নিজস্ব প্রতিবেদক, খাগড়াছড়ি »
বিএনপি-আওয়ামী লীগের পূর্বঘোষিত দুই ভিন্ন কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গতকাল খাগড়াছড়িতে এক সংঘর্ষের ঘটনায় তিন পুলিশ কর্মকর্তাসহ দুই রাজনৈতিক দলের ২২ জন আহত হয়েছে।
মঙ্গলবার সকালে বিএনপি-আওয়ামী লীগের পূর্বঘোষিত দুই ভিন্ন কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে শহরের শাপলা চত্বর থেকে সংঘর্ষ শুরু হয়। পরে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে আদালত সড়কজুড়ে। এ সময় তিন পুলিশ কর্মকর্তাসহ উভয়পক্ষের ২২ জন আহত হয়। এর মধ্যে সদর থানার এসআই মামুন হোসেন এবং শিক্ষানবিশ আইনজীবী ইকু বাবু চাকমাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রামে প্রেরণ করা হয়েছে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন সদর হাসপাতালের আরএমও ডা. রিপল বাপ্পি চাকমা। এই ঘটনায় ১২ জনকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা পুািলশ।
সরেজমিনে আওয়ামী লীগের ১৫ জন বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীকে জেলাসদরের সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে দেখা গেছে। তবে বিএনপি-আওয়ামী লীগ এবং পুলিশ মিলে হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে ৩৮ জনের চিকিৎসা নেয়ার তথ্য মিলেছে।
আহতদের মধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক নুরুল আজম, পৌর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও কাউন্সিলর রিটন তালুকদার, জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক কে এম ইসমাইল, জেলা যুবলীগ নেতা আলমাছ চৌধুরী, জেলা ছাত্রলীগের কংজরী মারমা, প্রনয়ন চাকমামহ অন্যদের মাথায় জখম রয়েছে। তারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল থেকেই পৌরসভার গেইট সংলগ্ন এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জড়ো হতে থাকেন উন্নয়ন পদযাত্রা কর্মসূচির জন্য। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিএনপি’র অনুসারীরা পৌরসভা সংলগ্ন এলাকা অতিক্রমকালে উভয়পক্ষের মধ্যে প্রথমে উচ্চবাচ্য থেকে বাগ-বিত-া এবং পরে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া থেকে রক্তক্ষয়ী সংঘাতে রূপ নেয়।
বিএনপি নেতাকর্মীদের সাথে কলাবাগান এলাকা থেকে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী লাঠিসোটা নিয়ে যোগ দিলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পিছু হঠতে বাধ্য হন। এ সময় ইট-পাটকেল-কাঁচের বোতলের হামলায় পুলিশসহ আওয়ামী লীগের অনুসারীরা বিভিন্ন অলিগলিতে ঢুকে পড়লে বিএনপি নেতাকর্মীরা পুলিশের বাধা টপকে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের দিকে এগোতে থাকেন। এর এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের কর্মীরাও লাঠিসোটা নিয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে পাল্টা ধাওয়া দিলে পুলিশ টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। কিন্তু ততক্ষণে পুরো আদালত সড়ক দখলে নিয়ে নেয় বিএনপি নেতাকর্মীরা।
পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অভিযোগ করেন, পুলিশের দুর্বল অবস্থানের কারণেই অনিয়ন্ত্রিত বিএনপি নেতাকর্মীরা খাগড়াছড়ি পৌরসভায় হামলা চালাতে থাকে। একপর্যায়ে পৌরসভার সামনে থাকা একটি মোটর সাইকেলে আগুন ধরিয়ে দিয়ে ভাংচুর করতে করতে পৌরসভার ভেতর ঢুকে পড়ে তারা। পৌরসভার ভেতর ঢুকে দরজা-জানালা ভাংচুরের পাশাপাশি আসবাবপত্র, কম্পিউটার ছাড়াও অফিসের দাপ্তরিক নথিপত্র তছনছ করে।
পৌরসভার নির্বাহী কর্মকর্তা পারভীন আক্তার খোন্দকার জানান, এই হামলা অনাকাক্সিক্ষত এবং নিন্দাজনক। পরিস্থিতি অশান্ত থাকায় তাৎক্ষণিক ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণ করা যায়নি। আগামীকাল (বুধবার) এটি বোঝা যাবে। যেটুক ক্ষতি হয়েছে তাতে নাগরিকদের জরুরি সেবা কার্যক্রমে সহায়তা দিতে কয়েক সপ্তাহ বেগ পেতে হবে।
জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক কেএম ইসমাইল হোসেন পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, বিএনপি খাগড়াছড়ি শহরে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। তারা আওয়ামী লীগের অফিসে হামলা চালিয়ে অসংখ্য নেতাকর্মীকে আহত করেছে।
