শোয়েব নাঈম »
কবিতার শরীর থেকে বহিরঙ্গের যে জাঁকজমক তা ঝরিয়ে অন্তরঙ্গের ভাষায় যা-যা অন্বেষণ করেছেন, তাই কবি মুনির আহমদ তাঁর কাব্যভাবনার ‘কাঠের পুতুল’ গ্রন্থে তুলে ধরেছেন। সেই ভাষাই শব্দের আড়ম্বর সরিয়ে বিশুদ্ধবোধ প্রকাশের জন্য যে সীমিত ও নির্ভার শব্দগুলি দরকার, সেই শব্দে সেই ভাষায় মুনির আহমদ তাঁর কবিত্বকে এই কাব্যগ্রন্থে ছড়িয়েছেন। কবিতা তো এক ধরনের উৎপাদন, যা একইসঙ্গে অতিদুরূহ এবং আবার অতিজটিল। কবি মুনির আহমদ-এর ‘কাঠের পুতুল’ কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভূক্ত কবিতাগুলি পাঠের প্রথম ধাপ হচ্ছে— প্রতিটি কবিতার থিম অধ্যয়ন। প্রতিটি কবিতার থিম অধ্যয়নকালে কবিতার লাইনকে ভেঙে ভেঙে, নিবিড়তায় লাইন থেকে শব্দকে আলাদা করে কবিতার লাইনের গভীরতা উপলব্ধি করতে হয়। প্রতিটি শব্দ একটি বার্তা দিতে দিতে কবিতার কেন্দ্রীয় ধারণার দিকে পাঠককে নিয়ে যায়। সেই কেন্দ্রীয় ধারণাতে অবস্থান করে ‘কাঠের পুতুল’ কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভূক্ত প্রতিটি কবিতার থিম। কবিতার পঙ্ক্তিগুলি একটি গল্প বলে বলে কবিতার উৎক্ষেপণ তৈরি করে, যা কবিতার মেজাজকে অনন্য করে। ‘কাঠের পুতুল’ এবং পাঠকের মধ্যে দূরত্বের ব্যবধান কমাতে কবিতার থিম’ই যথাযথভাবে ভূমিকা পালন করে। ‘কাঠের পুতুল’ এর কবিতা উপলব্ধির আরেকটি বিকল্প প্রক্রিয়া হচ্ছে-প্রতিটি কবিতার শিরোনামের সাথে ভিতরের কবিতার যে অংশের অর্থের সম্পর্ক আছে, পাঠককে সেই অংশ থেকে কবিমনস্কতায় সৃজনী অর্থের সূত্রপাত খুঁজে নিতে হয়।
‘কাঠের পুতুল’ এর বাগরীতি হচ্ছে একটি নিজস্ব আলাদা শব্দমহল, যে মহলে আছে কেবল অনুভূতিমূলক বিষয়ের প্রতি তীব্র প্রতিক্রিয়া। মুনির আহমদ-এর কবিতার বাগরীতি প্রচলিত কাব্যসাহিত্যের ভাষাভঙ্গির বিশাল অংশকে একটি অকাট্য সত্যের মতন আঘাত করে। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, যেমন-
‘….পাহাড়ের ওই গভীর ভাঁজে/ শত রূপের নিচে পড়ে/ আছে জীবনের এক কালো/ কোলজে, মাটির নিচে কাঁপে,/ জীবন এখানে খুব চাপা/
পড়ে যায় মাটির গভীরে….’
(কবিতা: পর্বতের বৃদ্ধ লোকটি, পৃষ্ঠা: ৯)
এখানে প্রকৃতির বিশাল অস্তিত্বের উল্লেখ আছে, যেখানে মানুষ নেই, রণহুঙ্কার নেই, দ্বেষ নেই, ষড়যন্ত্র নেই, নেই বৈরিতা, নিষ্ঠুরতা। তবু সেখানেও আরেক ধরণের আতঙ্ক আছে। পর্বতে ভাঁজের কারণে সেখানে আগ্নেয়গিরির মতো ভয়াবহতা দেখা যায়, পর্বতের জীবন জ্বলে জ্বলে জমাটরক্তে কালো হওয়া কলিজার মতো অবিস্মরণীয় কালো কয়লার নজির হয়ে আছে। আবার সেই আগ্নেয়গিরির নিচে অন্য আরেক জীবন চাপা পড়ে আছে। এখানে কবি জীবন থেকে আরেক জীবনে রূপান্তর হয়ে অনন্ত প্রাণের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। এভাবেই ‘কাঠের পুতুল’-এর কবিতা পয়েন্ট-বাই-পয়েন্টের প্রলেপ গড়ে গড়ে পঙ্ক্তিগুলি অত্যুজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
‘ব্যান্ডওয়াগন’ শব্দের অভিধানিক অর্থ হচ্ছে— বাজনাদারদের জন্য গাড়ি বা কামরা। কিন্তু আধুনিক সাহিত্যে ‘ব্যান্ডওয়াগন’ পদ্ধতি হচ্ছে লেখার একটি অনুপ্রেরণামূলক শৈলী, যা পাঠকদের একটি নতুন যুক্তি বোঝাতে বা তাদের নতুন একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি বোঝাতে এই পদাঙ্ক অনুসরণ করা হয়। ‘ব্যান্ডওয়াগন’ এর ক্রমবর্ধমান ব্যবহারের মাধ্যমেই সাহিত্য বা কবিতায় একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গিকে বেশ জনপ্রিয় করে তোলা যায়। কবি মুনির আহমদ অবচেতন মনেই হোক অথবা সহজাত বোধেই হোক, এই পদ্ধতি তাঁর ‘কাঠের পুতুল’ কাব্যগ্রন্থে একটা ফ্রিকোয়েন্সি স্তর পর্যন্ত ব্যবহার করেছেন। সেই উদাহরণ হচ্ছে এরকম-
‘…. চেঁচায় মাতলামির ছলে/ ভিটার কোণের বাঁশঝাড়,/ লাউয়ের মাচা কেঁপে ওঠে/ বুকখোলা এক ভূকম্পনে…’ (কবিতা: মাতাল; পৃষ্ঠা: ১১)
কবি মুনির আহমদ প্রয়োজনের অতিরিক্ত এবং প্রথাগত শব্দ পরিহার করেছেন বলেই এই গ্রন্থের কবিতাগুলি নিরবচ্ছিন্নভাবে তাঁর পরিশীলিত চেতনার উচ্চ-পাহাড়। শব্দ যতই অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত হোক না কেন, এর যৌক্তিক অর্থবহতা হয়ে উঠাই কবিতার জন্য অত্যন্ত আবশ্যিক। তাই কবি অতিরিক্ত শব্দ এবং প্রথা এড়িয়ে কবিতায় লিখেছেন-
‘…. আমার প্রার্থনার করপটে কাঁদছে ভালোবাসা’
(কবিতা: ফকিরি গান: ২; পৃষ্ঠা : ১৪; কাব্যগ্রন্থ: কাঠের পুতুল।) এই পঙ্ক্তিতে শব্দের মেদ কমিয়ে এবং প্রথার অভ্যস্ততা এড়িয়ে কবি মুনির আহমদ পরিশীলিতার সংস্কারে প্রয়োগ করেছেন।
মুনির আহমদ-এর কাব্যশক্তি গত শতকের আশির দশক থেকে একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে এখনও সাহিত্যের সকল পরিসরে যত সাহিত্যিক গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটেছে, সবখানে কবি মুনির আহমদ উপেক্ষিত হয়ে আছেন, তাঁর কাব্যশক্তি এখনও এড়িয়ে-যাওয়া নিরবতার অন্ধকারে আচ্ছাদিত হয়ে আছে, তাঁর সমকালের সারথীরাও তাঁর অনিবার্য অবস্থানকে অবহেলা করে গেছেন। কবি মুনির আহমদ-এর কাব্যসাহিত্যে আবির্ভাব কখনো প্রকাশ্যে প্রবলভাবে অভিনন্দিত হয়নি, হয়তো কারো কারো বিনয়ের অভিনয় থাকলেও অন্তরঙ্গ উদাত্তের অভাব ছিল। ‘কাঠের পুতুল’ প্রথম প্রকাশকালে তিনি যখন তাঁর সমকালের সাহিত্য সারথীদের নিকট সহানুভূতি (ংুসঢ়ধঃযু) নয়, সমানুভূতি (বসঢ়ধঃযু) প্রত্যাশা করেছিলেন তখন কবি মুনির আহমদ ততই আত্মস্বরূপের কাছে বিষণ্ণভাবে ধরা দিয়েছিলেন।
তিনি তখন বেদনাকে অন্ধকারে লুকিয়ে বিশুদ্ধ-মরমী ঐক্যের অনুশীলন করেছেন। আত্মবিব্রত কালের এরকম এক অন্ধকারে ‘কাঠের পুতুল’ প্রায় ত্রিশ বছর পর আবার যখন তাঁর ইচ্ছার সৌজন্যে দ্বিতীয়বার প্রকাশ হতে দেখি— ‘খড়িমাটি’ প্রকাশনী থেকে, তখন চোখধাঁধানো আবিস্কারের মতন অন্ধকারে জোনাকির রাশি রূপে এই কাব্যগ্রন্থকে জ্বলে উঠতে দেখি। তখন শ্রদ্ধার স্নিগ্ধতায় এই প্রত্যাশা জেগে ওঠে যে, যোগ্যতম কবি মুনির আহমদ-কে বহুলপঠিত পরিমণ্ডলের পূর্ণতায় আন্দোলিত হতে দেখার। ‘কাঠের পুতুল’-এর প্রথম প্রকাশ অক্টোবর ১৯৯৫ থেকে দ্বিতীয় প্রকাশ সেপ্টেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত, সময়ের এই অবয়বে দাঁড়িয়ে তীব্রভাবে এখনও উপলব্ধি হয় যে, ‘কাঠের পুতুল’-এ ভাবনার মৌলিকত্ব যেভাবে ঠেসে দিয়েছেন তা থেকে মুনির আহমদ-এর কবিস্বভাব ও তাঁর কাব্যভাষার দীপ্তি একটুও ম্লান হয়নি। কাব্যাদর্শ তাঁকে সম্পূর্ণ নিজের মতো হতে শিখিয়েছে। এই যে ২০২৪-এ এসে তিনি যে আবার ‘কাঠের পুতুল’-এর দ্বিতীয় মুদ্রণ প্রকাশ করেছেন, এ হচ্ছে মহানুভবতা থেকে শুদ্ধ অনুভবে প্রত্যাবর্তন, এর উদ্দিষ্ট আসলে মুনির আহমদ-এর কাব্যব্যক্তিত্বকে পুনর্বিন্যাসের দিকে সঞ্চালন করা। দখড়িমাটি’ থেকে ‘কাঠের পুতুল’-এর এই দ্বিতীয় মুদ্রণ’ই হচ্ছে তাঁর কাব্যব্যক্তিত্বের দৃশ্যমান সম্প্রসারণ। মুনির আহমদ-এর অবিনাশী কাব্যশক্তির সত্যস্বরূপে ‘কাঠের পুতুল’ অমর হয়ে থাকবে। আর মনোযোগী পাঠ নিলে সেই পাঠকের কাছে ‘কাঠের পুতুল’ হচ্ছে- কবিসত্তার নির্ভীক মুক্ত বিহার।