সনেট দেব »
প্রাণীরাজ্যে এমন এক বিস্ময় আছে, যার প্রতিটি পদক্ষেপে লুকিয়ে আছে চমক ও কৌতূহল—সে হলো ক্যাঙ্গারু। পৃথিবীর আর কোনো প্রাণী এত বড় দেহ নিয়ে এত সহজে, এত শক্তিতে, এত দূর লাফিয়ে চলতে পারে না। অস্ট্রেলিয়ার বিস্তীর্ণ তৃণভূমি, শুষ্ক মরুভূমি আর সোনালি প্রান্তরের রাজা এই ক্যাঙ্গারু। শুধু যে তারা অস্ট্রেলিয়ার প্রাণী, তা-ই নয়—অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় প্রতীকও বটে। দেশের পতাকা, মুদ্রা, এমনকি সরকারি প্রতীকচিহ্নেও ক্যাঙ্গারুর ছবি গর্ব ভরে স্থান পেয়েছে। কারণ এই প্রাণীটি অস্ট্রেলিয়ানদের কাছে এক অর্থে অগ্রগতির প্রতীক, যে কখনো পিছনে হাঁটে না, সবসময় এগিয়ে চলে সামনে।
দূর থেকে তাকালে দেখা যায়, দলে দলে বাদামি রঙের ক্যাঙ্গারু ঘাস খাচ্ছে, কেউ বা লাফিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দূর প্রান্তরে। দেখতে যেন বাদামি ঢেউ বয়ে যাচ্ছে প্রান্তর জুড়ে। সূর্যের আলো যখন পশ্চিমে হেলে পড়ে, তখন তাদের ছায়াগুলোও লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে থাকে মাটির ওপর—প্রকৃতির এক অনবদ্য দৃশ্য।
ক্যাঙ্গারুর শরীরের গঠন অন্য প্রাণীর মতো নয়। তাদের পেছনের পা দুটি লম্বা, শক্তিশালী ও পেশিবহুল—যেন লাফের জন্যই বানানো। তুলনায় সামনের পা ছোট, আর পেছনে থাকে এক মোটা, মজবুত লেজ, যা ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করে। তারা আমাদের মতো বা ঘোড়ার মতো হাঁটতে পারে না; বরং সামনের পা দিয়ে ধীরে ধীরে ভর নেয়, তারপর হঠাৎ শক্তি সঞ্চয় করে এক লাফে অনেকটা পথ অতিক্রম করে। একবার লাফ দিলে তারা আট থেকে নয় মিটার দূর পর্যন্ত চলে যেতে পারে, আর ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার গতিতেও ছুটতে পারে। ভাবা যায়! প্রকৃতি তাদের শরীরে এমন এক ব্যবস্থা দিয়েছে, যাতে তারা দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেও খুব বেশি শক্তি খরচ করে না। তাই বলা হয়, লাফিয়ে চলা শুধু তাদের অভ্যাস নয়—এটাই তাদের বেঁচে থাকার বিজ্ঞান।
আরেকটি আশ্চর্য তথ্য হলো—ক্যাঙ্গারু পিছন দিকে হাঁটতে পারে না! তাদের পা ও লেজের গঠন এমনভাবে তৈরি, যা কেবল সামনে চলার উপযোগী। তাই অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় প্রতীক হিসেবে ক্যাঙ্গারু নির্বাচিত যেন এক জীবন্ত বার্তা, “জীবনে শুধু এগিয়ে যেতে হবে, পিছনে নয়।”
ক্যাঙ্গারুরা খুবই সামাজিক প্রাণী। তারা সাধারণত দলে থাকে, যাকে বলে ‘মব’। একটি মবে অনেকগুলো ক্যাঙ্গারু থাকে—কখনো দশ, কখনো শতাধিক। তাদের মধ্যে থাকে একটি বড় ও শক্তিশালী পুরুষ ক্যাঙ্গারু, যাকে দলের নেতা হিসেবে সবাই মানে। নেতা দলের নিরাপত্তা রক্ষা করে, অন্য পুরুষদের সঙ্গে লড়াই করে নিজের আধিপত্য বজায় রাখে। মবের প্রতিটি সদস্য একে অপরকে সাহায্য করে—কেউ শত্রু দেখলে সবাইকে সতর্ক করে দেয়, কেউ ঘাস খোঁজে, কেউ ছোটদের পাহারা দেয়। সন্ধ্যার সময় দূরে তাকালে দেখা যায়, বিশাল এক দল একসঙ্গে লাফিয়ে যাচ্ছে, যেন প্রকৃতি নিজেই নৃত্য করছে তাদের সঙ্গে।
ক্যাঙ্গারুর জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক হলো মায়ের থলে। জন্মের সময় বাচ্চা ক্যাঙ্গারু এত ছোট যে তার দৈর্ঘ্য মাত্র এক ইঞ্চি, আর চোখও খোলে না। তখনই সে মায়ের পেটের থলে বরাবর হামাগুড়ি দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে। সেখানে সে পায় উষ্ণ আশ্রয়, মায়ের দুধ, আর নিরাপত্তা। থলের ভেতরে থেকেই সে কয়েক মাস বেড়ে ওঠে। কখনো কখনো তাকে দেখা যায়—মায়ের থলের ভেতর থেকে ছোট্ট মুখটা উঁকি দিচ্ছে, আবার কখনো লেজটা বাইরে ঝুলছে। দৃশ্যটা এত মায়াময় যে মনে হয়, এ যেন প্রকৃতির তৈরি দোলনা। কয়েক মাস পর বাচ্চা বাইরে বের হয়, কিন্তু ভয় পেলে আবার দৌড়ে থলের ভেতরে ঢুকে পড়ে। পৃথিবীতে এমন আশ্চর্য আশ্রয় ব্যবস্থা আর কোনো প্রাণীর নেই।
ক্যাঙ্গারুর প্রজাতিও নানান রকম। সবচেয়ে বড় হলো লাল ক্যাঙ্গারু (Red Kangaroo)—যাদের উচ্চতা প্রায় দুই মিটার পর্যন্ত হয়। তারা সাধারণত শুকনো প্রান্তরে বাস করে। ধূসর ক্যাঙ্গারু (Grey Kangaroo) কিছুটা ছোট এবং অস্ট্রেলিয়ার বনাঞ্চলে থাকে। এছাড়া আছে গাছ ক্যাঙ্গারু (Tree Kangaroo), যারা গাছে চড়ে চলাফেরা করতে পারে—এরা মূলত নিউগিনি ও উত্তর অস্ট্রেলিয়ার বৃষ্টিঅরণ্যে পাওয়া যায়। প্রতিটি প্রজাতি তাদের পরিবেশের সঙ্গে অসাধারণভাবে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার গরম, শুষ্ক আবহাওয়ায় টিকে থাকার জন্য তারা কম পানিতে বাঁচতে পারে। দিনে প্রচণ্ড গরমে তারা ছায়ায় বিশ্রাম নেয়, রাতে খাবারের সন্ধানে সক্রিয় হয়। তাদের দেহে ঘামের পরিমাণও খুব কম—প্রকৃতি যেন প্রতিটি বিষয় ভেবে তাদের তৈরি করেছে।
ক্যাঙ্গারুর জীবন আমাদের শেখায় ঐক্য, মায়া আর সাহসের গল্প। তারা দলবদ্ধভাবে বাস করে, একে অপরকে সাহায্য করে, আর মা ক্যাঙ্গারুর থলে শেখায় মাতৃত্বের মমতা ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। তাদের শক্তিশালী পা যেন মনে করিয়ে দেয়—জীবনের পথে বাধা আসবেই, কিন্তু সাহস আর শক্তি থাকলে এক লাফেই সেগুলো পার হয়ে যাওয়া যায়। আর তারা কখনো পিছনে হাঁটে না—এই বৈশিষ্ট্য যেন প্রতিটি মানুষের জন্য এক চিরন্তন বার্তা: জীবনে পিছনে নয়, সামনে এগিয়ে যাওয়াই প্রকৃত অগ্রগতি।
তাই ক্যাঙ্গারু শুধু অস্ট্রেলিয়ার প্রান্তরের প্রাণী নয়; সে এক অনুপ্রেরণার প্রতীক, এক শিক্ষার নাম। তার লাফালাফি শুধু বিনোদনের দৃশ্য নয়—তা যেন জীবনের প্রতিটি সংগ্রামের প্রতীক। অস্ট্রেলিয়ার খোলা আকাশে যখন সূর্য ওঠে, আর প্রান্তরের বুকে বাদামি ক্যাঙ্গারুর দল লাফিয়ে লাফিয়ে চলে, তখন মনে হয়—প্রকৃতি নিজেই গাইছে জীবনের গান: “থেমো না, থেমো না কখনো—সামনে যাও, আরও দূরে, আরও উঁচুতে।”