কেন এই আকস্মিক বন্যা?

ফেনীতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা। ছবি: সংগৃহীত

সুপ্রভাত ডেস্ক »

প্রতি মাসের শুরুতে আবহাওয়া অধিদপ্তর ওই মাসের আবহাওয়া পরিস্থিতির দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস দেয়। চলতি মাসের শুরুতে সেই পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল, এ মাসে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর–মধ্যাঞ্চল এবং দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে অতিবৃষ্টির কারণেই এ বন্যা হবে বলে জানানো হয়েছিল। এর মধ্যে এখন উত্তর–মধ্যাঞ্চলের মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলের ফেনী, কুমিল্লা চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে।

সব মিলিয়ে এখন দেশের আট জেলা বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। এসব জেলা হলো ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

উত্তর–পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলের প্রধান সাতটি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মাধ্যমে একটি আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। এসব অঞ্চলে বৃষ্টি শুরু হয় ১৬ আগস্ট থেকেই। আর ১৮ আগস্টে সাগরে সৃষ্টি হওয়া লঘুচাপ স্থলে প্রবেশ করে। পরে বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলে এসে লঘুচাপ প্রবল বৃষ্টিপাত ঘটায়। প্রবল বৃষ্টি হয় বাংলাদেশের দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলের পার্বত্য অববাহিকাসহ উজানে ভারতের ত্রিপুরা অঞ্চলে।

বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে ভারী বৃষ্টিপাত, সাগরের লঘুচাপ এবং সেই সঙ্গে পূর্ণিমার কারণে সাগরের জোয়ার স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ছিল। সেই কারণে বৃষ্টির পানি নামার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে উজানের প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে আমাদের মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলের কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রামের নদীবাহিত নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়।

মৌলভীবাজারের মনু নদের পানি, হবিগঞ্জে খোয়াই নদ, কুমিল্লায় গোমতীর পানি, ফেনীর পরশুরামে মুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

ভারতের ত্রিপুরায় এবং সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের জেলাগুলোয় ভারী বৃষ্টি হয়েছে। ফলে এসব এলাকার নদীর পানি বেড়েছে এবং বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।

এই অঞ্চলে অতীতে বন্যার রেকর্ড আছে। কিন্তু এবার বাংলাদেশের এবং উজানে অন্য বছরে তুলনায় বন্যার তীব্রতা বেড়েছে। কিছু কিছু পয়েন্টে নদীর পানি বৃদ্ধি অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। উদাহরণ হিসেবে খোয়াই নদের কথা বলা যায়। এখানে অন্তত ৬০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ পানি প্রবাহ দেখা গেছে। শুধু বাংলাদেশেই নদীতে পানির রেকর্ড প্রবাহ হয়নি, উজানেও হয়েছে। মনু নদ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ইতিহাসের সর্বোচ্চ স্তরে প্রবাহিত হয়েছে। সব মিলিয়ে এবার বন্যা তীব্র। আর বন্যার মূল কারণ অতিবৃষ্টি। এর সঙ্গে সাগরে লঘুচাপ এবং পূর্ণিমার উপস্থিতি মিলিয়ে বন্যা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। আর পূর্ণিমার কারণে জোয়ারের পানি কমে যাওয়ার প্রবণতা কমে গিয়েছিল।

অতি ভারী বৃষ্টিপাতও বন্যার মূল কারণ। এর সঙ্গে আবার লঘুচাপ, মৌসুমি বায়ু এবং সাগরে জোয়ার—এসব কাজ করেছে।

ভারতের বাঁধের বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে তথ্য আদান–প্রদানের ব্যবস্থা নেই। তবে দুই উজানের পানি প্রবাহের তথ্য আদান–প্রদান অব্যাহত আছে। সেই অনুযায়ী বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে গোমতী নদীর ত্রিপুরার ওমরপুর পয়েন্টের পানির তথ্যসহ সব নদীর তথ্যই বাংলাদেশ পেয়ে থাকে। তবে বাঁধসংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই।

বন্যা বা জলাবদ্ধতা যা–ই হোক, তা নির্ভর করে উজানে কতটুকু বৃষ্টি হচ্ছে তার ওপর। কয়েক দিন ধরে দেখছি উজানে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যে বৃষ্টিপাত, বন্যা পরিস্থিতিতে তার ৮ থেকে ১০ শতাংশ অবদান থাকে। উজানের ভারী বৃষ্টির সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ভারী বৃষ্টির কারণে আমাদের দেশে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

নদী গবেষক শেখ রোকন বলেন, ‘সুনির্দিষ্টভাবে ডম্বুর ও কলসি ড্যাম ও ব্যারাজের গেট খোলার তথ্য জানায়নি। ভারত যেটা জানিয়েছে, সেটা হলো বৃষ্টিপাত ও বন্যার তথ্য। অভিন্ন নদী অববাহিকায় বৃষ্টিপাত ও বন্যার তথ্য পরস্পরকে জানানোর বিষয়ে ভারত ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের চু্ক্তিও রয়েছে। যেমন- ব্রহ্মপুত্রের তথ্য চীন আমাদের জানিয়ে থাকে। আবার আত্রাই বা পুনর্ভবা নদী অববাহিকার দিনাজপুর বা ঠাকুরগাঁওয়ে অতিবর্ষণ বা বন্যা হলে আমরা ভারতকে সতর্ক করি, যাতে করে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর বা দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা প্রস্তুতি নিতে পারে। এ ক্ষেত্রেও ভারত ত্রিপুরায় অতিবৃষ্টিপাত ও বন্যার তথ্য জানিয়েছে। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে ডম্বুর ও কলসি ড্যাম ও ব্যারাজের গেট খোলার তথ্য জানায়নি। ভারতীয় পররাষ্ট্র বা আবহাওয়া দফতরও সেটা দাবি করেনি। এই যে ড্যাম বা ব্যারাজের গেট খোলার তথ্য জানায়নি, সেটাই বন্যাটিকে বিপর্যয়কর করে তুলেছে।’

আগে জানানোর নিয়ম আছে কিনা জানতে চাইলে যৌথ নদী কমিশনের সদস্য ড. মোহাম্মদ আবুল হোসেন বলেন, ‘‘যেকোনও যৌথ নদীর বাঁধ খুলে দেওয়ার আগে জানানোর রীতি আছে। জানায়। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, হাইড্রোপাওয়ারে গেট থাকে না, যেটা খুলে দিতে হবে। এটা ‘স্পিল’ করেছে। তাদের পার্টের লেক পানিতে পূর্ণ হয়ে গেলে অটো স্পিল করে। ভারতের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে তা সত্য। তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিল। এটা খুব ছোট হাইড্রোপাওয়ার, গোমতি নদীর ১২৩ কিলোমিটার উজানে এই হাইড্রোপাওয়ার। হঠাৎ টানা বৃষ্টির কারণে পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হয়েছে। তিন দিন আগে ভারতের যে পূর্বাভাস, তার চেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে।’’

যৌথ কমিশনের সদস্যের বক্তব্য যাচাইযোগ্য উল্লেখ করে শেখ রোকন বলেন, ‘ড্যামের ক্ষেত্রে সেটা হতে পারে, যেমন- ডম্বুর। কিন্তু সেটা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে। বন্যা ও অতি বৃষ্টির ক্ষেত্রে শুধু স্পিল ওভার দিয়ে চলবে না। ফলে ওনার এমন বক্তব্য যাচাইযোগ্য। আর ব্যারাজের ক্ষেত্রে গেট খুলতেই হবে। যেমন মুহুরির কলসি ব্যারাজ।’

 

ফেনীতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা