জুয়েল আশরাফ »
অনেক্ষণ হলো সম্রাটের পেসাবের বেগ পেয়েছে। তলপেটে ভারী ব্যথা হচ্ছে। সকাল থেকে বাথরুমে যাওয়া হয়নি। গতরাতের খাবার পানি তলপেটে আটকে রয়েছে। বাথরুমে না যাওয়া পর্যন্ত স্বস্তি নেই। সম্রাট মুখ কুঁচকে রেখেছে। নাকের কাছে একটি বড় মাছি ঘোরাঘুরি করছে। অস্বস্তি হচ্ছে। এ জাতীয় মাছি আম-কাঁঠালের দিনে দেখতে পাওয়া যায়। অবশ্যি বাজারে এখনও কাঁঠাল-আমের আমদানি আরম্ভ হয়নি। বৈশাখ মাসের শুরু। মৌসুমী ফলের জন্য আরও কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে। অপেক্ষার কথায় মনে পড়ল, সম্রাট আর কতক্ষণ অপেক্ষার পর বাথরুমে যেতে পারবে, জানা নেই। ঘরে কেউ একজন থাকলে ভালো লাগতো। তাকে জিজ্ঞেস করে সময়টা বের করতে পারতো। সমস্যা হলো সম্রাট যেই ঘরটিতে আছে, এমন ঘরে দুজন থাকা সম্ভব নয়। আছে বললে ভুল হবে, তাকে জোর-জবরদস্তি করে বেঁধে রাখা হয়েছে। কবরের মতো একটি ঘর। পার্থক্য কেবল কবরে দরজা-জানালা থাকে না, এই ঘরেও নেই। শুধু দম আনা- নেওয়ার জন্য মাথা বের করে দেওয়া হয়েছে। মোবাইল মানিকের এ রকমই নিয়ম। শাস্তি স্বরূপ আসামিকে গলা পর্যন্ত মাটিচাপা দিয়ে কচ্ছপের মতো মাথা বের করে রাখা। সম্রাট কী অপরাধ করেছে, জানে না। রমজান মাস। সেহরি খেয়ে ঘুমিয়েছিল। সকাল-সকাল মোবাইল মানিকের সাঙ্গপাঙ্গরা তাকে জোর করে তুলে এনেছে মোবাইল মানিকের ডেরায়। হাত-পা বেঁধে, কোলপাঁজা করে কয়েকজন ধরাধরি করে কোথায় এনে ফেলে রেখে চলে গেল! সম্রাটের যখন জ্ঞান ফিরলো, দেখতে পেল সে মাটির সঙ্গে লেগে আছে। প্রথমে মনে করলো সে মারা গেছে, ভাবতেই তীব্র ভয় তার মনের ভেতরটাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। একটু ধাতস্থ হতেই নিজেকে আলগা মাটির সঙ্গে লেপ্টে থাকতে দেখল। সাঙ্গপাঙ্গদের কেউ একজন তখন এখানে ছিল। সম্রাট ভীতকণ্ঠে চিৎকার-চেঁচামেচি করে বলল, আপনারা কারা? আমাকে বেঁধে রেখেছেন কেন?
সাঙ্গ লোকটি বিরক্ত হলেও বকাঝকা করল না। বরফশীতল গলায় বলল, মোবাইল মানিকের নির্দেশ। বেশি আওয়াজ করবেন না। জানে মারা পড়বেন।
সম্রাট আগের চেয়ে আরও ভীত গলায় বলল, মোবাইল মানিকটা কে, আমি চিনি না। আমাকে ছেড়ে দিন, প্লিজ। আমি এখানে নতুন এসেছি।
সাঙ্গ লোকটি এবার কাছে ঝুঁকে এসে দাঁত কামড়ে বলল, একদম চোপ! কথা কইতে না করছি না! কল¬া নামিয়ে দেব।
সাঙ্গ লোকটির লাল চোখ দেখে সম্রাট ভয় পেল। কথা বলার খেই হারিয়ে ফেলল। মিনিট বিশ চুপ থাকল। তলপেটে পেসাবের অসহনীয় চাপ অনুভূত হচ্ছে।
পেসাবের কথা শোনামাত্র লোকটি কিছু না বলে প্রস্থান করার আগে শুধু বলল, মোবাইল মানিক এক ঘণ্টার ভেতর চলে আসবে। যা জিজ্ঞেস করবে সব সত্যি বলবি। না হলে কাফন ছাড়াই দাফন হয়ে যাবি আজ।
সাঙ্গ লোকটি তুই-তোকারি করল। গু-পা-া তুই-তুই করে কথা বললে এদের থেকে সাবধান থাকাই ভালো। সম্রাট ঢোক গিলে আবারও বিশ মিনিট চুপ হয়ে থাকল। এখন সে একা।
