, বিনামূল্যে সার ও বীজ সরবরাহ কার্যক্রম বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে এতে যেন কৃষকের উৎপাদন ব্যয় না বাড়ে, সেজন্য সব ধরনের সারের দাম না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, আসন্ন বোরো মওসুমে ধান চাষের জমির লক্ষমাত্রা ১.৮৮ লাখ হেক্টর বাড়ানোর পাশাপাশি চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১৫ লাখ টন বাড়িয়ে ২.২৩ কোটি টন ধরা হয়েছে। একইভাবে, গম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৫৮,০০০ টন বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ১২.২৮ লাখ টন। খবর টিবিএস।
জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত কার্যক্রম ধীরগতিতে চললেও কৃষি মন্ত্রণালয় আসন্ন বোরো মৌসুমে ধানের উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে নীতি বাস্তবায়নের জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার বলেন, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবারের বোরো মওসুমে অধিক পরিমাণ জমিতে ধান চাষের মাধ্যমে চালের উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের মতো আগামীতেও যেন কোনো চাল আমদানি করতে না হয়, তা নিশ্চিত করতেই এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘ধানের পাশাপাশি গমের উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রাও নির্ধারণ করেছি আমরা। বেকারি ইন্ডাস্ট্রি বিকশিত হওয়ায় প্রতিবছর প্রায় ৭০ লাখ টন গমের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হচ্ছে ১২ লাখ টনের মতো। ধানের উৎপাদন ঠিক রেখে পর্যায়ক্রমে গমের উৎপাদন বাড়াতে পদক্ষেপ নিচ্ছি আমরা।’
তিনি আরও বলেন, প্রচলিত জাতের ধান চাষ করে একই পরিমাণ জমিতে উৎপাদন খুব বেশি বাড়ানোর সুযোগ নেই। এ কারণে নতুন হাইব্রিড ধান চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে।
‘দেশে বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে এ বছর ধান, গম, সরিষা, আলু ও পেঁয়াজের উৎপাদন গত বোরো ও রবি মওসুমের তুলনায় বেশি হবে। এরমধ্য দিয়ে আমদানি কমানো ও মূল্যস্ফীতি হ্রাস করা সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য,’ যোগ করেন তিনি।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, গত অর্থবছর উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের সরাসরি প্রণোদনা হিসেবে ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে সরকার। এ বছর এ খাতে বরাদ্দ ৬০০ কোটি টাকা রাখা হচ্ছে। কোনো ফসল ও শস্যের উৎপাদন বাড়াতে চাইলে সরকার এই টাকায় কৃষকদের বিনামূল্যে উন্নতজাতের বীজ ও সার সরবরাহ করবে।
কৃষকরা প্রচলিত বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ জাতের ধান চাষে উৎসাহী থাকে। কিন্তু এসব জাতের ধান একই জমিতে প্রায় এক দশকের বেশি সময় ধরে চাষাবাদ হওয়ায় ফলন বাড়ছে না। তাই উৎপাদন বাড়াতে বিআর-৯৭, বিআর-৯৮, বিআর-৯৯ ও বিআর-১০০ বা বঙ্গবন্ধু ধান-১০০ চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করা হবে। এসব জাতের ফলন তুলনামুলকভাবে অনেক বেশি।
ভুট্টা, পেঁয়াজ, আলু উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা
ধান ও গমের পাশাপাশি ভুট্টার উৎপাদনও বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। গত বছরের চেয়ে ৩ লাখ টন বেশি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে প্রায় ৬৭ লাখ টন ভুট্টা উৎপাদন করতে চায় মন্ত্রণালয়।
গত কয়েক বছর ধরে পেঁয়াজের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় এ বছর পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। একইভাবে এবার আলুর দাম অনেক বেশি বেড়ে যাওয়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যের উৎপাদনও বাড়াতে চায় মন্ত্রণালয়।
রবি মওসুমে আলুর উৎপাদন ৮ লাখ টন বাড়িয়ে ১.১৬ কোটি টন এবং অতিরিক্ত প্রায় ৩ লাখ টন পেঁয়াজের উৎপাদন করার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। গত বছর দেশে ৩৪.৫৬ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছিল।
একইভাবে রসুন, মরিচ, ধনিয়া, আদা, হলুদ, কালোজিরার মতো মসলা জাতীয় ফসল উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রাও স্থির করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার জানান, প্রতিবছর জমির পরিমাণ কমছে। তা সত্ত্বেও উৎপাদন বাড়াতে হচ্ছে। কৃষকদের আগ্রহ ধরে রাখতে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি সত্ত্বেও সরকার সারের দাম অপরিবর্তিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা অন্য সব ফসলের উৎপাদন বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছি, তবে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বরাবরের মতো চাল উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে।’
‘বোরো মওসুমে ধানের ভালো ফলন হলে তা দিয়ে প্রায় ৯ মাসের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়ে যায়। আর কৃষকও তার খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে ধান চাষাবাদে আগ্রহী থাকে। আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক বাড়ার এই সময়ে আমরা বোরো মওসুমে খাদ্য নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করছি,’ যোগ করেন তিনি।
অন্যান্য উদ্যোগ
কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের বিনামূল্যে সার ও বীজ সরবরাহ করার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় ভর্তুকি মূল্যে ট্রাক্টর ও হারভেস্টর মেশিন সরবরাহ করাসহ বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।
দেশের ৪৯৫ উপজেলায় ২.২৭ কোটি কৃষককে ‘কৃষক স্মার্ট কার্ড’ দেওয়ার জন্য প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। কৃষক পর্যায়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষি সেবা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে এ কার্ড দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কর্মকর্তারা আরও জানান, বেশিরভাগ সময় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী উৎপাদন হয় না। তবে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেওয়ায় গত বোরো মওসুমে চালের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বেশি হয়েছে। এবারও তেমনটিই আশা করছেন তারা।