আরিফুল হাসান
বেশ বড়সড় একটা কাচের মিনার। তার চারপাশে আনন্দ পার্ক। আদিল ও রিদিকা পার্কে হাঁটে। বাদাম ভেঙে খায়।
ভাঙতে-ভাঙতে তারা বাদামের খোসা, ভাঙতে-ভাঙতে তারা পথ হয়ে ছায়া খুঁজে। ছায়া সে কোন সুদূরের রূপ! ছায়া পায় না। ঝলসায় রোদ তাদের। তারা দুজন ক্লান্ত হয়। ক্লান্ত হয়ে রোদেই বসে পড়ে। আবার ক্লান্ত হয়, বসা থেকে ওঠে, আবার চক্কর দেয়। নিরাক দুপুরে তাদের কোনো ছায়া নেই, আশ্রয় নেই, শুধু চারপাশে ছুটে আনন্দ আনন্দ। আনন্দ থেকে ছুটি পেতে তারা ভয় পায়। এ আনন্দ লগ্নি করে দৈহিক শান্তিকে। আর তা নিবিড় নিষিদ্ধ। সুতরাং তারা আনন্দ থুতে ভয় পায়। কোথায় রাখবে জগতের আনন্দসার?
দুপুরটা চকমক করে। তারা হাঁপিয়ে যায়। প্লাস্টিকের বোতল থেকে ঢোকখানেক জল খেয়ে আবার হাঁটে। মরুভূমির মতো এ পার্ক। গাছ আছে, কিন্তু ছায়া নেই। পাতা আছে, কিন্তু সেগুলো ফালা-ফালা করে বেরিয়ে যাচ্ছে রোদ। নীলরশ্মি সোজা ঢুকে যাচ্ছে মগজে। মগজের আমন্ত্রণে সেপ্টেম্বরের দুপুরে হৃদিকা হাত ধরে। না, আর পারছি না আদিল। আদিল হাত দিয়ে রিদিকার ওল্টে যাওয়া হিল-সু তুলে দেয়। তার উরুতে হাঁটু রেখে রিদিকা দাঁড়ায়। আদিল জুতা তুলতে গিয়ে সেঁটে যায়; জমিনের সঙ্গে, জুতোর সঙ্গে, রিদিকার পায়েলের সঙ্গে মিলেমিশে যায়। সময় যায়। রোদ বাড়তে থাকে। রিদিকা হেসে ওঠে- কী হলো! আদিল- এই তো, এই তো আমি।
জুতো পায়ে আবার আদিল-হৃদিকার হাঁটতে থাকা। হাঁটতে-হাঁটতে তারা একটি ভাঙা খেলনা গাড়ি পায়। ট্রেন গাড়ি। পোলাপান ক’দিন আগেও এটিতে চড়ে হুল্লোড় করে করে পার্ক মাতিয়েছে। এখন চুপসে গেছে, দুটোই। তবু তো একটু সুখের মুখ। আহা পুরাতন গাড়ি, পরিত্যক্ত বগি হলেও একটু ছায়া তো পাবো। Ñনা, ছায়া নেই, রোদ কেটে সয়লাব করছে ইস্পাতের ট্রেন। ট্রেন থেমে আছে। বিপরীত পাশ থেকে সূর্য হেললেও, বগির ভেতরে গতি বসলেও ছায়া নেই।
হাঁটতে-হাঁটতে তারা একটি কাচঘরের দেখা পায়। বাগানের মাঝখানে ঠিক কাচঘরটা। আশ্চর্য! এতক্ষণ দেখেনি কেনো তারা? যাই হোক, কাচঘরটির সামনে এসে তারা দাঁড়ায়। আশ্চর্য এক শীতলতা তাদেরকে মোহিত করে। মনে হচ্ছে ভেতরে কেউ এসি লাগিয়ে দিয়েছে আর কাচের গায়ে গুঁড়ো-গুঁড়ো জলবিন্দুগুলো জমে বেয়ে নামছে যেন দুপুরের দেহে। আহা, কী শান্তি! হৃদিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলেÑ ইশ্ এটির ভেতরে যেতে পারতাম! আদিল আশ্বাস দেয়Ñ নেবো। তোমাকে আমি অনন্ত শীতলতার ভেতর নিয়ে যাবো এই দুপুরের রোদ ভেঙে। কিন্তু কাচ তো ভাঙে না। কোনো পথ খুঁজে পায় না এই আশ্চর্য ঘরের। তারা চারপাশে ঘুরে। ঘুরতে-ঘুরতে প্রশান্ত হয়। এক সময় আকাক্সক্ষাটা বিস্ফোরক হয়ে ওঠে। তারা ভাঙতে চায় নিজেদের। তখন একটি দরজা খুলে যায় কাচঘরের।