চারপাশটায় ভালো করে একবার তাকাল। ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। শুধু সামনে গাছপালার দৃশ্য। পেছনে তাকানোর শক্তি নেই। পেছনের অংশ দেখতে হলে মাটি ফুঁড়ে বেরোতে হবে। নির্জন একটা জায়গা। অপরাধমূলক কাজের জন্য এ রকম জায়গাগুলোকেই বেছে নিতে হয়। সম্রাটের অপরাধ কী সে জানে না। শুধু বুঝল, মোবাইল মানিক নামক জীবটি এই এলাকার বড় কোনো গ্যাং লিডারের নাম। যার এক ইশারা মানুষকে ঘর থেকে তুলে এনে মাটির ভেতর গেড়ে দিতে পারে। মাথা কেটে ফেলতেও ভয়-দ্বিধা নেই হয়তো মোবাইল মানিকের। লোকটিকে দেখার বড় শখ। এক ঘণ্টা হয়ে গেল। কারোর আসার নাম নেই। সম্রাটট এক থেকে ষাট পর্যন্ত সেকেন্ডের গতি ধরে গুনল। ষাট সেকেন্ডে এক মিনিট, ষাট মিনিট গোনার পরও ধারে-কাছে কেউ এলো না। চিৎকার করে কাউকে ডাকবে উপায় নেই। মুখে আলগা বাঁধন। কথা বললেই গলায় টান পড়ে। পেসাব-যন্ত্রণায় সম্রাটের মরণ অবস্থা। অসহনীয় যন্ত্রণায় মুখকুঁচকে যেতে থাকে। মনে পড়ল, ছেলেবেলায় খেলার মাঠে খেলতে গিয়ে যখনই তার পায়খানার চাপ সৃষ্টি হতো মনে মনে বলতো, আমার পায়খানা যা, কুত্তার পায়খানা আয়। দুই তিনবার বলতো। কী অবাক কা-! বলার পর সত্যি-সত্যি বাথরুমের চাপ চলে যেতো। এই অদ্ভুত আবিষ্কার গ্রামের রতন নামের এক ছেলের। ছেলেটিই সম্রাটকে শিখিয়ে দিয়েছিল পেসাব-পায়খানার চাপ এড়াতে ‘আমার পায়খানা যা, কুত্তার পায়খানা আয়’ কয়েকবার বললেই চাপ কমে। পেসাব-পায়খানা চলে যায়। এরপর থেকে যখনই সম্রাট বাথরুম না পেয়ে পেসাব-পায়খানার চাপে পড়তো রতনের দেওয়া টিপস ব্যবহার করতো। এতে তার কষ্ট কমে যেতো। ইন্টারমেডিয়েট পাসের পর রতন দুবাই চলে গেল। এরপর আর দেখা হয়নি। ইতি নামের একটি মেয়েকে রতন অনেক ভালোবসতো। মেয়েটির ভালোবাসা না পাওয়ার কষ্টে সে দুবাই পাড়ি দিল। সম্রাটও এতকাল ভুলে ছিল রতনের দেওয়া টিপস। কিন্তু আজ এত বছর পর কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। বলতে-বলতে সম্রাট ষাট সেকেন্ডের গতিতে ষাটবার বলল। যন্ত্রণা আরও বাড়ল বোধ হয়। তীব্র ব্যথা। সম্রাট বলতে লাগল, আমার পায়খানা যা, মোবাইল মানিকের পায়খানা আয়। আমার পায়খানা যা, মোবাইল মানিকের …।
নাড়াচাড়া দে, মরে গেছে মনে হয়।
লিডার, এই ছেলের নাম সম্রাট। এত তাড়াতাড়ি মরব না। ওরে মাটি থেকে তুইলা পাছার মধ্যে বেতকাঁটা দিয়ে বেত্রাঘাত করলেই মুখ দিয়ে ফেনার মতো কথা ছুটবো। ওই হারামজাদা ওঠ। তাকা, ভালো কইরা চায়া দেখ, তোর যম সামনে দাঁড়ায় আছে।
সম্রাট তিরতির চোখে তাকাল। তাকাতে তার ভারী কষ্ট। তবু তাকাল। চিকনা-পাতলা একটি লোক শার্টের কাপড়ের এক কোনা ধরে নাক-মুখ আটকে রেখেছে। পাশের লোকটির মাস্ক পরনে। সোজা লম্বা গলার জেব্রাভঙ্গি। লোকটি বলল, কাপড় ভিজিয়ে ফেলেছে কেন দেখ।
লিডার সব নষ্ট করে দিছে। শালায় হাগছে। পুকুরে ফেলতে হইব।
পানির ঝাপটা চোখেমুখে লাগার সঙ্গে সঙ্গে সম্রাটের চেতনা এলো। নিজেকে আবিষ্কার করল ময়লা ফেলার পুকুরে, কিন্তু পরিষ্কার পানি। একেবারে তলার মাটি পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। এমন পরিষ্কার পানির পুকুরেই ইতির সঙ্গে সম্রাটের প্রথম প্রেম হয়। সম্রাটদের বাড়ির অদূরেই একটি পুকুরঘাট। নদী না থাকায় সেই পুকুরে গ্রামের অধিকাংশ লোক গোসল করতে আসতো। নারী-পুরুষের গোসলের সময় রুটিন করা ছিল। নারীরা বেলা বারোটার আগে গোসলের জন্য আসতে পারবে না। সেই সময়ের ভেতরে পুরুষদের গোসল শেষ করতে হবে। বেলা বারোটার পর পুকুরে পুরুষদের আসা নিষিদ্ধ। কোনো এক কারণে সম্রাট সেদিন দুইটার পরে গোসল করতে আসে। পুকুরে তখন কেউ ছিল না। ডুব দিয়ে দীর্ঘ সময় গোসল করে যাচ্ছিল সে। হঠাৎই পায়ের কাছে মানব শরীরের স্পর্শ পেয়ে ভয় পেয়ে গেল। টলটলে পরিষ্কার পানির ভেতর দেখতে পায়, একটি মেয়ে পানির নিচে নাক চেপে ধরে ডুব দিয়ে আছে। সম্রাট প্রথমে ঘাবড়ে গেল। অল্প পরেই তার ঘাবড়ানো দৃষ্টিকে পরিবর্তন করে মুগ্ধতা আনতে পানির নিচ থেকে জলপরির মতো মেয়েটি ওঠে দাঁড়াল। মেয়েটিকে সম্রাট চেনে, ইতি। কোনোদিন কথা হয়নি। রতনের মুখে শুনেছে সে অনেক সুন্দর। সচরাচর তাকে দেখা যায় না। বাড়ির বাইরে বেরোয় কম। সম্রাটকে অবাক করে দিয়ে ইতি বলল, দুদিন পর আমার বিয়ে। আপনাকে এতো খবর দেওয়ার পরও আসেননি কেন স্যার? আজ রাতেই আমাকে পালিয়ে নিয়ে বিয়ে করবেন, বুঝেছেন?
সম্র্াট কী বলবে বুঝতে অসুবিধা হলো। বোকার মতো জিজ্ঞেস করল, তোমার নামই কি ইতি? রতন তাহলে তোমার কারণেই দেশ ছেড়েছে?
ইতি বলল, কোন্ রতন? আমি চিনি না। একজন ছিল কী যেন নাম। আমার পিছু-পিছু ঘুরতো। তাকে বললাম, আমি একজনকে ভালোবাসি। সে আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আমার ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষার পর বিয়ে করলে তাকেই করবো। এসব শোনার পর সে কোনোদিন আর সামনে আসেনি। শুধু একদিন এসে বলল, আমি চলে যাচ্ছি, সম্রাটকে আমি দেখে নেবো। আমি যাকে ভালোবাসি তার নাম সম্রাট সে জানলো কী করে, জানি না। এরপর কোনোদিন আর তাকে দেখিনি। স্যার আমাকে নিয়ে আজ রাতেই আপনি পালাবেন তো? আমাকে বিয়ে না করেন যদি কসম খোদার এই পুকুরের পানিতে ডুবে মরব।
ইতিকে নিয়ে সম্রাটের পালাতে হলো না। গ্রাম ছেড়ে রাতেই পালিয়ে পাশের থানায় আশ্রয় নিয়েছে সে। এখানে কেউ তাকে চেনার কথা নয়, চিনলেও অসুবিধা নেই। বাড়ি থেকে সম্রাট বেরোয় না। তার এক ছাত্রের খালার বাড়ি। শুধু বিপদের কথা বলে অনেক কষ্টে দুইটি রাত থাকার জন্য ম্যানেজ করেছে ছাত্র আর ছাত্রের খালাকে। শুধু এই দুইটি রাতই, তারপরই সম্রাট নিশ্চিত হতে পারবে। ইতির বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরপরই গ্রামে ঢুকবে। সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে স্কুলের শিক্ষকতার পেশায় জড়িয়ে পড়বে আবার। এ যাবত এরকমই ছিল চিন্তা। কিন্তু মোবাইল মানিকের ধরপাকড়ের ফলে সম্রাটের কলিজায় পানি নেই। তার এখন আর বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না মোবাইল মানিকের সঙ্গে ইতি বিষয়ক কোনো যোগসূত্র রয়েছে।
সাঙ্গ লোকটি চেঁচিয়ে বলল, ওঠে আয় শালা। সাঁতার না জানলে ডুবে মরবি!
