সনেট দেব »
খরগোশ এক আশ্চর্য সুন্দর প্রাণী। তার সাদা, ধূসর বা বাদামি রঙের নরম লোমে ঢাকা শরীর দেখে মনে হয় যেন তুলোর বল গড়িয়ে যাচ্ছে ঘাসের ওপর দিয়ে। মাথার দুই পাশে লম্বা কান, চোখ দুটো গোল আর চকচকে, যেন দুইটা ছোট্ট মুক্তা। খরগোশের মুখ সবসময় নড়তে থাকে, কারণ সে প্রায়ই কিছু না কিছু খাচ্ছে বা চিবুচ্ছে। শিশুরা খরগোশ দেখলে হাসতে থাকে, কারণ তার চেহারায় এমনই এক মিষ্টি মায়া থাকে যে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।
খরগোশের সবচেয়ে বড় গুণ হলো তার দৌড়ানোর ক্ষমতা। যদিও দেখতে সে খুব শান্ত, কিন্তু ভয় পেলেই যেন হঠাৎ বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে যায়। তার লম্বা ও মজবুত পা তাকে এই গতিই দেয়। এক লাফে সে প্রায় দুই মিটার পর্যন্ত এগিয়ে যেতে পারে! বনে যখন শেয়াল বা বন্য বিড়াল তার পিছু নেয়, তখন সে এমন চতুরভাবে জিগজ্যাগ করে দৌড়ায় যে শিকারিও হতভম্ব হয়ে যায়। ছোট ছোট বাচ্চা খরগোশরাও খুব তাড়াতাড়ি দৌড়াতে শেখে—এ যেন তাদের জন্মগত প্রতিভা।
খরগোশেরা গর্তে থাকতে ভালোবাসে। তারা মাটির নিচে নিজেদের ছোট্ট রাজ্য তৈরি করে, যাকে বলা হয় বারো বা নঁৎৎড়।ি এই গর্তগুলোর ভেতর অনেকগুলো রাস্তা থাকে—একটা ঢোকার, একটা বের হওয়ার, আর মাঝে মাঝে লুকানোর জায়গা। বৃষ্টির দিনগুলোতে বা শীতের রাতে, খরগোশ পরিবার সেখানে একসাথে থাকে। মা খরগোশ তার বাচ্চাদের বুকের কাছে নিয়ে উষ্ণ রাখে। বাচ্চারা চোখ খুলে মায়ের কাছে দুধ খায়, তারপর একটু বড় হলে তারা বারোর মুখে এসে সূর্যের আলোয় খেলা করে।
খরগোশ সম্পূর্ণ তৃণভোজী প্রাণী, মানে তারা শুধু উদ্ভিদজাত খাবার খায়। ঘাস, পাতা, গাজর, শসা, ধনেপাতা—এসবই তাদের খুব প্রিয়। অনেক সময় ভোরবেলা দেখা যায়, খরগোশ মাঠে ঘাস খাচ্ছে, আর ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে শিশিরের ফোঁটায় তাদের গোঁফ ভিজে যাচ্ছে। গাজর খাওয়ার সময় তাদের মুখের নড়াচড়া এত সুন্দর লাগে যে ছোটরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। খরগোশ নিজের খাবার গন্ধে চিনতে পারে এবং কখনো নোংরা বা পচা কিছু খায় না—তারা খুবই পরিচ্ছন্ন ও সংবেদনশীল প্রাণী।
খরগোশের চোখের দৃষ্টি অদ্ভুতভাবে শক্তিশালী। তাদের চোখ এমনভাবে মাথার দুই পাশে বসানো যে, তারা প্রায় চারদিকই দেখতে পায়। তাই শত্রুরা কাছাকাছি এলেও খরগোশ তাড়াতাড়ি টের পায়। তাদের কানও অত্যন্ত সংবেদনশীল; দূরের সামান্য শব্দও শুনে তারা সতর্ক হয়ে যায়। কেউ পা ফেলে হাঁটলেও, খরগোশ কান খাড়া করে শুনে নেয়—তারপর হয়তো মুহূর্তেই ছুটে পালায়।
খরগোশের জন্ম হয় সারা বিশ্বেই। ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা—সব জায়গাতেই খরগোশ পাওয়া যায়। আমাদের দেশ বাংলাদেশেও খরগোশ দেখা যায়, বিশেষ করে পাহাড়ি এলাকায় বা গ্রামের মাঠের ধারে। কেউ কেউ আবার বাড়িতে পোষ্য হিসেবেও রাখে। তবে ঘরে পোষা খরগোশকে নিয়মিত যত্ন দিতে হয়—তাদের জন্য পরিষ্কার জায়গা, তাজা খাবার ও খেলার জায়গা দরকার হয়।
বনে খরগোশের অনেক শত্রু আছে—শেয়াল, বেজি, বন্য কুকুর, এমনকি কিছু পাখিও খরগোশ শিকার করে। কিন্তু প্রকৃতির নিয়মেই তারা বুদ্ধিমত্তা আর গতির সাহায্যে নিজেদের টিকিয়ে রাখে। খরগোশ ভয় পেলেও মাথা ঠান্ডা রাখে, চুপচাপ এক জায়গায় বসে থাকে, যাতে কেউ তাকে খুঁজে না পায়। এইভাবে বনের কঠিন জীবনে খরগোশ নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে, ঠিক যেমন মানুষও প্রতিদিন নিজের বুদ্ধি ও পরিশ্রম দিয়ে টিকে থাকে।
খরগোশ শুধু প্রকৃতির প্রাণী নয়, সে গল্প, কার্টুন ও রূপকথারও প্রিয় চরিত্র। ‘টম অ্যান্ড জেরি’র মতোই জনপ্রিয় ‘বাগস বানী’ নামে এক কার্টুন খরগোশ তো সারা বিশ্বের শিশুদের প্রিয়। আমাদের দেশেও অনেকে ছোটবেলায় গল্পে পড়েছে “খরগোশ আর কচ্ছপের দৌড়ের গল্প”—যেখানে খরগোশ শেখায় আত্মবিশ্বাসের দাম, আর কচ্ছপ শেখায় ধৈর্য্যের মূল্য।
খরগোশের বৈজ্ঞানিক নাম হলো ঙৎুপঃড়ষধমঁং পঁহরপঁষঁং। তারা স্তন্যপায়ী প্রাণী, অর্থাৎ মায়ের দুধ খেয়ে বেঁচে থাকে। খরগোশ সাধারণত শীতল বা নরম আবহাওয়ায় থাকতে ভালোবাসে, যেখানে প্রচুর ঘাস ও গাছপালা আছে। গরম মরুভূমির মতো জায়গা তারা পছন্দ করে না, কারণ তাদের লোম গরমে অস্বস্তি দেয়। তাই খরগোশেরা সাধারণত জঙ্গল, ঘাসভরা মাঠ বা বাগানজাত পরিবেশে বসবাস করে।
খরগোশ আমাদের শেখায় প্রকৃতির সৌন্দর্য ও সহাবস্থানের শিক্ষা। তারা কাউকে আঘাত করে না, কখনো অহেতুক লড়াইও করে না। তাদের জীবন শান্ত, কিন্তু সতর্ক। খরগোশের মতোই আমাদেরও উচিত প্রকৃতির সঙ্গে বন্ধুত্ব করা, পরিষ্কার থাকা, সক্রিয় থাকা, আর সময়মতো কাজ করা। তাই বলা যায়, খরগোশ শুধু একটি প্রাণী নয়, সে প্রকৃতির এক হাসিখুশি বন্ধু—যে প্রতিদিন তার লাফানো আর দৌড়ের মধ্যে দিয়ে আমাদের শেখায় জীবন কত সুন্দর, যদি আমরা সতেজ আর নির্ভয়ে বাঁচতে জানি।





















































