ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম »
ক্রেমলিন! পৃথিবীর চোখ ঝলসানো এক দুর্গের নাম। এর ভেতরেই রয়েছে আমেরিকার হোয়াইট হাউসের মতো রাশিয়ান প্রশাসনের সদর দফতর। তেরো শতক থেকে শুরু করে রাশিয়ার সব ঐতিহাসিক রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাথে এটি জড়িত। স্নায়ুযুদ্ধের সময় ক্রেমলিন ছিল পৃথিবীর শক্তিধর প্রশাসনের অন্যতম একটি।
রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর কেন্দ্রবিন্দুতে গড়ে ওঠা ক্রেমলিন শুধু অনন্যই নয়, কালের সাক্ষী। এর স্থাপত্যকলা, শৈল্পিক সৌন্দর্য মনোমুগ্ধকর। সব সময়েই এটি নবযৌবনা। জার স¤্রাট থেকে শুরু করে লেনিন, স্টালিন হয়ে আজকের সকল শাসকেরই সরকারি বাসস্থান এই ক্রেমলিন। ফলে ক্রেমলিনকে রাশিয়ার শত্রুদের বিরাগভাজনে পরিণত হতে হয়। ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়ন রাশিয়া আক্রমণ করে ক্রেমলিন দখল করেছিল ১৮১২ সালের সেপ্টেম্বরে। আবার অক্টোবরে তিনি যখন ক্রেমলিন ত্যাগ করেন তখন তার বাহিনীকে আদেশ দিয়েছিলেন ক্রেমলিন ধ্বংস করতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফরাসি বাহিনীকে পিছু হটতে হয়েছিল। তবে স্টালিনের সময়ে ক্রেমলিনে জারদের অনেক স্মৃতি মুছে দেন। নতুন করে সোভিয়েতের ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে গড়ে তোলেন ক্রেমলিনকে।
ক্রেমলিন দুর্গের পাশেই মস্কোভা নদী। রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলোর অন্যতম একটি। মস্কোর ইতিহাসের মতই বহমান চলে আসা এর ইতিহাস। এর স্রোতের সঙ্গে ভেসে গেছে রক্তের বন্যা, সৃষ্টি হয়েছে অনন্য বিপ্লব। এই নদীর ক্রুজে মস্কো শহরের সৌন্দর্যই শুধু ধরা পড়বে না, কান পাতলে শোনা যাবে ইতিহাসের অনেক গল্প।
মস্কো নদীর তীরেই যেমন রাশিয়ার ক্ষমতার প্রতীক ক্রেমলিন। তেমনি এর পাশেই বিখ্যাত গীর্জা গুলি যেমন সেন্ট বেসিল দ্য গ্রেড ক্যাথেড্রাল, খ্রীস্ট দ্য সেভিয়ার ক্যাথেড্রাল। আরো দেখা মিলবে বিশ্ববিদ্যালয় এবং জ্ঞান বিজ্ঞানের পাদপীঠ বিজ্ঞান একাডেমির এক অনন্য দৃশ্য!