কাচঘরের দরজা দিয়ে প্রবেশ করে আদিল এবং হৃদিকা অবাক হয়। খুবই ছিমছাম। কয়েকটা টেবিল আর ভাঙা বোর্ড পড়ে আছে রুমে। যেন কেউ লিখছিল। যেন কোনো ক্লাসরুমটি হঠাৎ নীরব হয়ে গেলো। এ রকম আশ্চর্য নীরবতার ভেতর তারা তাদের পায়ের শব্দও হারালো এবং এই নৈঃশব্দ্যের ভেতর তারা নিজেদের হারাতে-হারাতে একে অপরের ছায়া হয়েছিল। কিন্তু ছায়ার তখন দরকার নেই। রুমটা বেশ ছিমছাম হলেও এর এসি যন্ত্রটা বেশ শক্তিশালী বোধ’য়। খুব ঠান্ডায় তারা কাঁপতে থাকে। কাঁপতে-কাঁপতে রিদিকা বসে পড়ে একটি বেঞ্চির কোনায়। আদিলও বসে পড়ে তার পাশে।
একটু ওঠো না, দেখো না এসির রিমোটটা পাও কিনা; – রিদিকা বলে।
রিমোট, রিমোট কোথায় পাবো আমি? তুমি দেখো; – আদিল বলে।
ঠিকাছে, বসো; – বলে রিদিকা বেঞ্চ থেকে ওঠে। ঘরটির এমাথা-ওমাথা তন্ন তন্ন করে খুঁজে। না, নেই। একেবারে হাওয়া। আশ্চর্য! এসি চলছে আর রিমোটের হদিস নেই! এটা কি হলো? রিদিকা ফিরে গিয়ে আদিলের কাঁধে হাত দেয়Ñতুমি একটু খোঁজো না; প্লিজ!
কী খুঁজবো – আদিল জবাব দেয়। হৃদিকার দ্বিতীয়বার বলার সুযোগ দেয় না। প্রশ্ন করেÑ এসিটা কই?
– আরে! হঠাৎ দমবন্ধ হয়ে যায় হৃদিকার। একি! কোথাও কোনো এসি নেই। তাহলে এই ঠা-া বাতাসটা আসছে কোথা থেকে। দ্রুত তাদের দরজার দিকে চোখ যায়। না, লাগানো! যেটি ভেবেছিল সেটিই হয়েছে। এই দরজা লাগিয়ে দিল কে? আরো সময় থাকে। তারা ঠান্ডা হয়। প্রথমে তাদের স্নায়ু, তারপরে তাদের মগজ আর সবশেষে দেহ শীতল হয়। তারা দুজন ঘুমিয়ে পড়ে।
ঘুম থেকে ওঠে তারা দেখে আবারও দুপুর। এটি ঘুমানোর আগের দুপুরটিই? নাকি পরবর্তী দুপুর? নাকি আরও অনেক দুপুর কেটে গেছে ইত্যবসরে, ঘুমে? জানে না। শুধু তাদের চেনা চেনা লাগে পরস্পরকে। চেনা চেনা লাগে। ঠিক চেনা নয়। কেন এমন হলো? দুজনই আঁতকে ওঠে। Ñহায় হায়, রিদিকা আমি তোমাকে চিনতে পারছি দূর থেকে, ভাসা ভাসা।
– হায় হায়, তুমি কে? কে তুমি, তোমাকে কোথায় যেন দেখেছি হে পুরুষ! মনে পড়ছে, মনে পড়ছে তোমার নাম। তোমার নামের বানান আ দিয়ে, তাই না? হে ছায়া পুরুষ, বলো!