পৌরসভার মেয়র এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্মলেন্দু চৌধুরী অভিযোগ করেন, রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করা রাজনৈতিক অধিকার। এই অধিকারের অজুহাতে পৌরসভার মতো সেবা প্রতিষ্ঠানে হামলা এবং ভাংচুর চালিয়ে জনস্বার্থ বিঘœকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি অপরাধীদের বিরুদ্ধে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আশুতোষ চাকমা অভিযোগ করে বলেন, সরকারের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা জানান দিতে এবং সরকারি বিনামূল্যের সেবাসমূহ ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষে উৎসবমুখর কর্মসূচি ছিলো আমাদের পদযাত্রা। আর এই সুযোগে বিএনপি পরিকল্পিতভাবে দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নিরাপরাধ নেতা-কর্মীদের রক্তাক্ত করেছে। আমরা এটি আইনিভাবেই মোকাবিলা করবো।
খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এমএন আবছার অভিযোগ করে বলেন, বিএনপির নেতাকর্মীরা পদযাত্রায় অংশ নিতে দলীয় কার্যালয়ের সামনে জমায়েত হওয়ার প্রাক্কালে আওয়ামী লীগ বিনা উস্কানিতে হামলা চালিয়ে ভাংচুর করেছে। এছাড়া আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের মারধর করা হয়েছে। এতে বিএনপির ৫০ নেতাকর্মী আহত হয়েছে।
তবে বিএনপি’র পক্ষ থেকে আহতের সংখ্যা পঞ্চাশের অধিক দাবি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জেলা বিএনপি’র সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রব রাজা জানান, কেন্দ্রঘোষিত পূর্বনির্ধারিত শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা কর্মসূচিতে যোগদানের জন্য শহরের কলাবাগান এলাকায় অবস্থান করছিলাম। বিভিন্ন উপজেলা থেকে কর্মসূচিতে যোগ দিতে আসা নেতাকর্মীদের ওপর অতর্কিতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হামলা চালায়। আহতরা বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
এদিকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আহতের সংখ্যা ত্রিশের অধিক দাবি করা হয়েছে। জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, আহতদের মধ্যে সদর থানার ওসি আরিফুল ইসলাম এবং এসআই মিনহাজ জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি আছেন। এসআইন মামুনকে চট্টগ্রামে প্রেরণ করা হয়েছে। এছাড়া আরো ৫/৭ জন কনস্টেবলকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে হয়েছে।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সদর থানার ওসি আরিফুল ইসলাম বলেন, ঘটনার ভয়াবহতায় আমি কখন সেন্সলেস হয়ে গেছি টেরই পাইনি। একইভাবে হাসপাতালের পাশাপাশি কক্ষে মাথায় গুরুতর জখম নিয়ে চিকিৎসাধীন জেলা আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল আজম অভিযোগ করেন, সংঘাতে জড়ানো বা কারো ওপর হামলা করার অসৎ উদ্দেশ্য থাকলে আওয়ামী লীগের পক্ষেও লাঠিসোটা বা অনেক কিছু থাকতো। কিছু ছিলো না বলেই বিএনপি কাপুরুষোচিত হামলা করতে পেরেছে।
হামলায় জখম হওয়া পৌর কাউন্সিলর রিটন তালুকদার বলেন, আমি পৌরসভায় হামলাকারীদের বোঝাতে চেয়েছি; এটা জনগণের সম্পত্তি। কারো ব্যক্তিগত বা দলের নয়। এটা বলতে না বলতেই কাঠের মাথায় পেরেক ঢোকানো এক দেশীয় অস্ত্র দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করতেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ি।
তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পুলিশ ঘটনার শুরু থেকেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে।
এ ব্যাপারে খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার (টুরিস্ট পুলিশে সদ্য বদলি হওয়া) মো. নাইমুল হককে সাংবাদিকরা অসংখ্যবার মুঠোফোনে কল দিলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। তবে জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের পাশাপাশি সাময়িক বিজিবির সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার আইন-শৃঙ্খলা সম্পর্কিত কোর কমিটির বিশেষ সভা ডাকা হয়েছে। মঙ্গলবার বিকেল থেকেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। যানচলাচল, ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক করার পাশাপাশি পর্যটকদের নিরাপত্তা বিধানে টুরিস্ট পুলিশকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।