ড. আনোয়ারা আলম »
আমাদের সংস্কৃতির অতি কথা এই যে, পুরুষ কর্ম আর নারী প্রকৃতি। মেয়েদের যে কোন ধরনের কাজকে খুব একটা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয় না। সংগ্রামী নারী পায়ে হেঁটে অনেক দূর থেকে পানি সংগ্রহ করে -এই ছবির নিচে ক্যাপশন হয় ‘বধূ জলকে চল’- আর লাঙ্গল হাতে পুরুষের ছবির নিচে লেখা থাকে ‘জীবন সংগ্রাম’।
অথচ একজন নারী বস্তুতপক্ষে আন্তরিকভাবে শ্রম দিতে আগ্রহী। ঘরে বাইরে সে শ্রম দেয়, কিন্তু মূল্যায়ন হয় না। একশ ভাগ নারী আমি মনে করি বাইরে শ্রম দিতে আগ্রহী। গার্হস্থ্য শ্রমের বাইরে যেমন একেবারে নিরক্ষর সাধারণ ঘরের মেয়েও গার্মেন্টস শিল্পে কাজ যোগাড় করে বস্তিতে এসে থাকছে শুধুমাত্র নিজে অর্থ উপার্জন ও সংসারের সচ্ছলতার জন্য। আশির দশক থেকে পাল্টে গেছে দৃশ্যপট; যেন ঘটে গেছে এক নিরব বিপ্লব। বাংলাদেশের বড়ো বড়ো শহরে বিশেষত গার্মেন্টস শিল্পে কর্মরত নারীশ্রমিকদের পদচারণায় মুখর সকালের পথ।
ক্রমবর্ধমান ফতোয়া,সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা বা নিন্দা এ পথযাত্রাকে স্থবির করতে পারেনি – এ যাত্রা ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। বাজার অর্থনীতিতে দেশের মেয়েরা নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করছেন, শিক্ষিত নারীরা শুধু শিক্ষকতায় নয় প্রকৌশলী হিসেবে বা বিভিন্ন ব্যতিক্রমী পেশায় নিজেদের নিয়োজিত করছেন। গ্রামের নারীরা আত্মকর্মসংস্থান ব্যবস্থা করে নিচ্ছেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সাহায্যে। নারীরা অনেকে কাজ করছেন শুধু অর্থনৈতিক প্রয়োজনে নয় বরং মানসিকতার ইতিবাচক পরিবর্তনে। এটি তাঁদের আইডেনটিটি সমস্যার সমাধানে নিজেকে বিকশিত করার লক্ষ্যে। কারণ কিছু কিছু ধারণা এখনো বিদ্যমান যেমন তোমার অভাব কিসের? বা পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রোথিত হয়ে আছে যেমন – ‘মেয়েরা ঘরের শোভা,শারীরিক ভাবে নারী পুরুষের চাইতে দুর্বল বা মেধা ও দক্ষতায় কম ক্ষমতাসম্পন্ন বা কর্মজীবী নারীরা সাংসারিক কাজে অদক্ষ বা সন্তানেরা ঠিকমতো মানুষ হয়ে উঠে না ইত্যাদি ইত্যাদি। এ ধারণার বহিপ্রকাশ ঘটে নানাভাবে। প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় ঘরে বাইরে, কর্মক্ষেত্রে, ভালোবাসার ক্ষেত্রে বিরূপ অনুভূতি প্রকাশে, শিল্প সাহিত্যে,সংবাদ প্রকাশে,গণমাধ্যম -কৌতুক ইত্যাদিতে এই নারীর রূপায়ণ সমূহের পুনর্জন্ম ঘটে ধারণাগুলো শক্তিপ্রাপ্ত হয় আর অনেক নারী তখন কখনো শারীরিক বা কখনো মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। শিক্ষা বা মানসিকতার ইতিবাচক পরিবর্তনে অনেক নারী নানাভাবে কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হলেও তাদের আয়কে অনেক সময় বাড়তি বা সহায়তাকারী হিসেবে অবমূল্যায়ন করে। কিন্তু নারী বাইরে যাঁরা মেধা ও শ্রম দেন এটি তাদের অর্জিত কর্মক্ষমতা বা শিক্ষার যথাযথ ব্যবহার করতে- তার অবস্থান, সম্মান, ব্যক্তিত্ব, সুযোগ ও নিরাপত্তার উন্নয়নের জন্য এবং আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে মর্যাদার সাথে প্রয়োগ করতে। অর্থাৎ এই একুশ শতকে এসেও পরিলক্ষিত হয় বাহ্যিক দৃষ্টিতে নারী শিক্ষা, সম্পদ, অর্থ ইত্যাদির কারণে কোন কোন ক্ষেত্রে আপাত মর্যাদা লাভ করলেও এ সমাজে নারীরা মূলত জন্মগতভাবে পুরুষের অধস্তন থাকার মতো সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে শৃঙ্খলাবদ্ধ। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে দেখা যায় নারীরা বিভিন্ন ব্যতিক্রমী পেশায় জড়িত হলেও এখনো তাদের জন্য গ্রহণযোগ্য পেশা হিসেবে চিকিৎসা ও শিক্ষকতাই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য।
বিয়ে এখনো প্রধান প্রতিবন্ধকতা। দেখা যায় এখনো অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে নারীরা এসেছেন বিয়ের পরে স্বামীর সহযোগিতায়। অথবা কেউ কেউ চাকরির পরে বিয়ে করেছেন। অর্থাৎ কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রবেশের পথে পরিবার মুখ্য ভূমিকা পালন করছে।
চাকরিজীবি নারীর মূল সমস্যা কর্মক্ষেত্র এবং ঘর এই দুইএর সমন্বয় রক্ষা করা। প্রথাগত কারণে অনেক কর্মজীবী নারীর ভেতরে একধরনের অপরাধবোধ কাজ করে,এটি আবার তাদের কর্মক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই কাজ করার তৃপ্তি অনেকে হারিয়ে ফেলে। নারীর চাকরির আরেকটি প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে প্রসূতিকালীন এবং শিশু পরিচর্যা বিষয়ক ছুটি। আই এল ও কনভেনশনের ম্যাটার্নিটি বেনিফিটস এ্যাক্ট ১৯৩৯ অনুযায়ী নারীর প্রাপ্য ছুটি ছয়মাস। এটির কারণে ও অনেক কর্মপ্রতিষ্ঠান নারী কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে তেমন আগ্রহ দেখান না। কিছু কিছু বেসরকারি কর্মপ্রতিষ্ঠান এর চাইতে কম ছুটি দেন। আপত্তি এলে হয়তো চাকরিকালের স্থায়িত্ব প্রদানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। নারীর কর্মপরিবেশে এখনো অনেক প্রতিকূলতা আছে।
অনেক প্রতিষ্ঠানে পুরুষ কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের কাছ থেকে সহযোগিতা পান না বা প্রশিক্ষণ নেওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য বা গার্মেন্টস শিল্পে কর্মী বেশি থাকলে মজুরি বৈষম্য বা অনেক ক্ষেত্রে নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়। অভিযোগ করলে অভিযোগকারীর জীবনে নেমে আসে নানা বিপর্যয়।
এরপরেও দেশে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতিসংঘের এক রিপোর্ট অনুযায়ী ‘ফিমেল হেডেড পরিবারের’ সংখ্যা বাড়ছে। নারীরা উদ্যোক্তা হিসেবে যেভাবে অর্থনীতিতে ভূমিকা পালন করছে তা প্রশংসনীয়।
কর্মজীবী নারীর সম্ভাবনাকে প্রশস্ত করার জন্য দরকার বিদ্যমান সমস্যার সমাধানে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসা। বিশেষত যেসব প্রতিষ্ঠানে নারী কর্মী বেশি সেখানে শিশুদের জন্য ডে কেয়ার সেন্টার গড়ে তোলা। একই সাথে নারীকেও কিছু দায়িত্ব পালন করতে হবে। যেমন আচরণগত পরিবর্তন অর্থাৎ নিজেকে প্রফেশনাল হিসেবে গড়ে তোলা। ঘরের সমস্যা কর্মস্থলে না আনা বা নিজেকে নারী হিসেবে না মানুষ হিসেবে কর্মস্থলে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দেওয়া।’ পরিবার ও কর্মস্থল ‘ এই দুটোর ক্ষেত্রে ভারসাম্য রাখার জন্য কৌশলী হওয়া।
নারীর স্থান শুধুমাত্র গৃহকোণ এ ধারণা এখন পাল্টে যাচ্ছে। পরিবারে নারী যেমন একজন গৃহ ব্যবস্থাপক তেমনি কর্মস্থলে ও তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা বা কর্মচারী। নারীকে এগিয়ে যেতে হবে আত্মবিশ্বাস আর মর্যাদার সাথে। বেগম রোকেয়া বলেছিলেন -‘আমরা সমাজের অর্ধাঙ্গ। আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কিরূপে। কোন ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষের স্বার্থ আর আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে-একই -আমাদের উচিত যে তাহাদের সংসারে এক গুরুতর বোঝা বিশেষ না হইয়া সহচরী, সহকর্মী ইত্যাদি হইয়া তাহাদের সহযোগিতা করা।’
নারী পুরুষের যৌথ শ্রম, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহযোগিতা ও সমন্বিত উদ্যোগে গড়ে উঠুক এক ভারসাম্যমূলক সমাজ তথা রাষ্ট্র। এটাই কাম্য।