কি নেই ক্রেমলিনে। সেক্রেটারিয়েট অফিস থেকে অস্ত্রাগার। সবই এখানে। আড়াইশ একর জায়গা জুড়েই আছে শুধু আর্মারি অস্ত্রাগার। ক্রেমলিনে স্থাপত্য হিসেবে রয়েছে অনেকগুলো সুউচ্চ টাওয়ার, ঘন্টা বা বেল এবং ক্যাথেড্রাল বা গীর্জা ।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই ক্রেমলিন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু হয়ে উঠে। ক্রেমলিনের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে ১৯৭২ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধুর সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরের সময়। ক্রেমলিনে সাধারণত সোভিয়েত ইউনিয়নে রাষ্ট্রীয়ভাবে আমন্ত্রিত রাষ্ট্রপ্রধানরাই অবস্থান করে থাকেন। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নে সফরের সময় বঙ্গবন্ধু ছিলেন সরকার প্রধান। তবুও বঙ্গবন্ধুর সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে তিনি তাঁর সফরসঙ্গীদের নিয়ে ক্রেমলিনেই অবস্থান করেন। ‘বঙ্গবন্ধুই দ্বিতীয় সরকার প্রধান যাকে ক্রেমলিনে অবস্থানের বিরল মর্যাদা দেওয়া হলো’। অবশ্য এর আগে ভারতের সরকার প্রধান শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকেও সোভিয়েত ইউনিয়ন এই বিশেষ মর্যাদা প্রদান করেছিল। এ বিষয়ে সমসাময়িক পত্র পত্রিকায় প্রথম পাতায় গুরুত্বের সাথে সংবাদ শিরোনাম করা হয়: ‘ক্রেমলিন প্রাসাদে বঙ্গবন্ধু’।
বিশ শতকের শুরু থেকেই রাজনীতির পাশাপাশি এদেশীয় সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চায় লেনিনকে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। লেনিন ভক্ত মানুষের সংখ্যা বাংলাদেশে অনেক ছিল। অবিভক্ত ভারতের রাজনীতিবিদরা সোভিয়েত রাশিয়া ও লেনিনের দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন। রাজনীতির ময়দানে প্রসঙ্গক্রমে সোভিয়েত, রুশ বিপ্লব, মার্কসবাদ এগুলো চলে আসত। নেতাজী সুভাষ বসু প্রায়ই বলতেন ১৯১৭ সালের পূর্বের রাশিয়া ও লেনিনের ভূমিকার কথা। লেনিনকে বাঙালির কাছে অদেখার ভুবনে পরিচয় করে দেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর লেনিন কবিতার মাধ্যমে। সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘বিপ্লব স্পন্দিত বুকে, মনে হয় আমিই লেনিন।’ বাঙালির কাছে লেনিন ক্রমান্বয়ে হয়ে উঠেছেন এক স্বপ্নপুরুষ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একজন আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ। লেনিনের প্রতিও ছিল তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা। পৃথিবীর সমস্ত রাষ্ট্রপ্রধানরা যখন ক্রেমলিন সফরে যান , তখন তাঁরা অবশ্যই দুটি জায়গায় শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। একটি হলো রেডস্কোয়ারে লেনিন সমাধি সৌধে এবং অপরটি দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে শহীদ সৈনিকদের স্মৃতিসৌধে। ক্রেমলিনে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সফর সঙ্গীরাও তাঁর ব্যতিক্রম ছিলেন না।
১৯৭২ সালের ২ মার্চ তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেড স্কোয়ারে লেনিন সমাধিসৌধে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন। এছাড়াও ক্রেমলিন প্রাচীরের নিকটে আলেকজান্দ্রাভস্কি স্কোয়ারে অজ্ঞাত পরিচয় সৈনিকদের সমাধিতেও পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন। সমাধিসৌধে বঙ্গবন্ধুর শ্রদ্ধা হিসেবে ফুলের মালা বহন করেন বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী বঙ্গবন্ধু পুত্র শেখ কামাল, নিরাপত্তা অফিসার মহিউদ্দিন এবং প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমদ।
লেনিনের সমাধিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন। একই সাথে তিনি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ক্রেমলিনের রেড স্কোয়ারে অবস্থিত সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা “ভøাদিমির উলিয়ানভস্ক লেনিনের” মাউসোলিউমে , যেখানে লেনিনের মৃতদেহটি সংরক্ষণ করা আছে। মস্কোয় লেনিনের সমাধিতে বঙ্গবন্ধুর দেয়া পুষ্পমাল্যে ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নিকট হইতে মরণজয়ী লেনিনের প্রতি’ বাক্যটির মধ্য দিয়েই প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর অপরিসীম ভক্তি ও শ্রদ্ধা।