– আমিও তোমাকে চিনতে পারছি না আর। হে রমণী, বলো কে তুমি?
– আমি হৃদিকা।
– হ্যাঁ, রিদিকাÑ রিদিকা। এ নামের কাউকে আমি চিনতাম। তার সঙ্গে কাটিয়েছি কিছুকাল। তার সঙ্গে… ; তার সঙ্গে… আমার সত্যিই কি দেখা হয়েছিল?
– আমি জানি না, আমি জানি না, এখনো জানি না তোমার নাম। হে পুরুষ, কে তুমি। তোমার নামের বানানটি কি আ দিয়ে? নাকি অ দিয়ে? বলে দাও, বলে দাও হে পুরুষ, তোমার আমার কোথায়বা দেখা হয়েছিল? আমাদের কি আদৌ দেখা হয়েছিল? নাকি কোনো স্বপ্নের ভেতর আমরা খুঁজে মরছি দৃশ্যান্তর।
আদিল একটি বেঞ্চিতে দুই হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে বসে আছে। সামনে ভয়ার্ত, জড়সড় দাঁড়িয়ে আছে হৃদিকা। কেউ কাউকে চেনে না, জানে না, কোনো চেনা দৃশ্য নেই। হৃদিকার গাউন ফুঁড়ে একটি আলো মেঝের শাদা টাইলসে আয়তকারভাবে পড়ে। তাতে হৃদিকার দেহের ভাঁজ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু তাতে আদিল কোনো আকর্ষণ অনুভব করে না।
দুজনারই ভেতর থেকে শুকিয়ে গেছে নদী।
কাচবদ্ধ বরফের ঘরে দুজনের যাপনই অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে এবং এক পর্যায়ে মনে হয় তারা ফসিল হয়ে যাচ্ছে। বিলীনতার ভেতর থেকে জেগে উঠতে তারা দুজনই বদ্ধপরিকর এবং যে করেই হোক এ কাচের খাঁচা ভাঙতেই হবে। তারা জেগে ওঠে। মৃত্যুর আগে জ্বলে ওঠার আগুনে তারা পোড়াতে থাকে আত্মজ্বালানির সবটুকু। তারা আঘাত করে কাচের দেয়ালে। অতঃপর আঘাত করে পরস্পরে, দরজা খুলে। দুজনই জমানো পা টেনে কোনোরকম বের হয়।
বাইরেরটা আশ্চর্য সুন্দর। আনন্দ পার্কে হঠাৎ করে এই গাছ এলো কোত্থেকে? একেবারে জীবন্ত গাছ। মিনারটাতে ঢোকার সময়ও এখানে ছিল না। অথচ সামনেই কি চমৎকার ঝোপ। মোহময় ছায়া বিছিয়ে আছে লাবণ্যে। আদিল ও হৃদিকা ছায়ায় গিয়ে বসে। শেষবারের মতো একবার চোখ ফেলে মিনারে। চোখ চমকায়। একটা বাঘের ছায়া ফুটে ওঠে কাচের দেয়ালে। আদিল-হৃদিকা ভয় পেলেও ভুলে যায়। তারা চিনতে পারে পরস্পরে। আদিল হৃদিকার গালে একটি ছোট্ট চুমু দিয়ে বলেÑ আই লাভ ইউ। পেছন থেকে ঝনঝন শব্দ হয়। কাচের দেয়াল টুকরো-টুকরো করে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্ষুধার্ত বাঘ।