কোনানের রূপকথা

ইয়াছিন আরাফাত »

বাংলাদেশি বাবা, সুইডেনি মায়ের একমাত্র সন্তান কোনান। যৌবন পর্যন্ত বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা সব সুইডেনে। বাবার কাছে রূপকথার গল্পের মতো শোনা, স্বপ্নের কল্পনায় বিচরণ করা। দেশে সে কখনও আসেনি। সে আবার ভীষণ ভ্রমণপিপাসু। কোস্টার হ্যাভেট ন্যাশনাল পার্ক, মাস্ট্রান্ড, মালমো, ইয়াস্টাড, স্টকহোলম আর্কিপেলাগো, উপসালা, সুইডিশ ল্যাপল্যান্ড, গথেনবার্গ, গটল্যান্ড থেকে শুরু করে সুইডেনের সব অলিগলি তার চেনা। নাই কিছু অজানা। একমাত্র ছেলে বলে বাবা-মায়ের আড়াল হওয়া মানা। তবে তার এখনও বাবার জন্মভূমি বাংলাদেশ ভ্রমণ করার সৌভাগ্য হয়ে ওঠেনি। বাবার কথায় এত আগ্রহ তার কখনও জন্মায়নি। কিন্তু সে যখন ফা-হিয়ানের দেখা ভারত, হিউয়েন সাং-এর ভ্রমণবৃত্তান্ত, সিইউকি এবং ইবনে বতুতার ভারত উপমহাদেশ ভ্রমণ বিষয়ক বই পড়ল তখন থেকেই এই দেশ ভ্রমণের ভূত মাথা থেকে যাচ্ছে না তার। ছেলে কোনানের পাগলামিতে অতিষ্ঠ হয়ে মায়ের কথায় বাবা বাংলাদেশ ভ্রমণের জন্য রাজি হলেন। কিন্তু বাবা মুখে এ দেশের নাম করলেও কখনও ছেলেকে বলতে পারেননি, একদিন মুখে অসহায়ত্বের ছাপ নিয়ে এই দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। যথেষ্ট মেধাবী এবং যোগ্যতাসম্পন্ন হওয়ার পরও রাজনৈতিক অনৈতিকতার প্রসার, জবাবদিহি, কাজের স্বচ্ছতার অভাবের কারণে বারবার যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পেতে ব্যর্থ হয়ে সেই বিশ বছর আগে সুইডেনে পা রাখার পর দেশের মায়া থাকলেও কখনও দেশে ফেরা হয়নি। দেশে ফেরার তাড়াও ছিল না। কারণ ছোটোবেলায় বাবা-মাকে হারিয়েছেন। বড় দুভাইয়ের হাতেই মানুষ। ছোটোবোনের বিয়ে হয়ে গেছে। কোনানের মা এত কিছু জানে না। সেই শুধু জানে, তার ভালোবাসাই কখনও তার স্বামীকে দেশে ফিরতে দেয়নি। প্রথম দেখায় ভালোবাসা, সর্বশেষ দুজন দুজনের প্রেমে পড়ার মাধ্যমে বিয়ে।
দেশে ফিরে প্রথমেই গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামে চলে যায় তারা। কোনানের বাবা আতিফের বড় ভাইদের সহজ-সরল মন, আতিথেয়তা এবং তাদের নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় কোনান ও তার মা এলিনা খুশি হয়ে বাংলাদেশে বসবাস করার সিদ্ধান্ত নেন। যে-কথা সেই কাজ, কোনানকে উচ্চশিক্ষার জন্য দেশ সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেওয়া হয়। কোনানের বাবা আতিফের উচ্চমানের গবেষণা থাকার পরও আগের মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির সুযোগ না পেয়ে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি নেন। দেশের প্রতি আতিফের ভালোবাসা ও স্ত্রী-সন্তানের ইচ্ছেকে সম্মান জানিয়ে নিজের স্বাধীন দেশে পরাধীনের মতো থাকা। কোনানের বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা শেষের দিকে। এর মধ্যে এই ভ্রমণপিপাসু মানুষটির দেশের বিখ্যাত ও প্রায় সব দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ করা শেষ হয়েছে।
সে কিছুদিন আগে সিলেট চা বাগানে ঘুরতে গিয়েছিল। পাহাড়ের উঁচুনিচু বিশাল জায়গাজুড়ে পরিকল্পিতভাবে সাজানো চা বাগান দেখে সে মুগ্ধ হয়। চা শ্রমিকদের চা পাতা সংগ্রহ ও চা বাগান দেখতে আসা মানুষদের সাথে তাদের সৌহার্দপূর্ণ আচরণ আরও বেশি মুগ্ধ করে। কোনান গল্পপ্রিয় মানুষ, গল্প করতেও পছন্দ করে। কোনান ঘুরে ঘুরে চা বাগান দেখছিল আর কয়েকজন চা শ্রমিকের সাথে কথা বলছিল। এই চা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। তাদের এমন কথা শুনে, শ্রমিকদের উচ্চবেতন ও উন্নত জীবনযাপন করার কথা মনে হলো। কিন্তু তাদের চেহারায় দরিদ্রতার ছাপ। দেশের সাধারণ শ্রমিকদের বেতন যেখানে এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা, সেখানে যারা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে তাদের সবার বেতন একশ থেকে দেড়শ টাকা শুনে অবাক হল কোনান। সেখানে তিনদিন থাকার পর দশটার ট্রেনে করে সিলেট থেকে ঢাকার পথে রওনা দিল। কিছুক্ষণ পর একটা মলিন প্যান্ট, গায়ে কাপড় নেই, খালি পায়ে এক শিশু পত্রিকা নিয়ে ট্রেনযাত্রীদের ধারে-ধারে পত্রিকা বিক্রির চেষ্টা করছিল। দেখে মনে হলো, আট থেকে দশ বছরের বেশি বয়স হবে না। এক এক করে কোনানের কাছে পত্রিকা নিয়ে হাজির হয়ে বলল, স্যার, সকালে কিছু খাই নাই, একটা পত্রিকা নেন? কোনান হাতে পত্রিকা নিয়ে জিজ্ঞেস করল, বাড়ি কোথায়?
স্যার আমাগো আবার বাড়ি, যেখানে রাইত, সেখানেই কাইত।
তোমার আব্বু-আম্মু কোথায়?
সে বলল, জানি না স্যার। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে ট্রেন স্টেশনে আছি।
কোনান ছেলেটিকে পত্রিকার দামের চেয়ে বেশি টাকা দিয়ে পত্রিকায় চোখ বুলাতে থাকে। এক মন্ত্রী দেশের হাজার কোটি টাকা লুট করে আমেরিকার মতো শহরের দেশে একশটার বেশি বড় বড় দালান তৈরি করেছে, সাথে কয়েকটি গাড়ি আছে। এসব দুর্নীতি, ঘুস, লুটপাট করা বিদেশে বসবাসরত মানুষের সংখ্যা কম নয়। এর আগেও এক ব্যবসায়ী দেশের হাজার কোটি টাকা লুট করে সিঙ্গাপুরে স্থায়ী বসবাস শুরু করেছে। এ রকম লুটপাট করা মানুষের সংখ্যা এ দেশে অগণিত। পোশাকশিল্প বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানিমুখী শিল্পখাত। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ ভাগ এই শিল্পখাত থেকেই আসে। এই তো কিছুদিন আগেও দেশের পোশাক-শ্রমিকেরা বেতন বৃদ্ধি ও বকেয়া টাকা প্রাপ্তির দাবিতে সারাদেশে আন্দোলন করেছে। এ দেশের মধ্যে এভাবে গরিবদের মেরে উন্নয়ন হয়। আর সেই উন্নয়নে দেশের ধনীরা আরো ধনী, গরিবরা আরো গরিব হয়। এই পাঁচ-ছয় বছরে কোনান এসব দেখতে দেখতে অভ্যস্ত, আবার অতিষ্ঠও কম নয়।
এক ঘণ্টা পর এক ভদ্রলোক টিটিই আসেন গায়ে এপ্রোন, সাথে এক সহকারী ও দুই পুলিশ টিকিট চেক করছিলেন। আর যাদের টিকিট নাই তাদের থেকে জরিমানা না করে যার থেকে যা পাচ্ছে তা পকেটে ঢুকাচ্ছে। এজন্যই হয়তো এই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ট্রেন থেকে সরকার কখনও ক্ষতি ছাড়া লাভের মুখ দেখেনি। বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিংয়ে এক হাজারের ভিতরেও দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় না থাকলেও সেশনজট, ছাত্ররাজনীতি, শিক্ষক রাজনীতিতে লাল দল, নীল দল, হলুদ দলের ছড়াছড়ি। অভাব শুধু সঠিক গবেষণা, বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে যুগ-উপযোগী শিক্ষাদান। এজন্যই কোনানের অনার্স শেষ করতেই ছয় বছর লেগে গেছে। যেখানে অনার্স চার বছরের জায়গায় সাড়ে তিন বছরে শেষ করা হয় সেখানে ছয় বছর এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চির সবুজ বাংলাদেশ। এদেশে রয়েছে অসংখ্য দর্শনীয় স্থান। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ এই সৌন্দর্য দেখতে ছুটে আসে। কোনানের প্রিয় দর্শনীয় স্থানগুলো হচ্ছে- সেন্টমার্টিন, কক্সবাজার, সুন্দরবন, সাজেক, রাতারগুল, জাফলং, নাফাকুম, নিঝুম দ্বীপ, টাঙ্গুয়ার হাওর, বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, কুয়াকাটা।
কোনান অনার্সের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে চতুর্থবারের মতো চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার ভ্রমণের উদ্দেশ্যে পাঁচটি টিকিট কাটল। একটা নিজের জন্য। বাকি চারটা দুই বন্ধুর জন্য আর বাকি দুইটা চাচাতো ভাইয়ের জন্য। যাওয়ার পথে প্রত্যেকে তাদের অবস্থার কথা বলছিলেন। কোনানের ছোটো চাচাতো ভাই তাকিব বলল, কোন্ দেশে বসবাস করছি ভাই? কোনান বলল, কেন কি হয়েছে? আরে ভাই কিছুদিন আগে পুলিশের কনস্টেবল পদে চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলাম কিন্তু দুদিনের ভিতরে সাত লক্ষ টাকা দিতে না পারায় চাকরিটা হাতছাড়া হয়ে গেল। বাস কয়েক ঘন্টা চলার পর টিকিট ছাড়া কয়েকজন মানুষ উঠিয়ে নিয়েছে। এর হিসাব কোম্পানিকে দেওয়া হবে না। কোনানের বন্ধু জাহিদ বলল, কিছুদিন আগে ছেলের জন্মসনদ ওঠানোর জন্য ইউনিয়ন পরিষদে গিয়েছিলাম। দেখলাম, বিশ-ত্রিশ টাকার কাজে অনেক গরিব মানুষ থেকে হাজার-দুহাজার টাকা করে নিচ্ছে। প্রতিবাদ করার কোথাও কেউ নেই। যে টাকা বেশি দেয়, তার কাজ আগে করে দেয়। শুধু এটা বলে কথা না, এখানে চাকরি দেয়া হয় ঘুস দিয়ে। সরকারি কাজও হয় ঘুস দিয়ে। সরকারি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্যারেরা ক্লাস নেন নিজের ইচ্ছেমতো। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সকালের ক্লাস বিকালে, অনেক সময় সকালে ক্লাস শিডিউল দিয়ে সারাদিন ক্লাস নেয় না। কোনানের আরেক বন্ধু শামীম বলল, কি আর বলব ভাই, এই পর্যন্ত সাতবার বিভিন্ন সরকারি চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি। কিন্তু খবর নিয়ে দেখেছে, আমাদের পরিবার বিরোধীদল করে তাই এখন পর্যন্ত কোনো সরকারি চাকরি পাইনি। কোনানের চাচাতো ভাই আরিফ উচ্চশিক্ষার জন্য জার্মানি চলে যাবে। দেশে যোগ্যতা অনুযায়ী যথাযথ সম্মান না পাওয়ায় আরিফের মতো লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য ইউরোপ-আমেরিকা চলে যাচ্ছে। এটা নিয়ে সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই। দেশের মধ্যে অনলাইন জুয়খেলার মাধ্যমে দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে এবং দেশের জনগণের টাকায় বিত্তশালীরা বিদেশে বাড়ি কিনছে। মুদ্রাস্ফীতির কারণে পণ্যসামগ্রীর দাম বেড়ে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি ভাই-ভাই হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সিন্ডিকেট তো আছেই। যার ফলে গরিব মানুষ না খেয়ে মরে যাচ্ছে। এই দেশের মানুষ ধর্মকে ইচ্ছেমতো, পছন্দ মতো পালন করছে, আর বাদও দিচ্ছে। কাফের, ইহুদিরা মুসলমানকে মুসলমানের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে ফায়দা নিচ্ছে কিন্তু এ বোকা জাতি কিছু বুঝতে পারছে না। দুনিয়ায় সামান্য টাকা, অর্থসম্পদ, চাকরির লোভে নিজের অজান্তেই ঈমান বিক্রি করে দিচ্ছে বুঝতেই পারছে না তারা।
অবশেষে কক্সবাজার পৌঁছে দেখে বাসা ভাড়া, গাড়ি ভাড়া, খাওয়া-দাওয়া, সাধারণ জিনিসের দাম অনেক বেশি। পরে বুঝতে বাকি রইল না, এ দেশে বিদেশিদের থেকে সবকিছুর দাম বেশি রাখা হয়। এই দেশের কিছু মানুষ ভালোবাসা দিয়ে ডাকাতি করে। আবার কেউ সরাসরি ডাকাতি করে। ভাই ভাইয়ের রক্ত শুষে খায়। কিন্তু সেটা তার বিরুদ্ধে হলে পছন্দ করে না। পছন্দের কাজ জীবনে কয়টা আর করেছে সব তো অপছন্দই। কোনান সারাদিন পছন্দের কেনাকাটা করার পর বাড়িতে এসে দেখে বেশির ভাগ জিনিসই পছন্দ মতো কেনা হয়নি। জীবন শেষ হয়ে এলেই বুঝতে পারে জীবনে আসলে ভালো কিছু করেনি। কক্সবাজারের মনোমুগ্ধকর পরিবেশেও কেমন জানি আনন্দগুলো নিরামিষ-নিরামিষ লাগছে। তাই কোনান তার দেখাশোনা এসব বিষয় নিয়ে লম্বা একটা লেখা ফেসবুকে পোস্ট করে। কিছুক্ষণের মধ্যে কক্সবাজার হোটেলে এসে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয় এবং দেশদ্রোহী বলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় তাকে। এ রকম কিছু লক্ষ করেই হয়তো ইবনে বতুতা বাংলাকে ‘বুলগাকপুর’ হিসেবে অভিহিত করে গিয়েছিলেন যার অর্থ হল ‘ধনসম্পদের পরিপূর্ণ জাহান্নাম’।