১৯৭২ সালের ১ মার্চ তারিখ বিকেলে সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্রেমলিনে তাঁদের প্রথম দফা আলোচনা শুরু করেন। এই বৈঠকের বিষয়বস্তু ছিল দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা, আন্তর্জাতিক সমস্যা ও বাংলাদেশের বিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠনে সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতা ইত্যাদি। আলোচনাকালে উভয়পক্ষের প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সোভিয়েত ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী বিবাকভ এবং নোভিকভ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আঁদ্রে গ্রেমিকো, প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্শাল গ্রেচকো, কারিগরিমন্ত্রী স্কেচকভ, সোভিয়েত কম্যুনিস্ট পার্টি কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সেক্রেটারি পনোমারেভ। অপরপক্ষে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সহযোগিতা করেছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবস সামাদ আজাদ, পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ড. নূরুল ইসলাম, পররাষ্ট্র সেক্রেটারি এস আর করিম, অর্থ সেক্রেটারি মতিয়ুল ইসলাম, বৈদেশিক দফতরের ডিরেক্টর জেনারেল কিবরিয়া এবং মস্কোয় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শামসুর রহমান।
১৯৭২ সালের ১ মার্চ তারিখে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মানে সোভিয়েত সরকার ক্রেমলিন প্রাসাদে এক নৈশভোজের আয়োজন করে। ভোজসভায় লিওনিদ ব্রেজনেভ, আলেক্সি কোসিগিন ও নিকোলাই পদগর্নি যোগদান করেন। অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত এই ভোজসভায় উভয় প্রধানমন্ত্রীই ভাষণ দিয়েছিলেন। ক্রেমলিনের নৈশভোজে সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন বক্তৃতার শুরুতে বঙ্গবন্ধুকে একজন মহান নেতা হিসেবে মূল্যায়ন করেন। তিনি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীরূপে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের যোগ্য প্রতিনিধিরূপে এবং মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য একজন মহান সংগ্রামী রূপে আপনাকে সোভিয়েত সরকার ও আমাদের বন্ধুদের পক্ষ থেকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদকেও আমরা আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি। আপনার সঙ্গে তিনিও সংগ্রাম করেছেন। আপনার যে সকল সহকর্মী আপনার সঙ্গে মস্কো আগমন করেছেন, তাদেরকে আমরা আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি।
১৯৭২ সালের ২রা মার্চ বঙ্গবন্ধু তৎকালীন সোভিয়েত প্রিমিয়ার, সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিস্ট পার্টির মহাসচিব, সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান লিওনিদ ব্রেজনেভের সাথে সাক্ষাৎ করেন ঐতিহাসিক ক্রেমলিনে । এ সময় প্রায় ৪০ মিনিটের মত তিনি লিওনিদ ব্রেজনেভের সাথে কাটান। বঙ্গবন্ধুর সাথে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে নিয়োজিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সামসুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু সোভিয়েত প্রিমিয়ার লিওনিদ ব্রেজনেভেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে তাঁর শর্তহীন মুক্তিতে চাপ প্রয়োগ করার জন্য ধন্যবাদ জানান। এরপর তাঁদের মধ্যে ব্যক্তিগত আলাপ হয়। লিওনিদ ব্রেজনেভ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সস্ত্রীক মস্কো সফরের আমন্ত্রণ জানান।
তবে ক্রেমলিনে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় পাওয়া ছিল ১৯৭২ সালের ৩রা মার্চ তারিখে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক চুক্তি। যা ঝড়ারবঃ টহরড়হ–ইধহমষধফবংয ঔড়রহঃ উবপষধৎধঃরড়হ ১৯৭২ নামে পরিচিত। সোভিয়েত-বাংলাদেশ চুক্তিটি জাতিসংঘের অনুমোদনের জন্য ১৯৭২ সালের ১৪ মার্চ তারিখে সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে জ্যাকব মালিক জাতিসংঘে উপস্থাপন করেন। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু এই চুক্তির মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে প্রতিরক্ষা, শিক্ষা, চিকিৎসা, সামরিক ইত্যাদি বিষয়ে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি আদায় করে নেন। চুক্তিটি দুই দেশের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব আন্তরিক মনোভাব ও পারস্পরিক বিশ্বাস নিয়ে সম্পাদিত হয়। শান্তি ও সম্প্রীতির অন্তর্দৃষ্টির প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের পুনর্গঠনে চুক্তির ভূমিকা ছিল অপরিসীম। ক্রেমলিনে স্বাক্ষরিত সোভিয়েত বাংলাদেশ যুক্ত ইশতাহারে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের এক অসাধারণ সাফল্যই প্রতিফলিত হয়েছে।
লেখক : প্রফেসর, ইতিহাস বিভাগ, চবি সাবেক উপ উপাচার্য,
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়, পাবনা