সম্রাট এমনিতেই মরমর। নিজের সম্মানহানিতে যারপরনাই সে লজ্জিত। একজন স্কুল মাস্টারের সঙ্গে এ জাতীয় আচরণে সে অভ্যস্ত নয়। মোবাইল মানিক ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা খুবই খারাপ করে যাচ্ছে তার সঙ্গে।
সম্রাট বিনয়ের সঙ্গে পাড়ে ওঠে আসার সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল মানিক বলল, ইতিকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস বল।
সম্রাট আগের চেয়ে আরও বিনয়ের সঙ্গে বলল, আমি সত্যিই কিছু জানি না। ইতি বিষয়ক ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকার জন্য বিয়ের আগের দিন রাতে আমি একা পালিয়ে এসেছি। আমি জানতাম, মেয়েটি অস্বাভাবিক। আমার মানসম্মান বাঁচাতে আমি পালিয়ে এসেছি।
মোবাইল মানিক দম নিয়ে কী ভাবলো যেন। তারপর পকেট থেকে একটি কাগজ বের করে সম্রাটের হাত গুঁজে দিয়ে বলল, পড়।
পুরো চিঠিটা সম্রাট পড়ল। পড়তে-পড়তে তার চোখ দুটি ধক করে জ্বলে উঠতে চাইছে। মেয়েটি তাকে ভালোই ফাঁসিয়েছে। চিঠিতে স্পষ্ট লেখা, আমি সম্রাট স্যারকে ভালোবাসি। তাকেই বিয়ে করব। তার সঙ্গে পালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের খুঁজে হয়রান হয়ে সময় নষ্ট করার দরকার নেই।
সম্রাট কিছু বলতে যাচ্ছিল তাকে থামিয়ে দিয়ে মোবাইল মানিক রহস্যের হাসি হেসে বলল, আমরা জানি আপনার সঙ্গে ইতি পালায়নি। একটু আগে ইতিই ফোন করে বলেছে সে আসছে এখানে। আপনি যখন গ্রাম থেকে বের হয়ে পালাচ্ছিলেন, তখন ইতি আপনার পিছু নিয়ে আপনাকে ফলো করছিল। সে আগেই টের পেয়েছিল আপনি পালাবেন। যেই ছেলেটির খালার বাড়িতে রয়েছেন সেই ছেলেটিই ইতিকে আপনার ব্যাপারে সব জানিয়েছে। আমি ইতির ফুপাত ভাই। আমার ইতি দায়িত্ব দিয়ে রেখেছে আপনাকে বেঁধে রাখতে। ওই তো ইতি এসে গেছে।
পুকুর পাড়ের গাছপালার ভেতর দিয়ে একটি মেয়েকে আসতে দেখল সম্রাট। কাছাকাছি আসতে দেখে ইতি। চোখমুখ ফোলা। মনে হলো অকেক্ষণ কেঁদেছে। সম্রাটের সামনে দাঁড়িয়েই শিশুদের মতো কেঁদে ফেলল। সম্রাট অপ্রস্তুত। কী করবে বা বলবে বুঝে উঠতে পারলো না। একটু পর ইতি জিজ্ঞেস করল, স্যার, আপনার তো আমাকে নিয়েই পালিয়ে যাওয়ার কথা। তা না করে একা পালালেন কেন? জানেন, আমি প্রতিদিন কত কেঁদেছি?
এই পাগলি মেয়েটিকে এক মুহূর্তে অসম্ভব ভালো লেগে গেল সম্রাটের। সে কেবলই বন্ধু রতনের প্রেমিকা জেনে ইতিকে উপেক্ষা করে গেছে এতকাল। কিন্তু আজ তার মনে হলো এ রকম পাগলামো যে মেয়েটি করতে জানে তাকে কষ্ট দেওয়ার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা তাকে দেয়নি। আজ থেকে পলাতক পুরুষ হয়ে ফিরবে না সে।