অমল বড়ুয়া
বাংলা গানের একটি বিশিষ্ট ধারা হলো কীর্তন। কীর্তন শব্দটি সংস্কৃত কীর্ত্তি আর অন সহযোগে গঠিত। কীর্ত্তি শব্দের অর্থ বর্ণনা করা আর অন হচ্ছে ভাববাচ্য (কীর্ত্তি+অন =কীর্তন)। কীর্তন শব্দের বিশেষ অর্থ হলো- গুণকথন, গুণগানকরণ, স্তবন। আর এসব অর্থের সাথে বাংলা গানের কীর্তন-এর ভাবের সবিশেষ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। কীর্তন অর্থে আবার সবকিছুর গুণকীর্তন করাকে বুঝায় না। মূলত এর সাথে জড়িয়ে আছে ধর্মগুণ, ভক্তিগীতি, দেবগুণ, ধর্মীয় কীর্তি-গীতি ও ধর্মীয় উপাখ্যান। মূলত কীর্তন হলো ঈশ্বর, দেবদেবীর নাম, গুণাবলি বা কীর্তিকাহিনী সম্বন্ধিত গান। কীর্তন হলো আধ্যাত্মিক ভাবনা থেকে সৃষ্ট লোকসংগীত। অর্থাৎ কীর্তন হলো আধ্যাত্মসংগীত। এই আধ্যাত্মসংগীতকে চারভাগে বিভক্ত করা হয়; যথা- ১. মনোশিক্ষা- সকলের মনকে ইষ্টদেবের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলার জন্যই এই গানগুলি রচিত, গীত এবং শ্রুত হয়; ২. তুক্ষা- শব্দটি এসেছে সম্ভবত তর্ক থেকে। তুক্ষা হলো গায়কদের গানের লড়াই। কীর্তনের জন্য সমবেত হয়ে শ্রেষ্ঠত্ব জাহিরের জন্য দুই দলের গানের লড়াইকেই তুক্ষা গান বলে। ৩. দেহতত্ত্ব- দেহতত্ত্বের গানে দেহের মধ্যেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অস্তিত্ব কল্পনা করা হয়। হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, নাথপন্থ, সহজিয়া বৈষ্ণবধর্ম, সুফি ও বাউল সম্প্রদায়ের মধ্যে দেহতত্ত্ব একটি বিশিষ্টস্থান অধিকার করে আছে। হিন্দুতন্ত্রে দেহের বিভিন্ন চক্র এবং বৌদ্ধতন্ত্রে দেহের ভেতরের বিভিন্ন কায়-এর কল্পনা করা হয়েছে। সাধনার পথে এই সকল চক্র এবং কায়-এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে; ও ৪. কীর্ত্তনিয়ার গান বা মড়াবাড়ির গান- মৃতদেহ বাড়ি থেকে শ্মশানে নিয়ে যাবার সময়ে, দাহকালে কীর্ত্তনিয়া নামধারী বিশেষ গায়ক একধরনের আধ্যাত্মিক সংগীত পরিবেশন করে। এই গানকে কীর্ত্তনিয়ার গান বা মড়াবাড়ির গান বলা হয়। বৈদিক ঐতিহ্যের শিকড় কীর্তন হল গান বা জপ, যেখানে একাধিক গায়ক কিংবদন্তি আবৃত্তি বা বর্ণনা করে, অথবা কোনো দেবতার প্রতি প্রেমপূর্ণ ভক্তি প্রকাশ করে, অথবা আধ্যাত্মিক ধারণা নিয়ে আলোচনা করে।
কীর্তনের উৎপত্তি কখন
ভারতীয় সংগীতের ইতিহাস সুপ্রাচীন। আর প্রাচীন সমাজে গানের ধরন ছিল দুইটি। ধর্মীয় ও সামাজিক বা লৌকিক। ভারত উপমহাদেশেও গানের প্রথম ধরনÑ ধর্মীয় সংগীত ছিল লোকাচারের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বৈদিক যুগের (খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দ) বৈদিকযজ্ঞে ধর্মীয় সংগীত ছিল উপাসনার প্রধান উপকরণ। দ্রাবিড় সভ্যতার ধর্মীয় সংগীত থেকে এ যুগে ত্রিস্বরবিশিষ্ট সামগান সৃষ্টি হয়। এগুলো ছিল প্রার্থনার স্তোত্রধ্বনি বা সংগীত, যা থেকে ভারতীয় সংগীতের উৎপত্তি বলে মনে করেন তাত্ত্বিকেরা।
ম্যাক্সমূলার-এর মতে, ভারতীয় সংগীতের উৎস যে সামবেদ, তার রচনাকাল কমপক্ষে ১২০০ থেকে ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। মহেঞ্জোদারো (সিন্ধু) ও হরপ্পা (পাঞ্জাব) খনন করে সিন্ধু সভ্যতার যে নিদর্শন পাওয়া গেছে, তাতেও সংগীতের বিভিন্ন উপাদান মৃদঙ্গ, বেণু বা সাতটি ছিদ্রযুক্ত বাঁশি, তন্ত্রীযুক্ত বীণা ও চামড়ার বিভিন্ন প্রকারের বাদ্যযন্ত্র প্রভৃতি এতদঞ্চলে সংগীতের প্রাচীনত্বকে প্রমাণ করে। সিন্দু সভ্যতার সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দ বলে অনুমান করা হয়। আর সামগানের সংগীতিক ঐতিহ্য থেকে রূপ নেয় গান্ধর্ব সংগীত। গান্ধর্ব সংগীত ছিলো ধর্মীয় সংগীত- ঈশ্বরস্তুতি এর উপজীব্য হওয়ায় কথার বা লিরিকের বৈচিত্র্য ও প্রয়োগ কম। বৌদ্ধযুগে খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দে ব্রাহ্মণ্য ঐতিহ্যবাহী গান্ধর্ব সংগীতের অবলুপ্তি ঘটতে থাকে এবং লৌকিক গান প্রাধান্য পায় এবং এর একটি অংশ আভিজাত্য পায়। বেদ ও ব্রাহ্মণবিরোধী এবং সংস্কৃতভাষা বিরোধী বৌদ্ধরা দেশীয় ভাষা-কৃষ্টিকে সম্মান জানিয়ে দেশি রাগ-সংগীতকে বিকশিত করে, যার থেকে সৃষ্টি হয় দেশি আঞ্চলিক ও পল্লিগান। বিকশিত হয় ধর্মীয় ভক্তিগীতিরও। খ্রিস্ট পূর্বাব্দ যুগ থেকে পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত বাংলায় প্রচলিত রাগাশ্রিত গানকে একত্রে ‘প্রবন্ধ’ বলা হতো। বর্তমানের ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল ইত্যাদির মতো এগুলোর নির্দিষ্ট কোনো শৈলী ছিল না। বলা আবশ্যক যে, বাংলা ভাষার সাহিত্য ও সংগীতের প্রথম প্রামাণিক নিদর্শন ‘চর্যাপদ’। বিপ্রকীর্ণ শ্রেণির ‘প্রবন্ধগীত’ চর্যাপদগুলোতে বাংলা গানের মূল নিহিত আছে। এগুলো ছিল বৌদ্ধদের উপাসনাগীত। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, ‘চর্য্যাপদগুলি সহজিয়া মতের বাঙ্গালা গান।’ এবং এগুলো বৈষ্ণবদের কীর্তনের মতোই গীত হতো। সেকালেও সংকীর্তন ছিল এবং কীর্তনের গানগুলিকেই পদ বলিত। তবে এখনকার কীর্তনের পদকে শুধু পদ বলে, তখন চর্য্যাপদ বলিত। অতীন্দ্র মজুমদার বলেন- ‘চর্যাপদগুলিই বাঙলা কীর্তনের প্রাচীনতম নিদর্শন।’ ফলে বলা যায়, বাংলা কীর্তনের উৎপত্তির মূল শিকড় প্রোথিত রয়েছে বৌদ্ধসাধকদের রচিত চর্যাগীতিতে। চর্যাপদ হলো বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের সাধনসংগীত। প্রাচীন আলংকারিকেরা মনে করেন, চর্যাযুগ থেকে প্রবন্ধগীতির মধ্য দিয়ে কীর্তনের প্রকাশ ঘটেছে।
কীর্তনের ক্রমবিকাশ
চর্যাপদ রচিত হয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে। চর্যাপদে গানের সংখ্যা ৫১টি। চর্যাপদে সঙ্গীতের অঙ্গ ছয়টি। চর্যাপদগুলোর শিরোদেশে পটমঞ্জরী, গড়া, গবড়া, অরু, গুর্জরী, দেবক্রী, দেশাখ, কামোদ, ধনসী, রামক্রী, ভৈরবী, গউড়া, বরাড়ী, গুঞ্জরী, শররী, বলাড্ডি, মল্লারী, মালশী, মালসী গবুড়া, কহ্নু গুঞ্জরী, বঙ্গাল, শবরী ইত্যাদি রাগের উল্লেখ পাওয়া যায়। চর্যাপদের বাদ্যযন্ত্র ছিল পটহ, মাদল, ডমরু, বীণা, একতারা। রাজা লক্ষণ সেনের রাজত্বকালে (১১১৭-১১৯৯) তাঁর সভাকবি জয়দেব-এর সংস্কৃত ভাষায় রচিত ‘শ্রীগীতগোবিন্দম’ নামক গানও ছিল প্রবন্ধ। গীতগোবিন্দের গায়নের দুটি ধারা প্রচলিত ছিল- ধ্রুপদি ধারা ও কীর্তনাঙ্গ ধারা। গীতগোবিন্দের সাথে বাংলা গানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। আদি মধ্যযুগের একমাত্র সাহিত্য নিদর্শন চর্তুদশ শতকে বড়ু চণ্ডীদাস রচিত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’Ñ যেটি চর্যাপদের পর বাংলা গানের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য। এতে মোট গান বা পদের সংখ্যা ৪১৮টি আর রাগ-রাগিণী রয়েছে মোট ৩২টি। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বিষয় ও গঠন- কাব্যের উভয়দিক থেকে ‘গীতগোবিন্দের’ প্রভাব প্রচুর। তাছাড়া ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’ ব্যবহৃত অনেক রাগ ‘চর্যাপদ’ ও ‘গীতগোবিন্দ’ থেকে নেয়া। পরবর্তীকালে জয়দেবের রচিত ‘গীতগোবিন্দ’-এর অনুপ্রেরণায় সৃষ্টি হয় বৈষ্ণবীয় সংগীতধারার। এ ধারা থেকে বাংলাদেশে এক নতুন সংগীতধারার আবির্ভাব ঘটে, যার নাম- পদাবলী ধারা। মধ্যযুগের বাংলা গানের ধারায় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সংযোজন হলো বৈষ্ণব পদাবলী। এই পদাবলীর বিশিষ্ট পদকর্তারা হলেন- চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি ও জ্ঞানদাস প্রমূখ। মুসলমান পদকর্তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন শেখ ফয়জুল্লাহ সৈয়দ মুর্তজা। আর এই পদাবলী থেকে জন্ম হয় ‘কীর্তন’ নামক সংগীতধারার। তুর্কী বিজয়পূর্ব বাঙালির সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে পরিবর্তন সূচিত হয়। সংগীতও নুতন সৃজনে উর্বর হয়ে ওঠে। আরব ও পারসিক প্রভাবে উত্তর ভারতীয় সংগীতেও রূপান্তর ঘটে। এই যুগে পেশাদার সংগীতের কদর ও জনপ্রিয়তার ফলে প্রাচীন হিন্দু সংগীত কতকটা লুপ্ত, বিবর্তিত ও পরিবর্তিত হয়ে হিন্দুস্থানি সংগীতে পরিণত হয়। বাংলা সংগীতের বিকাশে এর প্রভাব অনস্বীকার্য। বহিরাগত উপাদানকে আঞ্চলিক ভাব গভীরতার সঙ্গে সমন্বিত করে আত্তীকরণের দ্বারা গড়ে উঠেছে বাংলা নিজস্ব গায়নরীতি- ‘কীর্তন’। এর দুটি ধারা- শ্রীচৈতন্য-পূর্ববর্তী ও শ্রীচৈতন্য-পরবর্তী। চৈতন্য-পূর্ববর্তী ধারায় রয়েছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাসের পদসমূহ। চৈতন্য-পরবর্তী সময়ে পদাবলী-কীর্তন, পালাকীর্তন, নগরকীর্তন ও নামকীর্তন। ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে শ্রীনরোত্তম দাস আহুত খেতুরী মহোৎসবে কীর্তনের চারটি ঘরানার সৃষ্টি হয়- মনোহরশাহী, গরানহাটী, রেনেটি ও মান্দারনী। ঝাড়খণ্ডী নামে পঞ্চম আর একটি ঘরানারও উল্লেখ পাওয়া যায়। চর্তুদশ থেকে ষোড়শ শতক এই তিন শত বছর ভারতে ভক্তিধর্মের জোয়ারের ফলে ভজনকীর্তন সারাভারতে ছড়িয়ে পড়ে ও জনপ্রিয়তা লাভ করে। শ্রীচৈতন্য (১৪৮৬-১৫৩৩) কীর্তনের জনকরূপে কথিত হন। যদিও শ্রীচৈতন্য’র প্রভাবে কীর্তন সংগীতের গভীর সূত্রপাত, তবে এর সুবর্ণযুগ রচিত হয় তাঁর তিরোধানের পর।
কীর্তনের বিভিন্ন বিষয়
কীর্তনকারী ব্যক্তি কীর্তনকার বা কীর্তনীয়া নামে পরিচিত। কীর্তন পরিবশেনায় ব্যবহৃত জনপ্রিয় বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে রয়েছে হারমোনিয়াম, বীণা বা একতারা, তবলা, মৃদঙ্গ বা পাখোয়াজ, বাঁশি এবং করতাল বা তালাস। কীর্তন মূলত হিন্দুধর্ম, বৈষ্ণব ভক্তিবাদ, শিখধর্ম, সন্ত ঐতিহ্য ও বৌদ্ধধর্মে সমধিক অনুশীলিত ও পরিবেশিত হয়। কীর্তনের সাথে মাঝে মাঝে গল্প বলা এবং অভিনয় করা হয়। কীর্তনের বৈদিক শিকড় রয়েছে। কীর্তনের মূল হল কীর্ত। মূলটি সংহিতা, ব্রাহ্মণ এবং অন্যান্য বৈদিক সাহিত্যের পাশাপাশি বেদাঙ্গ ও সূত্র সাহিত্যে পাওয়া যায়। সাধারণ লোকের পক্ষে অতি সহজে ঈশ্বর সাধনার একটি উপায় হিসেবে এর উদ্ভব। গানের মাধ্যমে ধর্মচর্চার এ ধারা প্রাচীনকাল থেকেই এদেশে চলে আসছে।
কীর্তনে প্রকৃতিভেদে বিভিন্ন ধরনের তাল ব্যবহার করা হয়। যেমন- কাহারবা, দাদরা, একতাল, ছোট-লোফা, বড়-লোফা, রূপক, যৎ, তেওড়া, দোঠুকী, মধ্যম-দশকোশী, দশকোশী, দাশপেড়ে, শশীশেখর, বীরবিক্রম ইত্যাদি। রাগের ওপর কীর্তনগান নিবদ্ধ হতে দেখা যায়। এই রাগগুলো হলো- তোড়ি, কামোদ, শ্রীরাগ, পাহাড়ী, পটমঞ্জরী ইত্যাদি। কীর্তনের রসসংখ্যা ৬৪টি। কীর্তনের অঙ্গ পাঁচটি। এই গুলো হলো ১. কথা : কীর্তনের বাণীকে সাধারণভাবে ‘কথা’ বলা হয়। কথা হলো লীলা-কীর্তনের ভিত্তি। এই কারণে কথা-কে অনেক সময় মূল কীর্তন বলা হয়। ২. দোঁহা : কীর্তনের এই অঙ্গে কীর্তনের বিষয়কে আবৃত্তি করা হয়। এর ভিতর দিয়ে কীর্তনে বৈচিত্র্য প্রকাশ পায় এবং দীর্ঘ সময় ধরে কীর্তন পরিবেশনের সময় শ্রোতা একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পায়। ৩. আখর : কীর্তনের ভাবকে সহজভাবে সুর-তাল সহযোগে ব্যাখ্যা করার একটি প্রক্রিয়া। মূলত কীর্তনিয়া এই অঙ্গে তাঁর নিজের অভিমত ব্যাখ্যা সহযোগে জানিয়ে দেন। এর ভিতর দিয়ে কীর্তনীয়া তাঁর প্রতিভার প্রকাশ ঘটানোর সুযোগ লাভ করেন। ৪. তুক : কীর্তনের কাব্যগীতি অংশ হলো তুক। এই অঙ্গে অনুপ্রাসযুক্ত, ছন্দোময়, অন্ত্যমিলযুক্ত পদ পরিবেষণ করা হয়। ৫. ছুট : কীর্তনের কোনো পদকে সম্পূর্ণ পরিবেশন না করে, ছোটো ছোটো ছন্দে লীলায়িত ভঙ্গিতে উপস্থাপন করা হয়। এই অঙ্গটির মধ্য দিয়ে কীর্তনীয়ার ব্যক্তি পারঙ্গমতা বিশেষভাবে ফুটে ওঠে।
এছাড়া একটি ঐচ্ছিক অঙ্গ কোনো কোনো কীর্তনের আসরে ঝুমুর নামে পরিবেশন করা হয়। এক্ষেত্রে ঝুমুরের চটুল ছন্দে, নেচে নেচে কীর্তন পরিবেশন করা হয়। সাধারণত এই অঙ্গ পরিবেশনের মধ্য দিয়ে কীর্তন পালা শেষ করা হয়। কীর্তনের নানা প্রকরণের ভিতরে লীলাকীর্তন সর্বপ্রাচীন বলে মান্য করা হয়। মূলত বৈষ্ণবেরা রাধাকৃষ্ণের পার্থিব প্রেমকে বিষ্ণু’র লীলা হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। এই লীলাকে গানের ভিতর দিয়ে উপস্থাপনই হলো লীলা কীর্তন। সুর-তালের বৈচিত্র্যের সূত্রে লীলাকীর্তনে যুক্ত হয়েছিল তাল ফেরতা এবং নানাধরনের শাস্ত্রীয় তাল। একতাল, ঝাঁপতালের মতো প্রথাগত শাস্ত্রীয় তালের পাশাপাশি লোফা, দশকোশীর মতো জটিল তালের প্রয়োগ শুরু হয়েছিল এবং এখনও তা চলছে।
পালাকীর্তন : ধারণা করা হয়, বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের আমলেই পালাকীর্তনের ধারাটি প্রবর্তিত হয়েছিল। পালাকীর্তনে কাহিনি রাধাকৃষ্ণের লীলাকে বিভিন্ন পর্বে ভাগ করে গানে গানে পরিবেশন করা হয়। এতে শিল্পীরা গানের পাশাপাশি অভিনয় করে থাকেন।
নামকীর্তন : ১৫১০ খ্রিস্টাব্দের দিকে শ্রীচৈতন্য নামকীর্তন প্রচলন করেছিলেন। শ্রীচৈতন্য তাঁর ভক্তদের নিয়ে নগর পরিক্রমা করতেন। সে সময়ে এই কীর্তনকে বলা হতো ‘নগরকীর্তন’। এই সংকীর্তন বা নগরকীর্তনে ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সুর-সহযোগে আবৃত্তি করার কীর্তনের যে ধারাটি প্রচলিত হয়েছিল, তারই সাধারণ নাম ‘নামকীর্তন’।
কীর্তনের বিভিন্ন ঘরানা
গীতগোবিন্দম্-এর সূত্রে লীলাকীর্তনের যে ধারার সূচনা হয়েছিল, তা চৈতন্যদেবের নামকীর্তনের জোয়ারে ম্লান হয়ে গিয়েছিল। আঞ্চলিকতার প্রভাবে এবং বিভিন্ন কীর্তনীয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন ধারার সৃষ্টি হয়েছিল। খেতুরী মহোৎসবে কীর্তনের চারটি ঘরানার সৃষ্টি হলেও পরবর্তীতে এতে আরও কিছু ঘরানা সংযোজিত হয়। এগুলো হলো গড়ানহাটি, মনোহরশাহী, রেনেটি, মন্দারিণী, ঝাড়খণ্ডী এবং ঢপ।
গড়ানহাটি ধারা : খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে রাজশাহী জেলার গড়েরহাট বা গড়েনহাটি পরগণার পদকর্তা নরোত্তম দাস এই বিশেষ ধরনের কীর্তনের ধারা প্রবর্তন করেন। তবে নদীয়া এবং মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে এই ঘরানার কীর্তনের জনপ্রিয়তা ছিল।
মনোহরশাহী : চৈতন্যদের সমসাময়িককালে বর্ধমান জেলার মনোহরশাহী পরগণার শ্রীখণ্ডে কীর্তনের একটি নতুনধারার প্রবর্তন করেছিলেন জ্ঞানদাস মনোহর। এ ধারাটি ‘মনোহরশাহী’ নামে অভিহিত হয়ে থাকে। এই কীর্তনে খেয়ালের প্রভাব লক্ষ করা যায়। তবে এর সাথে মিশ্রিত হয়েছিল আঞ্চলিক লোকধারার সুর। এর একটি ভিন্নরূপ ছিল। এর নাম ছিল ‘ময়নাডাল’ ঘরানা। তবে এ ঘরানার কীর্তন বর্তমানে শোনা যায় না।
রেনেটি : খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে বর্ধমান জেলার রাণীহাটি পরগণার কীর্তনের এ ধারটি বিকশিত হয়েছিল। এই অঞ্চলের বিপ্রদাস ঘোষ কীর্তনকে টপ্পার মতো করে পরিবেশন করার রীতি প্রচলন করেন। এ ধারাটি রাণীহাটী ধারা হিসেবে প্রথমদিকে প্রচলিত ছিল। পরবর্তী সময় এ নামটি লোকমুখে ‘রেনেটি’ ধারা নামে পরিচিতি লাভ করে।
মন্দারিণী : মন্দারণ অঞ্চলের চর্চিত কীর্তনধারাটি ‘মন্দারিণী’ নামে অভিহিত হয়ে থাকে। বংশীবদন নামক প্রখ্যাত কীর্তনীয়া এই ধারাটির প্রবর্তন করেন। এ গানে ঠুংরির প্রভাব লক্ষ করা গেলেও মূলধরনটি পাঁচালী ও মঙ্গলগানের সুরের মিশ্রণে গড়ে উঠেছিল।
ঝাড়খণ্ডী : ঝাড়খণ্ডে এই কীর্তনের উদ্ভব হয়েছিল বলে ধারাটি ঝাড়খণ্ডী নামে অভিহিত হয়ে থাকে। শ্রীনিবাস আচার্যের শিষ্য গোকুলানন্দ ষোড়শ শতকের শেষে এ কীর্তনধারার প্রবর্তন করেন। চৈতন্যচরিতামৃত ও চৈতন্য ভাগবত গ্রন্থে এই কীর্তনের নাম পাওয়া যায়। এ ধারায় ঝাড়খণ্ড-এর ঘরানার কীর্তনে ঝুমুর গানের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। বর্তমানে এই ধারার কীর্তনের ব্যাপক চল নেই।
ঢপকীর্তন : খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতকে ঢপকীর্তন নামে নতুন একটি ধারার সূচনা হয়। এ ধারার সূচনা হয়েছিল কলকাতায়। এ ধারার গুরু হিসেবে মান্য করা হয় রাধামোহন ঠাকুরকে। গানের মাঝে মাঝে কথকতার ভঙ্গিতে কিছু বাক্য ব্যবহার রীতিও ক্রমে ক্রমে এই কীর্তনের অংশে পরিণত হয়। বৈঠকি আসরে ঢপকীর্তনে অনেক সময় খোলকর্তাল, মন্দিরা, হারমোনিয়াম সহযোগে রাগভিত্তিক সম্মিলিত বাদ্য পরিবেশন হতো। কথকতার নাটকীয়তা, বাদ্যযন্ত্রের অনুসঙ্গ, শিল্পীদের লীলায়িত নৃত্য ইত্যাদি মিলে ঢপকীর্তন গ্রামবাংলায় এক সময় যাত্রাগানের মতো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। ঢপ্কীর্তনে ব্যবহৃত হত লোফা, ঝাঁপ, চঞ্চুপুট, আদ্ধা প্রভৃতি তাল।
মধ্যযুগের শেষে এসে বাংলা গান কীর্তন দ্বারা দুভাবে সমৃদ্ধি লাভ করেছে। এর একটি ধারায় মূল কীর্তনীয়ারা কীর্তনের আদর্শ ধরে রেখে নতুন নতুন কীর্তন সৃষ্টি করেছেন। অন্যধারায় কীর্তনের সুরশৈলী অনুসরণে অন্য ধরনের গান রচনা করেছেন। কীর্তনের সাথে বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও সভ্যতার সুগভীর যোগসূত্র রয়েছে। কীর্তন কেবল বাংলা সংগীতের আদিধারা নয়, ইতিহাস-ঐতিহ্যেরও উর্বর সাক্ষী।