সুভাষ দে »
অপরাধ জগতে কিশোর গ্যাং কালচার প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। অথচ কয়েক বছর আগেও পরিস্থিতি এ রকম ছিল না। তখন কিশোররা সাধারণত চুরি, পকেটকাটা, ছিনতাই এসব ছোটখাট অপরাধ করতো। এখন এই অবস্থা, পরিপ্রেক্ষিতের পরিবর্তন হয়েছে। এখন কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে মাদক, ধর্ষণ, ডাকাতি, খুনের মতো ভয়ংকর সব অপরাধে। অপরাধ জগতে কিশোর গ্যাং কালচার এখন অতি পরিচিত শব্দগুচ্ছ। কিশোর অপরাধীদের শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে আইনগত নমনীয়তা আছে। এই সুযোগটাই নিচ্ছে এই অপরাধজগতের গডফাদাররা। যদিও বলা হচ্ছে কিশোরদের নিয়ন্ত্রণ করে ‘বড় ভাই’রা কিন্তু আমাদের সামগ্রিক রাজনীতি যারা নিয়ন্ত্রণ করেন, তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক অভিলাষ, অর্থবিত্ত মুনাফার প্রতি লোভ, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত প্রভাব প্রতিপত্তি কায়েমে ব্যবহৃত হচ্ছে বড়ো এবং ছোট ভাইয়েরা। এরা সামাজিকভাবে প্রভাবশালী এবং প্রতাপশালী। রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে যদি পরিবর্তন না আসে অর্থাৎ অপরাধ নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি, গোষ্ঠী যারা রাজনীতি ও সমাজকে কলুষিত করছে তাদের বিরুদ্ধে যদি শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলা না যায় তাহলে কিশোর অপরাধ কেন, কোন অপরাধই কমবে না। সমাজবিজ্ঞানী ও গবেষকরা নানাভাবে বিশ্লেষণ করলেও (এই বিশ্লেষণ অনেকটা বিমূর্ত) আসল কারণ যে পুঁজিবাদী ও সামন্ত চেতনাশ্রয়ী বিবরে লালিতÑপালিতÑ সেটির কথা খুব কমই বলছেন। আমাদের সমাজ ও রাজনীতিতে আজ যে অচলায়তন বাসা বেঁধে আছে সেখানে যদি আন্দোলনÑসংগ্রামের ঢেউ না ওঠে তবে সমাজ ও রাজনীতির এ ধরণের কালো অধ্যায়ের অবসান অসম্ভব। আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজে যেভাবে দুর্বৃত্তায়ন, পেশীশক্তি, কালো টাকা ও দখলদারিত্বের মহড়া চলছে, সে অপরাধ জগতে আমাদের কিশোরÑতরুণদের নিক্ষেপ করা হচ্ছে। এসবই ভোগ ও পুঁজিবাদী সমাজের বৈশিষ্ট্য। যে বিশেষ শ্রেণিটি এসব দুষ্কর্মে নিয়োজিত তারা সমাজের অতি ক্ষুদ্র অংশ অথচ তাদের হাতে রাজনীতি আর সমাজ নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি। এ বলয় ভাঙতে না পারলে আমাদের শিশুÑকিশোরÑতরুণদের রক্ষা করা যাবে না। সমগ্র সমাজকে পচনে ডুবিয়ে দিতে অপরাধ জগতের গডফাদাররা নীলনকশা আঁকছে প্রতিনিয়ত। কারা মাদকের কারবারি, নিশ্চয়ই শিশু কিশোররা নয়, খুনে তারা কিভাবে জড়িত হলো, কারা তাদের নামিয়েছে এই পথে, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, ইভটিজিং করে কাদের আশ্রয়ে কিশোর অপরাধীরা পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছেÑএসব বিষয়ে খোঁজ না নিলে, অপরাধজগতের গভীরের শেকড় উপড়ে ফেলতে না পারলে আমাদের কিশোরÑতরুণদের বাঁচানো যাবে না।
২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আদনান খুন হওয়ার পর ঢাকায় কিশোর গ্যাংয়ের অস্তিত্বের বিষয়টি উঠে আসে। এ কয় বছরে সারা দেশে কিশোর গ্যাং ছড়িয়ে পড়েছে। এই গ্যাংয়ের সদস্যরা নারকীয় সব অপরাধে জড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি প্রতিপক্ষ কিশোর গ্যাং এর সদস্যদের মধ্যে খুন, মারামারি এসবেও জড়িয়ে পড়ার রোমহর্ষক কাহিনী প্রতিনিয়ত সংবাদ মাধ্যমে আসছে। সহপাঠী, বন্ধুরাও খুন হচ্ছে এদের হাতে।
এখন পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে পরিবার, সমাজ অসহায় হয়ে পড়েছে। পাড়ায় কিংবা মহল্লায়, কিশোররা বড় ভাইদের ছায়ায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণ কিংবা সামাজিক সুস্থিরতা নিশ্চিতে আগে জনপ্রতিনিধিদের যে ভূমিকা ছিলো, এখন তা নেই। আমি মনে করি জনপ্রতিনিধিদের কাজ ও ভূমিকা নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিত। সরকারি দলের কিছু নেতার পৃষ্ঠপোষকতায় এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ের অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে দেশে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে। অবৈধ অর্থ, বিলাসবহুল জীবন যাপন, সামান্য চাকরি থেকে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়ার কাহিনী এখন বেরিয়ে আসছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রেফতার অভিযানে এসব জানা যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলাবাহিনী, সরকারি দফতরের লোকজন এতদিন কিছুই জানেনি কী আশ্চর্য! দুর্নীতিবাজ, অপরাধ জগতের লোকজন যারা মিশে গেছে ক্ষমতাসীন দলে, তাদের ব্যাপারে জেলাÑকেন্দ্রীয় নেতারা কিছুই জানতেন না, এটি বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। অপরাধ জগতের এসব লোকেরাই কিশোরÑতরুণদের সর্বনাশের পথে ঠেলে দিচ্ছে। ছোট ভাই, বড় ভাই, গডফাদার সকলে মিলে জাতির ভবিষ্যৎ বংশধরদের অন্ধকার জগতে নিক্ষেপ করছে। এখানে যদি রাজনীতির পরিবর্তন না ঘটে, উপর থেকে যদি শুদ্ধি অভিযান না চলে, প্রশাসনে যদি দুর্নীতিবাজ আমলা কর্মচারীদের প্রাধান্য থাকে তবে জাতীয় উন্নয়ন অগ্রগতির সুফল কিভাবে পাবে জনগণ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমএ মোমেন সম্প্রতি বলেছেন, আমলারাও বিদেশে অর্থপাচার করছেন। স্বাস্থ্য বিভাগের সাধারণ এক কর্মচারী শত শত কোটি টাকার মালিক বনে গেলেন, সামান্য বিক্রয়কর্মী মনির হোসেন গোল্ডেন মুনিরে পরিণত হলেন। তার বাসায় অভিযান চালানো র্যাব বলছে, রাজউকের কিছু দুর্নীতিবাজ লোকের সাথে যুক্ত হয়ে মুনিরের প্লট ব্যবসা জমজমাট হয়েছে। স¤্রাট, ডিকে শামীম, শাহেদ, ইরফান কাদের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে বটবৃক্ষ হয়ে গেলো। এরাই তো কিশোরÑতরুণদের দেহরক্ষী রাখে, অপরাধে নানাভাবে কাজে লাগায়। এজন্য শহরÑগ্রামে কিশোরদের টাকার লোভ, রাজনৈতিক দলে জায়গা করে দেওয়ার লোভ, সচ্ছলভাবে জীবনÑযাপনের লোভÑএসব টোপ দিয়ে দলে ভেড়ায় এই দুষ্টচক্র। সেই সাথে তাদের নানা বদঅভ্যাসে যেমন নেশায় আসক্ত করা, নারীসঙ্গে লেলিয়ে দেয়া, লেখাপড়া বাদ দিয়ে আড্ডায়, রাজনীতি ও ব্যক্তিগত ফাইফরমাশে জড়িয়ে রাখে। এসবের মাধ্যমে কিশোর তরুণরা ক্রমাগত নীলজগতে ঢুকে যায়। অপরাধ চারদিক হতে তাদের ঘিরে ধরে এবং একদিন সেও জড়িয়ে যায় হারিয়ে যায় প্রিয় কিশোর জগত থেকে, জীবন থেকে।
এতো গেল একদিক। অন্যদিকে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের ভূমিকা কি? কিশোরÑতরুণেরা বয়ঃসন্ধিক্ষণ এবং তারুণ্যের সময় মাÑবাবার শাসনের মধ্যে, তাদের জীবনযাপনের মধ্যে থাকতে অস্বস্তি বোধ করে। অভিভাবকরাও সময়ের ¯্রােতে ভেসে যেতে চায়। পরিবারের জন্য আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য আনতে তাদের অনৈতিকতার আশ্রয়, অনেক পরিবারের অভিভাবকের জীবনযাপনের ধারা, রুচি, বোধ এসবের সাথে মানিয়ে নিতে পারে না। কিশোর তরুণরা তাদের বেশির ভাগ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কোচিং সেন্টারে, আড্ডায় বন্ধুদের সঙ্গে কাটে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘মানব’ হয়ে ওঠার সুযোগ সংকুচিত হয়ে গেছে। এক সময় স্কুলÑ কলেজে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, জাতীয় দিবসগুলি সাড়ম্বরে পালন করা হতো। এখন সে সব নেই। শিক্ষকরা ও পাঠদানের সময় প্রণোদনামূলক বিষয় শিক্ষার্থীদের কাছে উত্থাপন করেন না। পাড়ায় মহল্লায় ক্লাব, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছিলো, এখন এগুলি একেবারেই নেই। আমাদের কিশোরÑতরুণদের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত ঘরের; দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শিশুÑকিশোর জীবনের সকল সুযোগÑঅধিকার থেকে বঞ্চিত।
পরিবার, সমাজ যদি রাষ্ট্রের মৌল নীতির প্রতি অনুগত না হয় অর্থাৎ অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ আর মানবিক চেতনার পরিবার, সমাজ গড়ে না ওঠে তাহলে শিশুÑকিশোররা কোথা থেকে দৃষ্টান্ত পাবে? তদুপরি ইন্টারনেট, ফেসবুকের জগৎ শিশুÑকিশোরদের বহির্মুখি করে তুলছে। তাদের সহজ সরল, জীবনমুখি সাংস্কৃতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার কাজটিতে হাত দিতে হবে।
শিশুÑকিশোরদের অপরাধ জগত থেকে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নয়। এটি অভিভাবক, শিক্ষক, সমাজের সচেতন ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি, ধর্মীয় ব্যক্তিত্বসহ সকলকেই এই দায়িত্ব নিতে হবে। কিশোরদের মনোজগত নিয়ন্ত্রণ এবং তার ইতিবাচক পরিবর্তনে তারা অনেকটা ব্যর্থ, অর্থাৎ সামাজিক নিয়ন্ত্রণ আর সেভাবে কাজ করছে না।
আমাদের রাজনীতি, সরকার পদ্ধতি, প্রশাসনিক কাঠামো, আইনের কার্যকর প্রয়োগ এসব পরিচালনা যাদের হাতে তাদের মনোজগতে কিশোরদের উন্নতির বিষয়টি অনেকাংশে অনুপস্থিত। রাজনীতি যদি কলুষিত হয় সমাজ যদি নানা কুসংস্কার, প্রগতিবিরোধী চেতনায় ডুবে থাকে, রাজনীতি, সমাজ ও প্রশাসনে যদি শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠিত না হয় তবে কিশোরÑতরুণদের সর্বনাশের সিঁড়ি থেকে তুলে আনা অসম্ভব।
লেখক : সাংবাদিক