ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ড : মানবেতর দিন কাটছে ৩ হাজার রোহিঙ্গার

নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার »

উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে সবকিছু হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর দিন কাটছে ৩ হাজার রোহিঙ্গার। অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে ছাই হয়েছে রোহিঙ্গাদের ৬’শোর বেশি বসতি, মারা যায় শিশুসহ দুইজন। একে তো শীত, তার ওপর বসতি হারিয়ে চরম কষ্টে পড়েছে এসব রোহিঙ্গারা। তবে দ্রুত শেড নির্মাণ করে দেওয়াসহ তাদের সমস্যা লাঘবে কাজ করছে বলে জানিয়েছে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন।
আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া রোহিঙ্গা বসতির বহু পরিবারে নেই কোন কাপড় চোপড়, আসবাবপত্র কিংবা খাদ্যসামগ্রী। শুধু কোনো রকম পরিবার-পরিজন নিয়ে নিরাপদ আশ্রয় গিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছেন তারা। অনেক রোহিঙ্গা ফিরছেন সেই পুড়ে যাওয়া বসতিতে। ছাই হয়ে যাওয়া বসতিতে খুঁজে বেড়াচ্ছেন কিছু পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু আগুনে কেড়ে নিয়েছে তাদের সব সম্বল। একে তো শীত পড়ছে; তার ওপর বসতি হারিয়ে এখন খোলা আকাশের মানবেতর নিচে দিন কাটছে রোহিঙ্গা পরিবারগুলোর।
আগুনে রোহিঙ্গা নারী দিলুয়ারার ঘর পুড়ে গেছে। তিনি ৬ সন্তান নিয়ে আশ্রয় নেন পাশের খোলা মাঠে। অন্যের কাছ থেকে চেয়ে আনা পুরোনো কাপড়ে শিশুদের শরীর ঢেকে শীতের দুটি রাত পার করেন। এখন মাথা গোঁজার স্থায়ী ঠিকানা নিয়ে চিন্তিত। দিলুয়ারা বলেন, এখন গোসল, টয়লেট নিয়ে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। আগুনে সবকটি গোসলখানা, ল্যাট্রিন পুড়ে গেছে।
আরেক রোহিঙ্গা ফিরোজ বলেন, ‘মঙ্গলবার দুপুরে হঠাৎ ক্যাম্পে আগুন লাগে। চিৎকার শুনে লোকজন এদিক-ওদিক ছুটাছুটি শুরু করে। বাঁচতে কোনমতে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি। আমাদের ঘরের সব কিছু আগুনে পুড়েছে।’
সরেজমিন দেখা যায়, পাহাড়ের ঢালুতে খোলা মাঠ। আশপাশে কিছু পুড়ে যাওয়া গাছপালা। ক্ষতিগ্রস্ত অনেক রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকা আত্মীয়স্বজনের বসতিতে অবস্থান করছেন। আবার অনেকেই ধ্বংসস্তূপের ওপর ত্রিপল বা বাঁশ দিয়ে কোনোমতে মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরি করছেন। তবে অগ্নিকাণ্ডে সবকিছু পুড়ে যাওয়ায় অনেক পরিবারে হয়নি রান্না। দোকান থেকে শুকনা খাবার কিনে খাওয়ার সামর্থ্যও নেই অনেকের।

ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গা নারী কুলছুমা বলেন, আগুনে পুড়ে সব শেষ হয়ে গেছে। আমার চোখের সামনে সব কিছু পুড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু করার কিছু ছিল না।
গৃহহীন আরেক রোহিঙ্গা ছৈয়দ আহমদ বলেন, প্রতিবছর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। অধিকাংশ অগ্নিকাণ্ড রাতে ঘটলেও এবার দিনদুপুরে ঘটনা ঘটেছে। এখন ক্ষতিগ্রস্ত সবার খুবই কষ্টে দিন কাটছে।
তবে এই অগ্নিকাণ্ডকে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন রোহিঙ্গা কমিউনিটির নেতারা। আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, নানা ধরনের ষড়যন্ত্র হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন না করার জন্য। এই অগ্নিকাণ্ডও তার একটি অংশ।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের অতিরিক্ত কমিশনার সামছু-দ্দৌজা নয়ন বলেন, মঙ্গলবার দুই ঘণ্টার অগ্নিকাণ্ডে আশ্রয়শিবিরে ডি ও সি ব্লকের ৬১৯টি রোহিঙ্গা বসতি পুড়ে গেছে। তাতে ৩ হাজার ২০০ জন রোহিঙ্গা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আগুনে পুড়ে মারা গেছেন দুজন। গৃহহীনদের জন্য দুপুর ও রাতে রান্না করা খাবার সরবরাহ করা হয়েছে। অধিকাংশ রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে থাকা আত্মীয়স্বজনের ঘরে অবস্থান করছেন। ধ্বংসস্তূপের ওপর স্থায়ী ঘর নির্মাণের প্রস্তুতি চলছে। নকশার কাজ শেষ হলে ঘর নির্মাণের কাজ শুরু করা হবে। ততদিন ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের খাবার সরবরাহসহ মানবিক সেবা দেওয়া হবে।
মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আশ্রয়শিবিরের ডি ব্লকের একজন রোহিঙ্গার রান্নাঘর থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। মুহূর্তে তা আশ্রয়শিবিরের অন্যান্য ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। সেনাবাহিনী, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), ফায়ার সার্ভিস ও স্বেচ্ছাসেবীরা বেলা আড়াইটার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। ততক্ষণে ৬১৯ ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৬ বছরে ২১০ অগ্নিকাণ্ড
পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও রোহিঙ্গা নেতাদের দেওয়া তথ্যমতে, গত ছয় বছরে আশ্রয়শিবিরে ছোট-বড় মিলে অন্তত ২১০টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। অধিকাংশ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত রান্নাঘরের গ্যাস সিলিন্ডার থেকে।
সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ২০২১ সালের ২২ মার্চ উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবিরে। আগুনে বালুখালী আশ্রয়শিবিরের পাঁচটি ক্যাম্প ১০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বসতি পুড়ে ছাই হয়েছিল। তখন ৬ শিশুসহ অন্তত ১৪ রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়। গৃহহীন হয়ে পড়ে ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা।
বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। গত সাত বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। বরং ফাঁকে ফাঁকে বহু রোহিঙ্গা আশ্রয় নেওয়া বিভিন্ন শিবিরে ইতোমধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে।