নিজস্ব প্রতিবেদক, খাগড়াছড়ি »
প্রায় প্রতিবছরই টানা চার পাঁচদিনের বৃষ্টিতেই খাগড়াছড়ি শহরজুড়ে বন্যা দেখা দেয়। অপেক্ষাকৃত উঁচু এলাকায় হবার পরও এই পরিস্থিতি ক্রমশ বাড়ছে। অথচ খাগড়াছড়ি শহরটির পাশ দিয়েই বয়ে গেছে চেঙ্গী নদী। যেটির শেষ গন্তব্য মহালছড়ি-নানিয়ার উপজেলা হয়ে কর্নফুলী হ্রদে। শুধু তাই নয়, খাগড়াছড়ি শহরের চারপাশে রয়েছে আরো বেশ কয়েকটি ছড়া ও খাল।
একই অবস্থা পাশের দীঘিনালা উপজেলাতেও। ফি বছর বন্যা, জলাবদ্ধতায় মেরুং-কবাখালী এবং বোয়ালখালী ইউনিয়নের বেশকিছু এলাকার বাসিন্দারা ভুগছেন ভীষণ ভোগান্তিতে।
এবার তো তিন মাসের মধ্যেই চারবার বানের পানিতে ডুবেছে খাগড়াছড়ি শহরসহ সদরের বেশকিছু জায়গা এবং দীঘিনালারও বিস্তীর্ণ এলাকা। কখনো কখনো মাত্র দুই একদিনের ভারী বর্ষণেও খাগড়াছড়ি শহরের আশপাশ চেঙ্গী নদীর উপচেপড়া পানিতে প্লাবিত হবার ঘটনা ঘটছে। অপেক্ষাকৃত নিম্ন আয়ের মানুষরাই মূলত নদী-খালের তীরবর্তী এলাকায় বসতি গড়েন। এর থেকে স্বচ্ছলরাও নানা বাস্তবতায় খাগড়াছড়ি শহরের জলমগ্ন ঝুঁকিতে থাকা এলাকাতেই বসবাস করছেন। প্রতিবছর, কখনো কখনো একবছরেই কয়েকবার বন্যা আর প্লাবনের কবলে পড়ে হারাচ্ছেন সহায়-সম্বল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিগত ২০০৭ সালেই খাগড়াছড়ি শহরে সবচেয়ে বেশি পানি উঠেছিলো। সেই সময় শহরের মূল পয়েন্ট ‘শাপলা চত্বর’-এ কোমরসমান পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। এরপর থেকে প্রায় প্রতিবছরই কমবেশি পানিতে ডুবতেই আছে খাগড়াছড়ি শহর ও শহরতলী।
এর থেকে পরিত্রাণের জন্য সরকারিভাবে খুব বেশি অনুসন্ধান-গবেষণা বা প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার কথা ভাবা হয়েছে এমন কোন তথ্য জেলায় পরিবেশ-প্রকৃতি নিয়ে ভাবুকদের কাছ থেকে তথ্য মেলেনি।
খাগড়াছড়ির সাবেক জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের কাছ থেকে লিখিত পরামর্শ চাওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) এবং পরিবেশকর্মীদের মতামত গ্রহণ করেন।
পরে তিনি বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রলায়সহ সংসদীয় জনপ্রতিনিধিদের অবগত করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা’র তৎপরতায় পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্নফুলী হ্রদসহ তিন পার্বত্য জেলার ছড়া-খাল-নদী ড্রেজিংসহ তীর সংরক্ষণে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। গত দুই অর্থবছরে এই প্রকল্পের আওতায় খাগড়াছড়িতেও কয়েক’শ কোটি টাকার তীর সংরক্ষণকাজ চলমান থাকলেও ড্রেজিং বা খননের দৃশ্য খাগড়াছড়িতে পড়েনি। বরং এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যাপক অনিয়মের কথাই সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দাদের কাছ থেকে শোনা যায়।
যেহেতু এমন একটি প্রকল্প গ্রহণ এবং কোথাও কোথাও বাস্তবায়নের পরও যেহেতু বন্যা বা প্লাবন কমছে না; তাহলে ধরেই নিতে হবে প্রকল্পটি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলেও আদৌ এর থেকে পরিত্রাণ মিলবে কীনা?
পরিবেশ-প্রকৃতি নিয়ে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে সাংবাদিক সমির মল্লিক বলেন, অনেক বছর ধরেই পাহাড়ে বৃক্ষ উজাড় হচ্ছে। মাটিতে লতাপাতার আস্তরণ তৈরি হয়, এমন বনায়ন প্রায় হারিয়ে গেছে। বাণিজ্যিক বনায়নের ফলে পাহাড়ের আজন্ম লালিত বন-জঙ্গল-তৃণলতা-পাতা কিছুই আর নেই। ফলে অল্প বৃষ্টিতেও পাহাড়ের মাটি খসে পড়ছে।
পার্বত্যাঞ্চলে পঁচিশ বছর ধরে উন্নয়ন কর্মকা-ে নেতৃস্থানীয় এনজিও ‘জাবারাং কল্যাণ সমিতি’র নির্বাহী পরিচালক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা মনে করেন, সমতল এবং পাহাড়ের ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। যে পরিমাণ তা সংরক্ষিত আর অশ্রেণীভুক্ত হোক; তার খুব বেশি অবশিষ্ট এখন আর নেই। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বন উজাড়, সেগুনসহ নানাজাতের বাণিজ্যিক বনায়নের ফলে পাহাড় কোথাও ন্যাড়া হয়েছে; আবার কোথাও ভয়াবহ ক্ষয় হয়েছে। এটার বড় কারণ, অপরিকল্পিত ও অদূরদর্শী বনায়ন।
তিনি মনে করেন, পাহাড়ের মাটি ধরে রাখা এবং ক্ষয়রোধের জন্য বিজ্ঞানসম্মত- স্থানীয় ভূ-প্রকৃতি উপযুক্ত বনায়ন খুবই জরুরি। এটি না করে শত-হাজার কোটি টাকা দিয়ে ড্রেজিং এবং তীররক্ষার প্রকল্প দীর্ঘমেয়াদে কোন ফলই দেবে না।
তাঁর বক্তব্য এবং যুক্তির পক্ষে দৃঢ় সমর্থন মেলে খাগড়াছড়ি জেলার বিভাগীয় বন কর্মকর্তার পক্ষ থেকে। বনবিদ মো. ফরিদ মিঞা বলেন, পাহাড়ের বেশিরভাগ অশ্রেণীভূক্ত অঞ্চলেই সেগুনের ব্যাপক আবাদ। দরিদ্র মানুষরা একই জমিতে বাড় বা জুমচাষ করছেন। বনউজাড় তো থেমে নেই। বাড়ছে পাহাড়কাটাও। এসবের কোন একটিকে বাদ দিয়ে মাটিক্ষয় রোধ করা যাবে না। কারণ বৃষ্টির পানি সরাসরি মাটিতে পড়ার কারণে মৃত্তিকাক্ষয় বাড়ছে। আর এই পানিবাহিত মাটি ঝিরি-ঝরনা-ছড়া- খাল হয়ে মাইনী-চেঙ্গীসহ অন্যান্য নদীতে পড়ছে। ফলে বছরকে বছর নদীগুলো গভীরতা কমছে, কমছে পানি ধারণের ক্ষমতাও।
পাহাড়ি এলাকায় হওয়া বন্যাকে মানুষের প্রকৃতিবিনাশী কর্মকা-ের দায় হিসেবে চিহ্নিত করলেও আশার কথা জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড এর খাগড়াছড়ি অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. তানজির সাইফ আহমেদ। তিনি বলেন, যে প্রকল্পটি চলমান আছে; সেটির মাধ্যমে নদীগুলোর চর অপসারণের পাশাপাশি চেঙ্গী ও মাইনী নদীর খনন (ড্রেজিং) কাজ শুরু হবে। এখনকার বন্যা পরিস্থিতিকে অভিজ্ঞতা হিসেবে ধরে নিয়ে পরবর্তী বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা চাওয়া হবে।
খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান জানান, আমার দায়িত্বকালে তিন মাসের মাথায় চার চারবার বন্যা দেখলাম। গতবছরও প্রায় একই রকম পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছি। তাই এই পরিস্থিতি থেকে উৎরে যাবার জন্য জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির মাধ্যমে একটি বিজ্ঞাসম্মত সমীক্ষা চালানোর জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর কাছে একটি লিখিত প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে।