বিচিত্র কুমার »
একটি ছোট্ট গ্রামে বাস করতেন রমেশ নামে এক কৃষক। তিনি ছিলেন সৎ ও পরিশ্রমী। তার পরিবারে ছিল স্ত্রী, এক ছেলে রাজু এবং একটি পোষা কুকুর টগর। টগর ছিল পরিবারের অংশ, আর সে যেমন চঞ্চল তেমনি বুদ্ধিমান। রমেশ তাকে নিজের সন্তানতুল্য ভালোবাসতেন। প্রতিদিন সকালে রমেশ মাঠে কাজ করতে গেলে টগরও তার সঙ্গে যেত। ক্ষেত পাহারা দেওয়া থেকে শুরু করে রমেশের সঙ্গী হওয়া, সব কাজেই সে ছিল বিশ্বস্ত।
একদিন ভোরে রমেশ জমিতে কাজ করতে বের হয়ে গেলেন। তার স্ত্রী তখন রান্নাঘরে ব্যস্ত, আর ছোট্ট রাজু উঠানে খেলছিল। খেলতে খেলতে সে বাড়ির পাশের পুকুরের দিকে চলে যায়। পুকুরটি ছিল বেশ গভীর। রাজু খেলায় এত মগ্ন ছিল যে, সে খেয়ালই করেনি কখন পুকুরের পাড়ে পৌঁছে গেছে। হঠাৎ পা পিছলে সে পানিতে পড়ে গেল।
পুকুরের পাশে থাকা টগর রাজুকে পানিতে পড়ে যেতে দেখেসাথে সাথেই চিৎকার শুরু করল। সে চারপাশে ছুটোছুটি করল, যেন কাউকে জানাতে পারে যে কিছু একটা অঘটন ঘটেছে। কিন্তু সেখানে কেউ ছিল না। তখন টগর আর সময় নষ্ট না করে পানিতে ঝাঁপ দিল।
রাজু ছোট হওয়ায় সাঁতার জানত না এবং ভয় পেয়ে হাত-পা ছোড়াছুড়ি করছিল। টগর তার কলারে দাঁত দিয়ে ধরে ধীরে ধীরে তাকে তীরের দিকে টেনে আনতে শুরু করল। এদিকে টগরের চিৎকার শুনে রাজুর মা ছুটে এলেন। পুকুরের ধারে এসে তিনি দেখেন, টগর রাজুকে ডাঙায় টেনে তুলতে চেষ্টা করছে। তিনি দৌড়ে গিয়ে রাজুকে তুলে ধরেন। তার চোখে পানি, অথচ টগরকে দেখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করলেন।
রাজুর মা রাজুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। আর টগরকে বারবার আদর করে বললেন, ‘তুই যদি না থাকতি, আমার ছেলেকে বাঁচাতো কে?’ রাজু তখনও ভয়ে কাঁপছে, কিন্তু সে টগরের দিকে তাকিয়ে তার লেজ নাড়ানো দেখে হাসল। যেন সে বুঝতে পেরেছে, টগর তার জীবন বাঁচিয়েছে।
রমেশ যখন বাড়ি ফিরলেন, তখন রাজুর মা তাকে পুরো ঘটনাটি বললেন। শুনে তিনি স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তিনি টগরের গলায় একটি ফুলের মালা পরিয়ে বললেন, ‘টগর, তুই শুধু আমার ক্ষেত পাহারা দিস না, তুই আমাদের পরিবারের প্রাণ। তোর এই ভালোবাসা আর সাহসিকতা আমি কখনো ভুলব না।’
গ্রামের সবাই এই ঘটনার কথা শুনল। তারা টগরের সাহসিকতা আর বিশ্বস্ততার প্রশংসা করতে লাগল। গ্রামের অনেকেই যারা পশুদের তেমন গুরুত্ব দিত না, তারা বুঝল যে পশুরাও মানুষের প্রকৃত বন্ধু হতে পারে। রমেশ বললেন, ‘পশুরা শুধু আমাদের সঙ্গী নয়, তারা আমাদের রক্ষাও করে। তাদের প্রতি আমাদেরও দায়িত্ব রয়েছে।’
টগর সেই দিন থেকে গ্রামের সবার চোখে নায়ক হয়ে উঠল। সে কেবল রমেশের ক্ষেত পাহারা দিত না, গ্রামের যেকোনো বিপদেও তার উপস্থিতি দেখা যেত।
(গল্পটি আমাদের শেখায়, ভালোবাসা আর বিশ্বস্ততা শুধু মানুষের নয়, পশুর মধ্যেও থাকে। তাদের প্রতি আমাদের যত্নশীল হওয়া উচিত, কারণ তাদের নির্ভেজাল ভালোবাসা আমাদের জীবনকে সুন্দর করে তোলে।)