ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটেও মিলছে না পানি
নিজস্ব প্রতিবেদক, খাগড়াছড়ি »
খাগড়াছড়ি জেলার দুর্গম পাহাড়ি গ্রামগুলোতে পানির জন্য হাহাকার চলছে। সুপেয় পানি তো দূরের কথা, ঘণ্টার পর ঘণ্টা পায়ে হেঁটেও ব্যবহারের পানিও মিলছে না।
জেলার দুর্গম পাহাড়ি এলাকাগুলোতে সুপেয় বা খাবার পানির জন্য মূলত প্রাকৃতিক ছড়া, ঝিরি ও কুয়ার পানির ওপর নির্ভর করতে হয়। এই উৎসগুলোতে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় চরম কষ্টে আছে বিপুল সংখ্যক দরিদ্র ও জুমিয়ারা। পানির এই কষ্ট অবর্ণনীয় হলেও সুখবর দিতে পারছেন না কেউই। বিশেষ করে, বৈশাখ ও চলতে জ্যৈষ্ঠ মাসে প্রত্যাশিত বৃষ্টি না হওয়ার ফলে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, দীঘিনালা, গুইমারা, খাগড়াছড়ি সদর, পানছড়ি উপজেলার দূরবর্তী এলাকাগুলোতে পানির অভাবে দৈনন্দিন জীবন অসহনীয় হয়ে উঠেছে।
এক কলস পানির জন্য দুই-আড়াই ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়, তাও আবার অনেক সময় মানুষ বেশি হলে খালি কলসি নিয়ে ফিরতে হয়। কোনো কোনো এলাকায় বসতিপাহাড় থেকে কুয়ার দূরত্ব নিচের দিকে কয়েক’শ ফুট দূরত্ব হওয়ায় দারুণ ঝুঁকি নিয়ে মা ও শিশুদের পানির উৎসে পৌঁছাতে হচ্ছে। বয়স্ক এবং অসুস্থ মানুষদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করা রীতিমতো এক কঠিন সংগ্রামে পরিণত হয়েছে। মাঝে মাঝে সামান্য বৃষ্টিপাতে এসব ঝিরি ও কুয়ার পানি ঘোলাটে ও অপরিষ্কার হয়ে পড়ায় সেই সময়ে দুর্ভোগ আরও চরম হয় তাদের।
সিন্দুকছড়ি এলাকার কলেজ শিক্ষার্থী যশোদা ত্রিপুরা জানান, নিজের গ্রামে সুপেয় পানির উৎস বলতে ঝিড়ি ও কূয়া। প্রতিদিন পরিবারের সদস্যদের জন্য অনেক দূর পাড় দিয়ে পানীয় জল সংগ্রহ করেন তিনি। কূয়ার পানি আমাদের জন্য বিশুদ্ধ পানি বটে।
স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী রতœা কিশোর ত্রিপুরা মুঠোফোনে জানান, দীর্ঘদিন ধরে আমাদের দোগ্যছড়া’সহ পার্শ্ববর্তী কয়েকটি গ্রামে পানি সমস্যা রয়েছে। সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান সুইনুপ্রু মারমার দায়িত্বকালীন সময়েরও পানির জন্য বিভিন্ন জনের কাছে আবেদন করেছি। কিন্তু কোনটাই বাস্তবায়ন হয়নি।
দ্যোগ্যছড়া গ্রামের কার্বারী থোয়াইঅং ত্রিপুরা বলেন, আমাদের এখানে সারা বছরই সুপেয় পানির সংকট থাকে। তবে অন্যান্য বছরের চেয়ে এ বছরে সংকট বেশি। ৪/৫ শ’ ফুট পাহাড়ি পথ ডিঙিয়ে এসব এলাকার মানুষকে পানি সংগ্রহ করতে হয়। এসব সমস্যা সমাধানে পার্বত্য জেলা পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর মিলে উদ্যোগ নিলে পানির এই কষ্ট কমবে বলে আশাবাদী তিনি।
সিন্দুকছড়ি ইউপি সদস্য সবেন জয় ত্রিপুরা জানান, আমার ওয়ার্ডের সমস্যার অভাব নেই। এরমধ্যে পানি সমস্যা অন্যতম। সারা বছর পানির জন্য কষ্ট করতে হয় এখানকার মানুষ। গভীর নলকূপ বসাতে চাইলেও পাথুরে হওয়ায় পানির উৎস পাওয়া যায় না, তখন ঠিকাদাররা কাজ করতে চান না। সমস্যার ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরেও অবগত করেছি, দেখা যাক, তারা কি করে।
‘জাবারাং’র নির্বাহী পরিচালক ও গবেষক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, ক্রমাগত পাহাড়ি এলাকার ঝিরি-ঝর্নাগুলো ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এর মূল কারণ হলো বাণিজ্যিভাবে গাছ কর্তন, পাথর উত্তোলন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি। অন্যদিকে পর্যটকের পরিবেশ বান্ধব আচরণ না করাও একটি কারণ বলে ধারণা করেছেন তিনি। পাহাড়ে আগেকার দিনে বড় বড় গাছ ছিল। পাহাড় না কেটে আমরা ঘর-বাড়ি তৈরি করতাম। কিন্তু এখন বন উজাড়হয়ে যাচ্ছে। জঙ্গল আগের মত সবুজ নেই। চারিদিকে ন্যাড়া পাহাড়। যার কারণে পাহাড়ে এখন পানির সংকট।
খাগড়াছড়ি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী রেবেকা আহসান মুঠোফোনে জানান, যেসব পাহাড়ি এলাকায় পানির সংকট কিংবা পানির উৎস নেই, সেসব এলাকায় একটি জরিপ করা হবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য মতে, জেলায় গভীর নলকূপ ও চাপকলের সংখ্যা ৯ হাজার ৬শ’ ৮৩। এর মধ্যে বিদ্যালয়ে বসানো হয়েছে ২শ’ ৩৪টি। চলতি অর্থবছরে ৩৪টি গভীর নলকূপ স্থাপনের কাজ চলছে। খাগড়াছড়ি জেলায় মোট জনগোষ্ঠীর ৫৬ শতাংশকে পানি সরবরাহ করা হয়। অন্যরা প্রাকৃতিক উৎসের (ঝিরি, ঝরনা, কুয়া, ছড়া) ওপর নির্ভরশীল।